রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রমজানের প্রস্তুতি: কিছু কথা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


যে মাসে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে, যে মাসে এমন একটি রাত আছে, যে রাতে ইবাদত করা এক হাজার মাস ইবাদত করার সমুুল্য, যে মাসের প্রতিটি স‚র্যাস্ত রোজাদারদের দোয়া কবুলের সময়, সেই পবিত্র মাহে রমজান সমাগণ। এমন মহিমান্বিত একটি মাসের জন্য নিশ্চয়ই আমাদের মানসিক, শারীরিক ও উপযুক্ত রসদাদি নিয়েই প্রস্তুতি নেয়া উচিত; যাতে এর একটি মুহ‚র্তও হেলায়ফেলায় বিনষ্ট হয়ে না যায়। রমজান মাসেই আমরা যেন আমাদের অনাকাক্সিক্ষত পাপাচারগুলো মোচন করাতে আল্লাহ পাকের সামনে আরো গ্রহণযোগ্যভাবে নিজেদের সমর্পণ করতে পারি। তার জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতি নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপ‚র্ণ। রাস‚লের (স.) সাথীরা রমজানের সময়কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর জন্য এণই সচেতন ছিলেন যে, রমজানের আগের পাঁচটি মাস রমজান নিয়ে ভাবতেন এবং রমজান-পরবর্তী ছয়টি মাসই রমজানে কৃত ইবাদতগুলো আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না তা নিয়ে বিচলিত থাকতেন। আমাদেরও তাই রমজানকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করার উদ্দেশ্যে কিছুটা পরিকল্পনা হাতে নেয়া উচিত।
রমজানে পানাহার: আমরা সাধারণত পেঁয়াজু, মরিচা, বেগুনি, সিঙ্গাড়া, সমুচা, পাকোড়া ইত্যাদি ডুবো তেলে ভাজাপোড়া খাবার দিয়েই ইফতার করতে অভ্যস্ত। অথচ স্বাস্থ্যগণ দিক থেকে সারাদিন রোজা রেখে খালি পেটে এ ধরনের খাবার আমাদের জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতিকর তা উপলব্ধি করার জন্য ডাক্তার হওয়ার প্রয়োজন নেই। গ্যাস্ট্রিক-আলসারের সুবাদে মোটামুটি সবারই কিছু-না-কিছু অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে গেছে। খালি পেটে ভাজাপোড়া না খেলে যে ইফতার করা হবে না, এমনটিও কিন্তু নয়। আমরা একটু সচেতনভাবে চেষ্টা করলেই এই ধারা পরিবর্তন করতে পারি। এর পরিবর্তে ফলমূল, দই ও দইজাতীয় খাবার (যেমন- লাচ্ছি, বোরহানি, দইবড়া প্রভৃতি), সিরিয়েল-জাতীয় খাবার যেমন রুটি গ্রহণ করতে পারি। অনেকেই অল্প কিছু খেজুর, পানীয়, ফলমূল দিয়ে ইফতারি করেন। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এভাবেই ইফতার করে থাকে।
সারাদিন রোজা রেখে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের চোখের খিদেটা বেড়ে যায়, মনে হয় যেন অনেক কিছুই নিঃশেষ করে ফেলা যাবে নিমিষেই। প্রকৃতপক্ষে সারাদিন উপোস থেকে অতিরিক্ত ভোজন আমাদের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। অতি ভোজনে কোনো দিক থেকেই কোনো কল্যাণ নেই। ডাক্তারদের অভিমত, ৮০ শতাংশ মানুষের রোগই খাদ্যের কারণে সৃষ্ট। আমরা কেউ সঠিক খাবার গ্রহণ করছি না বা সঠিক সময়ে গ্রহণ করছি না কিংবা সঠিক পদ্ধতির খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলছি না। আল্লাহর রাসুল (স.) পরিমিত আহারকে উৎসাহিত করছেন। আমাদের সামান্য সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা ইফতারিতে ভ‚রিভোজন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। এতে শরীর হালকা থাকায় তারাবির নামাজ পড়তেও সহজ হয়। পাশাপাশি গৃহিণীদের জন্যও হরেক রকম ইফতারি আয়োজনের সময় ও শ্রম থেকে কিছুটা ইবাদতে মনোনিবেশ করতে সুবিধা হয়।
সারা দিন রোজা রাখতে গিয়ে আমরা খুব সহজেই পানিস্বল্পতায় ভুগি। যেসব দেশে প্রচÐ গরম আবহাওয়া কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে হয়, তাদেরও পানিস্বল্পতায় ভোগা স্বাভাবিক। আমাদের পক্ষে শরীরে উটের মতো পানি সঞ্চয় করে রাখারও কোনো সুযোগ নেই। তাই একটু সচেতনতার সাথেই পানিস্বল্পতা রোধের ব্যাপারে আমরা কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি। গুরুপাক খাবার যেমনÑ বিরিয়ানি, পোলাও, ডুবো তেলে ভাজাপোড়া কিংবা এমন খাবার, যা শরীর থেকে পানি টেনে নেয় (নান রুটি ইত্যাদি) তা পরিহার করা উচিত। তার পরিবর্তে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, সালাদ, দই ইত্যাদি খাবার গ্রহণ করা উচিত। তুলসী দানা (তোকমার দানা নামেও অনেকের কাছে পরিচিত), বেলের শরবত, ডাবের পানি, শসা, তরমুজ, দই বা দুধ-কলা বা এ ধরনের উপকরণ ইফতার ও সেহরিসহ রাতে গ্রহণ করা যায়।
রমজানে কাজ: আমরা দিনের যে সময়টাতে বেশি কর্মঠ ও বেশি সতেজ থাকি, সেই সময়েই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে নিতে পারি। অনেকের ক্ষেত্রে তা দিনের প্রথম ভাগে হতে পারে, আবার অনেকের ক্ষেত্রে তা অন্য সময়েও হতে পারে। দিনের নানাবিধ ব্যস্ততার মাঝেও আমরা চাইলে কিছুটা সময় আলাদা করে ইবাদতের জন্য কাজে লাগাতে পারি। যে সময়টা আমরা চা পান বা নাশতার জন্য ব্যয় করতাম, সেই সময়েই ইবাদত করতে পারি। একটানা কাজ না করে অল্প কিছুক্ষণ পরে হালকা নড়াচড়া করলে শরীরের ওপর চাপ কম পড়ে। এতে শরীরে জড়তা সৃষ্টি হয় না, তাই সারা দিন কাজ করলেও তেমন একটা কষ্ট অনুভ‚ত হয় না। বিশেষ করে যারা বসে বসে কাজ করেন (যেমন ডেস্কে বসে কাজ), তাদের জন্য হালকা নড়াচড়া বা ব্যায়াম করার ব্যাপারে ডাক্তারেরাও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রমজানেও ৩০-৪০ মিনিট কাজ করে হালকা ব্যায়াম করা ভালো। সারা মাস অনেক কাজ থাকে, তাই আমাদের অনেকেরই আলাদা করে ইতিকাফে বসার সুযোগ হয়ে ওঠে না। কিন্তু আমরা চাইলেই আমাদের বার্ষিক ছুটি থেকে কিছু দিন ছুটি নিয়ে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিকাফে বসতে পারি।
পাঠপরিকল্পনা: রমজান মাস যেমন কুরআন নাজিলের মাস, তেমনি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির মাস। এ মাসেই দ্বীনের অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের জানা ও মানার সুযোগ হয়ে ওঠে। আমাদের প্রত্যেকেরই কুরআনকেন্দ্রিক একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। কুরআনকে বুঝে আয়ত্তে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকে এই মাসে। বাংলা ভাষার তরজমা দেখে এটা সম্ভব। প্রয়োজন হলে একাধিক তরজমা দেখা যেতে পারে। কোনো একটি তরজমায় একটি বিষয়ের দুর্বল অনুবাদ হলে অন্যটায় ঠিকই তার সবল অনুবাদ পাওয়া যাবে। এই মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে। তাই এ মাসে কুরআনের বুঝকেও আল্লাহ সহজ করে দেবেন নিশ্চয়ই।
পাঠপরিকল্পনার ক্ষেত্রে এই ডিজিটাল যুগে আমরা চাইলে বই বা লেখার পাশাপাশি অডিও-ভিডিও মাধ্যমগুলোরও সাহায্য নিতে পারি। অনলাইনে কুরআন শিক্ষা ও অধ্যয়নের বিপুল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কোনো একটি শব্দ এমনকি অক্ষরের বিশ্লেষণও সেখানে পাওয়া যায়। এ ধরনের দু’টি সাইট যেমন িি.িঃধহুরষ.হবঃ এবং যঃঃঢ়://পড়ৎঢ়ঁং.য়ঁৎধহ.পড়স এগুলো কুরআন পাঠে সহায়ক হতে পারে। কেউ যদি চান কুরআনের তরজমা শুনবেন ইউটিউবে, তারও সুযোগ রয়েছে। আমরা সেগুলো ডাউনলোড করে রেখে অফিসে আসা যাওয়ার পথেই দেখে নিতে পারি কিংবা অডিওগুলো শুনে নিতে পারি। পাঠপরিকল্পনার জন্য কেবল পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ না রেখে, তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত বইপত্র বা ডিজিটাল উপকরণগুলো হাতের নাগালে রাখা অত্যাবশ্যক।
রমজানে কেনাকাটা: রমজান মাসে বাজার করতে যাওয়া মানেই কষ্ট। এক দিকে হুড়োহুড়ি-ঠেলাঠেলি, অন্য দিকে ক্লান্তি, আবার এ নিয়ে ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে সামঞ্জস্য করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আমরা চাইলে ঈদের বেশ কিছু বাজার রমজানের আগেই সেরে ফেলতে পারি। এতে রমজানে কেনাকাটার ঝক্কিঝামেলা থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। আর যেসব পণ্য রমজানেই কিনতে হবে, সে ক্ষেত্রে দিনের যে সময়টাতে ভিড় কম থাকে বা আমাদের শরীর-মন ক্লান্ত হওয়ার আগেই বাজারের ঝামেলা সেরে ফেলতে পারি।
রমজানে ব্যক্তিগণ মান বৃদ্ধি: আমরা কেউই চাই না দোজখের আগুনে একটি মুহ‚র্তও জ্বলতে। কিন্তু ‘মানুষ’ হিসেবেই আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়েছে এবং প্রতিনিয়তই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, অনেক ভুলত্রæটির মুখোমুখি হই। প্রতি বছরই রমজান মাস আমাদের কাছে এসে কড়া নেড়ে জানতে চায়, কে আছে আমাদের মাঝে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবো। পেতে চাইব স্বয়ং আল্লাহর দেয়া নিরাপত্তা। কে আছে আল্লাহর আরো কাছে যেতে ইচ্ছুক? কে আছে, দ্বীনকে আরো ভালোভাবে বুঝতে ইচ্ছুক? রমজান আমাদের জন্য সে সুযোগটিই নিয়ে আসে, যাতে আমরা এই মাসের শৃঙ্খলিত নিয়মে আবিষ্ট হয়ে সারা বছর আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকতে পারি। অর্জন করার চেষ্টা করতে পারি সারা জীবনের জন্য অন্তত একটি ভালো গুণকে গ্রহণ করা, চর্চা করা ও নিজের মধ্যে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্য। তা হতে পারে অন্যকে ক্ষমা করে দেয়ার মতো গুণ কিংবা অপরকে সহযোগিতা করা, রাগ না করা, মিথ্যা না বলা, ঘৃণা না করা, কাউকেও অবজ্ঞা না করা, হিংসা না করা, নিয়মানুবর্তী হওয়া, দানশীলতা অর্জন করা ইত্যাদি। এই রমজানই হতে পারে কারো পরিবর্তনের প্রথম সূর্যোদয়।
আমাদের অনেকের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এণই দূরে দূরে আছেন, যে তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। এই রমজানকে উপলক্ষ করে, তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে কুরআনের বার্তা দেয়া যেতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী ও অমুসলিম বন্ধুবান্ধবদেরও যেন আমরা ভুলে না যাই। তাদের সামনে সত্যের বাণী তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। ইদানীং আমরা আমাদের ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপের প্রতি এত বেশি ঝুঁকে থাকি যে, আমাদের কাছের মানুষদের পর্যাপ্ত সময় দেয়ারও খেয়াল থাকে না। রমজান মাসে পানাহার থেকে রোজা রাখার পাশাপাশি, ফোন-ট্যাব-গেজেটগুলো থেকেও বিরত থাকার অভ্যাস করি। এতে আমাদের সময়ের যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি চোখ ও মনের ওপর বৈদ্যুতিক ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাস করতে পারি।

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন