এখন নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল : নেই সমন্বিত উদ্যোগ
মহসিন রাজু : সময়পোযোগি পদক্ষেপের অভাব, নদী ভাঙনের চেয়ে বন্যাকে গুরুত্ব দিয়ে স্বল্পমেয়াদের বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করায় নদী ভাঙনের মারাত্মক ও সুদুর প্রসারী ধংসাত্মক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির সবকিছু। বদলে যাচ্ছে এলাকার মানচিত্র। নদীর বাঁধ, রেলস্টেশন, শহর ও নগরের ফুটপাথ ও বস্তি ভরে উঠছে বাস্তুহারা মানুষে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সমীক্ষার তথ্যানুযায়ি গত ৪৭ বছরে দেশের প্রায় দুই হাজার বর্গ কিঃ মিঃ এলাকার বাড়ি ঘর, স্থাপনা ও ফসলি জমি ভাঙনের কারণে বিলিন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। এতে বাস্তুহারা হয়েছে ৪০ লাখ মানুষ ! পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ একাধিক দেশীয় ও আন্তর্জার্তিক সংস্থার সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নদী ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতিবছরই গড়ে কমপক্ষে ২৫ হাজার একর জমি বিলিন হচ্ছে নদীগর্ভে। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশ ভুখন্ডের ২ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ জমি ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে নদীগর্ভে। প্রত্যেক বছরের নদী ভাঙনের যে সার্বিক ক্ষতি হয় আর্থিক বিচারে তার মুল্য ধরা হয়েছে ৫শ ’কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে গৃহহারা হয়েছে ৪০ লাখ মানুষ। সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে নদী ভাঙনের বিষয়টি তেমন কোন গুরুত্ব না পেলেও ‘ ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেল অব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট (আইএফআরসিএস) এর দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান ‘বব ম্যাকরো’ ২০১৫ সালে তার একটি বক্তব্যে বাংলাদেশের নদী ভাঙনের ভয়াবহতার চিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে এক ‘¯েøা, সাইলেন্ট, ডিজাস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ ও ইউএস আইডির ’ পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৮০ ভাগই তিস্তা, যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত। এই বৃহৎ নদী ও এর শাখাগুলোর মোট তট রেখার দৈর্ঘ্য ২৪ হাজার কিঃ মিঃ। এর মধ্যে আবার ১২ হাজার কিঃ মিঃ অংশই ভাঙন প্রবন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট পার্টনারশিপ (বিডিপিসি) এক জরীপে বলা হয়েছে, ‘কেবল ১৯৯২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নদী ভাঙনের কবলে পড়ে দেশের ৫১টি জেলার ৫ লাখ ৫০ হাজার ২শ’ ৭০ একর জমি বিলিন হয়ে গেছে। অন্য এক জরিপে বলা হয়েছে ৭২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৭৭টি বড় বড় নদী ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র উল্লেখ করে তাদের এক সমিক্ষা পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, ‘নদী ভাঙনের সমস্যাটি সারা দেশের হলেও উত্তরাঞ্চলেই এর প্রবনতা বেশি। বেশি ভাঙনের সমস্যা কবলিত জেলাগুলো হল উত্তরের কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, বগুড়ার অংশবিশেষ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ভাঙনের ভয়াবহতার কারণে পদ্মা নদীর নাম কীর্তিনাশা, সর্বনাশা হিসেবেও সাহিত্যে ও গানে উল্লেখ পাওয়া যায়। যমুনা ও তিস্তা ও ভাঙনের জন্য নদী তীরবর্তি মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে চিত্রিত হয়ে আছে। পাউবো, বিশ্বব্যাংক ও ইউএসআইডির এক যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ‘নদী ভাঙনে প্রতিবছর ২৫ হাজার একর জমি বিলিন হয়ে গেলেও এর বিপরীতে চর জাগে মাত্র আড়াই হাজার একর। যা শতকরা হিসেবে এক দশমাংস মাত্র। ভাঙন প্রবন নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক নদীর নাম যমুনা। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছে আন প্রেডিকটেবল। যমুনা যে কবে কোথায় কখন ভাঙবে গ্রাস করবে জমি জমা ঘরবাড়ি মসজিদ মাদরাসা তা’ এই খেয়ালী যমুনা ছাড়া আর কেউ বলতে পারেনা।
যুগ যুগ ধরে চলা নদী ভাঙনের শিকার আনুমানিক ৪০ লাখ মানুষের শতকরা ৭০ ভাগই বৃহত্তর রংপুর ও পূর্ব বগুড়া ও পাবনা এবং সিরাজগঞ্জের মানুষ। রাজধানী ঢাকায় ছিন্নমূল ও বস্তিবাসী যে মানুষরা বসবাস করে তারা অধিকাংশই নদী ভাঙা ও উত্তরাঞ্চলের অধিবাসি। যাদের জীবন জীবীকা সম্পূর্ণ শ্রম নির্ভর ও অনিশ্চিত। তবে এই সব নদী ভাঙা মানুষের জীবীকার নিশ্চয়তা ও জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোন সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ চোখে পড়েনা। সেই বৃটিশ শাসনামলের নদী সিকস্তি পয়স্তি আইনের বাস্তব সম্মত পরিবর্তন বা রুপান্তর না হওয়ায় জেগে ওঠা চরে পুনর্বাসিত হতে পারেনা নদী ভাঙা মানুষেরা। চরের দখল নেয় লাঠিয়াল বাহিনী ও তাদের পৃষ্টপোষকরা। চরজীবীকায়নসহ বিভিন্ন বিদেশী অনুদান নির্ভর কিছু কর্মসূচি নেয়া হলেও চরে এখনও জোর যার মুল্লুক তার নীতি কার্যকর থাকায় শেষ পর্যন্ত লাঠিয়াল বাহিনীর পৃষ্টপোষকরাই এতে লাভবান হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থা মন্ত্রনালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিলম্বে হলেও ১৯৯৩ সালের জুনে বন্যার মত নদী ভাঙনকেও প্রকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সূত্র জানিয়ে গত ৩০ বছরে নদী ভাঙন রোধ ও নদী তীরবর্তি কয়েকটি শহর রক্ষায় কয়েকটি প্রকল্পে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এছাড়া সেচ প্রকল্প, উপকূলীয় বাঁধ, ভেড়িবাঁধ ও ¯øুইস গেটসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে এই ব্যয় প্রয়োজন না মিটিয়ে প্রকৃত পক্ষে অর্থ যোগানদাতা ও দুর্গত মানুষের জন্য তা’ গলার ঘ্যাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান পর্যবেক্ষকরা। তারা আরো জানিয়েছেন, বিদ্যমান অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে নদী ও নদী অববাহিকা ব্যবস্থাপনায় ভুক্তভোগী জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে। অন্যথায় বছরের পরবছর ধরে চলা এই নদী ভাঙনে গৃহহীন, বাস্তুচ্যুত মানুষের মিছিল বাড়তেই থাকবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন