সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খোশ আমদেদ পবিত্র মাহে রমজান আমাদের সিয়াম সাধনা সার্থক হোক

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ১৭ মে, ২০১৮

বছরের পালা ঘুরে পুনরায় আমাদের দ্বারে এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। সিয়ামে রমজান ইসলামের পাঁচ বুনিয়াদী ইবাদতের অন্যতম। এই মাসে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা দিন পানাহারসহ সমস্ত বৈধ ভোগ থেকেও বিরত থেকে সংযম-সাধনার অসাধারণ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় আমাদের। অনেকের ধারণা সারা দিন নিজেদের পানাহার থেকে বিরত রাখার নামই বুঝি সওম বা রোজা। এ ধারণা সঠিক নয়। নিষিদ্ধ প্রতিটি কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার সাধনাই সিয়াম সাধনা।
তাই রোজা রেখে মিথ্যা, পরনিন্দা বা গীবত প্রভৃতি নিষিদ্ধ কাজে অংশগ্রহণ করলেও রোজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। প্রকৃত পক্ষে মানুষের জীবনকে সুন্দর, পবিত্র এবং সর্ব প্রকারে ত্রæটিমুক্ত করে তুলতে সিয়ামে রমজান এক অনন্য ইবাদত। বিশেষ করে এই ইবাদত পালনকারী সময়ের দৈর্ঘ্য একে এক অসাধারণ গুরুত্ব দান করে। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সালাত বা নামাজের সঙ্গে তুলনা করলে সিয়ামের গুরুত্ব উপলব্ধি করা সহজ হয়। সালাত বা নামাজের দীর্ঘতম চার রাকাত নামাজ আদায় করতে যেখানে কয়েক মিনেটের বেশী সময় লাগে না, সেখানে একটি সওম বা রোজা আদায় করতে দেশও কাল ভেদে সাধারণত ষোল-সতর ঘণ্টাও লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময় যদি প্রতিদিন সুবেহে সাদেক থেকে সূর্যান্ত পর্যন্ত পানাহারসহ অনেকগুলো ভোগ লালসার কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা যায় এবং এরকম যদি পুরো একটি মাস পালন করা যায়, তবে তার সুপ্রভাব বাস্তব জীবনে পড়তে বাধ্য।
অবশ্য আমরা যারা সাধারণত রোজা রাখি, তার কতজন সত্যিকার রোজা বা সওম পালন করতে পারি। তা নিয়েও প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কারণ রোজার দিনে লোক দেখানো পানাহার বর্জন করে চললেও আমরা মিথ্যা, পরনিন্দা, লোভ-লালসা থেকে মুক্ত রাখতে পারি না। পারি যে না তার বড় প্রমাণ রমজানের মাস এগিয়ে এলেই রমজান মাসে যেসব পণ্যের বেশী প্রয়োজন হয় সে সবের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া আমাদের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর স্থায়ী বদভ্যাস। তাই আমাদের দেশে রোজার মাস এলেই যেসব পণ্যের বেশী ব্যবহার হয়, সে সবের মূল্য বহুগুণে বেড়ে যায়, যা একটি মুসলিম-প্রধান দেশে অতীব দু:খজনক।
রোজাদার ব্যক্তির ইফতার করানো একটা পুণ্যের কাজ। কিন্তু এই কাজের মধ্যে যদি লোক দেখানোর প্রবণতা ঢুকে যায়, তাহলে এটার মধ্যেই পুণ্যের বদলে পাপ হতে পারে, একথা আমাদের অনেকেরই মনে থাকে না। আমাদের দেশের কোন কোন অঞ্চলে ইফতার করানো হয়ে থাকে লোক-দেখানোর উদ্দেশ্যে। রোজার মাসে দান-খয়রাত এবং জাকাত ইত্যাদি দেয়া অধিক পুণ্যের কাজ। কিন্তু ইফতার খাওয়ানো বা দান খয়রাত ও জাকাত দেয়ার মধ্যে যদি লোক-দেখানোর উদ্দেশ্য ঢুকে যায়, তাহলে তা হয়ে পড়ে রিয়া, যা একটি মহাপাপ। রিয়াকে মহাপাপ বিবেচনা করা হয় এই কারণে যে সমস্ত ইবাদতের মূল লক্ষ্য আল্লাহতায়ালা, তাঁকে লক্ষ্য করেই সকল ইবাদত। অথচ রিয়াতে আল্লাহ ইবাদতের মূল লক্ষ্য নন, মানুষকে দেখানোর জন্যই যদি নামাজ-রোজা করা হয় তাহলে সেসব ইবাদতের আসল লক্ষ্য হয়ে পড়ে মানুষ। সেক্ষেত্রে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা থাকে না বলে তা আর আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হয় না। তা হয়ে পড়ে লোক-দেখানো ইবাদত তথা রিয়া নামক মহাপাপ।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম মুসলিম-প্রধান দেশ। পবিত্র রমজান মাসে এখানে সিয়ামে রমজানের সুপ্রভাবে ইসলামের চর্চা বেশী বেশী বেড়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু রমজান মাস এলেই যদি যেসব পণ্য রজমান মাসে বেশী বেশী প্রয়োজন পড়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর লোভের কারণে যদি ঐসব পণ্যের দাম অত্যধিক বেড়ে যায় তা প্রকারান্তরে ঐসব ব্যবসায়ী রোজাদারদের উপর অর্থনৈতিক জুলুমই করলেন এবং তার মাধ্যম পাপাচারেই সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করলেন। এটা নিশ্চয়ই একটি মুসলিম- প্রধান দেশ হিসাবে আমাদের গৌরবের কথা নয়।
সুতরাং এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ী পবিত্র রমজান মাস এলেই বাড়তি আয়ের লোভে মেতে ওঠেন, তা তাদের পবিত্র রমজানের প্রতি অবমাননা প্রদর্শনেরই শামিল। অথচ পবিত্র রমজান মাসের উচ্চ মর্যাদা বিবেচনায় এর বিপরীতটাই হওয়া উচিৎ ছিল।
পবিত্র মাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শুধু রমজান মাসে বিভিন্ন পণ্যের অর্থনৈতিক মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বললেই চলবে না। পবিত্র রমজান সংযম শিক্ষা ও সংযম সাধনার মাস। পবিত্র কোরআনে রমজানের সিয়াম সাধনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কুতিবা আলায়কুমুস্ সিয়ামো কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লাআল্লাকুম তাত্তাকুন’। অর্থাৎ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত এ তাকওয়া শব্দের অর্থ কি? এ সম্পর্কে বলা হয়েছে মানুষ যখন কন্টক যুক্ত পথ দিয়ে চলে তখন যেমন সাবধানতা অবলম্বন করে চলে সেভাবে জীবন পথে ইসলামের আলোকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলার নামই তাকওয়া। প্রকৃত পক্ষে মানুষের জীবনে ভাল-মন্দ সুখ-দু:খ সম্পদ-আপদ এসব লেগেই থাকে। মানুষ যাতে এসবের মধ্যে অন্যায় ও দুর্ভাগ্য এড়িয়ে আল্লাহর পথে ন্যায় ও কল্যানের পথে চলতে পারে সে লক্ষ্যে সাবধানতা সহকারে পথ চলতে চেষ্টা করাই তাকওয়া। মানুষ যদি আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক পথ চলে, তাহলে তার পক্ষে সুপথ প্রাপ্তি সম্ভব হবে। নইলে দুর্ভাগ্যই হবে তার গতি।
‘পবিত্র কোরআনে সূরা ফাতিহার প্রার্থনাংশে প্রার্থনা জানিয়ে বলা হয়েছে :’ ইহদিনাছিরাতাল মুস্তাকিম, সিরাতাল্লাজিনা আনআমতা আ’লাইহিম, গাইরিল মাগদুবে আলাইহিম অলাদ্দালিন। হে আল্লাহ আমাদেরকে সহজ সরল প্রদর্শন করো, তাদের পথ, যাদের উপর তুমি নিয়ামত দান করেছ; তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত এবং যারা বিভ্রান্ত।
সূরা ফাতিহার এই প্রার্থনার জবাবেই পরর্বতী সূরা আল বাকারার শুরুতেই বলা হয়েছে: এই সেই কিতাব যার সম্বন্ধে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, যারা সাবধান (মুত্তাকিন) তাদের জন্য পথ-প্রদর্শক (এই কিতাব)। পবিত্র রমজান মাসের ঐতিহাসিক গুরুত্বও অসাধারণ। কারণ এই মাসেই বিশ্ব-মানবতার চিরন্তন হেদায়েতর বাণী-সম্বলিত পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)-এর উপরে, যার কার্যকরতা দুনিয়ার শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকবে। রমজান মাসকে আমরা যদি যথাযথ মর্যাদা দিতে চাই তাহলে আমাদের শুধু রোজা রাখলেই চলবে না। রোজা রাখার পাশাপাশি পবিত্র রমজান মাসে অবতীণ এই মহা পবিত্র গ্রন্থকে বেশী বেশী তেলাওত, অর্থ-সহ এর অধ্যয়ণ এবং বাস্তব জীবন ও সমাজে এর মহান শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দান করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সিয়ামে রমজানের পবিত্র শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমে আমাদের সমাজ জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করে তুলতে হবে।
রোজার মাসে আর্থিক লোভ-লালসা ত্যাগ করতে না পারা মাহে রমজানের অবমাননারই শামিল। মিথ্যা, গীবত, চোগলখুরি প্রভৃতি পাপ পরিত্যাগের পাশাপাশি পবিত্র রমজানে মুনাফাখোরী চোরাচালানী প্রভৃতি বর্জনের মাধ্যমে আমরা যদি নিজেদের পাপমুক্ত করতে না পারি, তাহলে আমাদের রোজাও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এর পাশাপাশি গীবত, পরনিন্দাসহ সকল পাপাচার বন্ধ করতে না পারলে আমাদের রোজার দিনে পানাহার বর্জনই সার হবে। রোজা রেখে পরনিন্দারত এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে রসুলুল্লাহ (সা:) বলে ছিলেন, তার ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট পাওয়া অর্থহীন হয়ে পড়ছে।
সুতরাং বাহ্যিকভাবে রোজা রাখলেও আমাদের অনেকের রোজা যে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, সে বিষয়ে আমাদের কঠোরভাবে লক্ষ্য রেখে সিয়াম সাধনাকে যে কোনো মূল্য সার্থক করে তুলতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
গনতন্ত্র ১৭ মে, ২০১৮, ২:৪২ এএম says : 0
জনগন বলছেন, “ ইবাদত – ২০১৮ “ রোজা মাসে ডাকছি তোমায় আমি অধম গোনাহগার, নবীজির শাফায়ৎতের ভাগ্য কালহাশরে হয় যেন আমার ৷ নবীজির সুন্নত পালন করে কালেমা পড়েছি নামে তোমার, সেই উছিলায় করিও আমায় হাশরে পুলসেরাত পার ৷ শয়তানের ছলনা প্রত্যাখান করে যতটুকু পেরেছি বন্দেগী করেছি তোমার, নবীজির উছিলায় সকল গোনাহ মাফ করে জান্নাতীদের কাতারে স্হান দিয়ো আমার ৷ ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছি মনে ভয় ছিল তোমার, তোমাকে দেখার আশায় প্রভু এই সামান্য ইবাদত আমার ৷
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন