শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন ও সহিংসতা বন্ধে গণতন্ত্র আবশ্যক

প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. আব্দুল হাই তালুকদার
ছেলের জন্য বউ দেখতে বাবা, চাচা, মামা প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ গেছেন। গ্রামের মাতবরের মেয়ে। মেয়েটি বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী। পাকশাক থেকে শুরু করে সেলাই-ফোঁড়া সব কাজেই মেয়েটি দক্ষ। শিক্ষিত ছেলের জন্য বাবার খুব প্রত্যাশাÑ সকল বিষয়ে পারদর্শী বৌমা চাই। ছেলের অভিভাবকরা মেয়েকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে খুশী। শেষে মামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলত মা মাছের মধ্যে কোনটি সুস্বাদু ও লোভনীয়’? মেয়েটি উত্তর দিল, ‘মাছের স্বাদ মাছের উপর নির্ভর করে না, মাছ রান্নার উপর নির্ভর করে।’ গল্পটি বলার উদ্দেশ্য হলো কোন কাজের ভালো-মন্দ নির্ভর করে কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করার উপর। দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে সবকিছু থাকার পরেও কাজটি সুসম্পন্ন হতে পারে না। শিক্ষাদীক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যক্তিকে দক্ষ করে তোলে। সে কারণে প্রশিক্ষণের উপর এত গুরুত্ব দেয়া হয়। একজন সাধারণ শিক্ষক ও একজন উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, একজন সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তার ও একজন উচ্চতর ডিগ্রিধারী ডাক্তার দুজনের মধ্যে বিস্তর তফাত। আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ও ডাক্তারকে গুরুত্ব দেই। কারণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক বা ডাক্তারের কাছ থেকে অনেক ভালো সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। অ্যারিস্টটল বলেছেন ‘বীজের মধ্যে সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। সব বীজের সমানভাবে অংকুরোদগম ঘটে না’। সকলকে দিয়ে সব কাজ সুসম্পন্ন করা যায় না, তাই আমরা মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করি। অদক্ষ, অযোগ্য ও মেধাহীন প্রার্থীকে বাদ দিয়ে আমরা অধিকতর যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী প্রার্থী নির্বাচন করি। মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা প্রভৃতি গুণাবলী সমৃদ্ধ প্রার্থীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে। বিশ্বের সর্বত্রয় গুণকে গুরুত্ব ও গুণহীনকে গুরুত্বহীন মনে করা হয়। তাই বলে যারা কম যোগ্য ও দক্ষ তারা কি বেকার থাকবে? অবশ্যই না। যে যে কাজের উপযুক্ত তাকে সেই কাজে লাগাতে হবে। ভালো ফল পেতে হলে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে আবশ্যক হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় যে কোন শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য বা প্রতিষ্ঠানের উত্তোরোত্তর সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটে। ছোট একটি শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুযোগ্য ও দক্ষ ব্যবস্থাপনায় অল্প সময়ে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। অধিক মূলধন খাটিয়ে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যবস্থাপনায় সুফল পাওয়া যায় না। অতি অল্প সময়ে ব্যবসা লাটে ওঠে। বাংলাদেশে অদক্ষ, অযোগ্য ও নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ বড় বড় সমস্যা সংকটকে ত্বরান্বিত করছে।
বাংলাদেশে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও দলীয়করণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। টাকা হলে এ দেশে সবকিছু সম্ভব। অযোগ্য, অপদার্থ ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের সর্বত্রয় জেঁকে বসেছে। দলীয়করণ ও দুর্নীতি করে দেশ আজ রসাতলে যেতে বসেছে। প্রশাসন, আইন, বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বখাতে দুর্নীতির বিস্তার দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায় ‘দেশ এখন বাজিকরদের দখলে’। অর্থাৎ নিয়ম, শৃঙ্খলা নাই বললেই চলে। সর্বত্রই জোর যার মুল্লুক তার নীতি দেশে আজ চলমান। শাসকদলের দৌরাত্ম্য ও আত্মম্ভরিতা এতটা সীমাহীন হয়েছে যে, বিচারালয়কে পর্যন্ত ‘আক্রমণ করা হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিগণ একত্রিত হয়ে স্যুয়োমুটো জারি করতে বাধ্য হয়েছেন। দুজন মন্ত্রী যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন এটি বিচার বিভাগের প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপের শামিল। প্রধান বিচারপতি মন্ত্রীদের ক্ষমা করতে পারেননি। তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বিচার বিভাগ সরকারের অঙ্গ সংগঠন নয়। তিনি মন্ত্রীদের ফৌজদারী মামলার আসামী ডাকাতের মতো বলেছেন। অতঃপর নিঃশর্ত ক্ষমা মঞ্জুর না করে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ দুই মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে ৭ দিনের জেলের আদেশ দিয়েছেন। আমাদের কথা হলো মন্ত্রীমহোদয়দের কথাবার্তা ও আচরণে বিচার বিভাগ খুবই রুষ্ট হয়েছেন। দুই মন্ত্রীর কর্মকা-কে ডাকাতের কর্মকা-ের সাথে তুলনা করায় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। এরকম লুটপাট, ডাকাতি, দুর্নীতি, দুঃশাসন, দখল বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভূমি দখল, প্রভৃতি অবৈধ ও অনৈতিক কাজ জোরেশোরে চলছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুটপাটের আখড়া বানানো হয়েছে। শেয়ারবাজার লুট, সোনালী ব্যাংক, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লা গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক লুট প্রভৃতি বড় বড় লুটপাট দেশের আর্থিক খাতকে ফোকলা করে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার ও বিনিয়োগ দেশের মানুষকে হতাশ ও উদ্বিগ্ন করছে। উন্নয়নের ঢাকঢোল পেটানোর সাথে আর্থিক খাতে দুর্বৃত্তায়ন চলছে অবলীলায়। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনা দেশের মানুষের সাথে বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ভেদ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি নজিরবিহীন ঘটনা। অর্থমন্ত্রীর ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না বক্তব্যের মধ্যে শেয়ারবাজার কেলেংকারি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সুশাসন বলতে কিছু নেই। অপশাসন ও কুশাসন সর্বক্ষেত্রে দৃশ্যমান। দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। বাংলাদেশ সর্বগ্রাহী সংকটে পড়ে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। কুইক রেন্টালের নামে মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে। ভূমি রেজিস্ট্রি ফি ৫ গুণ ১০ গুণ বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার সচল রাখার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। রেলের ভাড়া বৃদ্ধি মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। কোন খাতে সেবার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কেবল জনগণের উপর ট্যাক্স চাপানো হচ্ছে। উন্নয়নের ঢাকঢোল জোরেশোরে পেটানো হলেও প্রকৃত উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ছে। ড. আকবর আলী খানের মতে, দেশের ৮০% লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে।
দেশের উন্নতি যেটুকু হচ্ছে তা একটি বিশেষ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শনৈ শনৈ করে একশ্রেণীর লোকের সম্পদ বৃদ্ধি দেখে বলতে ইচ্ছা করে ধরিত্রী দ্বিধা হও। আর্থিক খাত, সেবা খাত, শিক্ষা সংস্কৃতি, আইন-আদালত সর্বক্ষেত্রে সুশাসনের প্রচ- অভাব। ঘরে-বাইরে কোথাও জীবনের নিরাপত্তা নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু ও নিরুপদ্রবে জীবন যাপন কোনটিই সম্ভব নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি গোটা সমাজকে অনাচার, অবিচার, অত্যাচার, নির্যাতন, জখম, গুম-খুনের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক ও নির্যাতনের কাহিনী লোকের মুখে মুখে। বিচারবহির্ভূত হত্যা অবলীলায় চলছে। রাস্তাঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল সর্বত্র লাশের মিছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, সাগার-রুনী হত্যা, ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলম গুম হওয়া, প্রভৃতি ঘটনা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার করুণ অবস্থার নিদর্শন। দেশের সর্বগ্রাহী সংকট ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক বলে দাবি করেন তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। অনির্বাচিত সরকার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সর্বাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপকর্মকে উপেক্ষা করে তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সরকার। জনগণের টাকায় পরিচালিত বাহিনী জনগণের ওপর যেন প্রতিশোধ নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে একটি বিশেষ দলের পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ইউপি নির্বাচনে শত শত চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া দেখে তামাশা ও কলংকিত নির্বাচন বলা ছাড়া কোন উপায়। প্রথম ধাপের নির্বাচন নামক তামাশা দেখে সুজন একে বিকৃত নির্বাচন বলে আগামী ধাপগুলোর নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ কখনোই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে দেখেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সরকারি লাঠিয়াল বাহিনী  অন্যান্য দল বিশেষত বিএনপি প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। মামলা হামলার ভয়-ভীতি প্রদর্শন, জীবন ও সম্পদ হানির ভয়, প্রার্থীর নিজের জীবন এমনকি পরিবারের সদস্যদের উপর আক্রমণের হুমকি-ধমকি বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। জয়পুরহাট বিএনপির ঘাঁটি বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। সেখানে বিএনপির প্রার্থীর অভাবে ৯টি ইউপির ৬টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কতটা নিচে নেমে গেছে ভাবনার বিষয়। গোটা দেশের অবস্থা প্রায় জয়পুরহাটের মতো। জীবন ও সম্পদ হানির সাথে মানসম্মান, নির্যাতন ও নিপীড়নের ভয়ে বিএনপি প্রার্থীরা মাঠ ছেড়ে দিচ্ছে।
সমতল মাঠ না হওয়ায় বিরোধী দল অনেক জায়গায় মাঠে নামতে পারছে না। সরকারের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী বিরোধী দলের প্রার্থীদের অনেক জায়গায় নমিনেশন পেপার জমা দিতে দিচ্ছে না। নির্বাচন কমিশন বেকায়দায় পড়ে অনেক নির্বাচন স্থগিত করছে। সম্প্রতি রাঙ্গামাটিতে নমিনেশন পেপার জমা দিতে না পারায় নির্বাচন কমিশন সেখানকার ৪৯টি ইউপি নির্বাচন স্থগিত করেছে। ষষ্ঠ ধাপে ঐসব ইউপি নির্বাচন হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব এখন প্রকাশ্য গোপনীয়তা। সরকারি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করায় অনেক পুলিশ অফিসারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে কোন কিছুই গোপন থাকছে না। প্রকাশ্যে এমনভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হচ্ছে যে, মানুষ নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আমি অনেকবার বলেছি, বেনামি আসামির তালিকা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত ও প্রহসনে পরিণত করবে। হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি উপক্ষো করে কেউ প্রার্থী হতে চাইলে তার বিরুদ্ধে মামলার খড়গ অবধারিত। ২৪ মার্চের একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ‘পাঁচবিবিতে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধর’। পাঁচবিবি (জয়পুরহাট) সংবাদদাতা বলছেন, ‘জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বাগজানা ইউনিয়ন পরিষদের বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী নাজমুল ইসলামকে মারধর করেছে আওয়ামী লীগ কর্মীরা। ২২ তারিখ (মঙ্গলবার) বিকালে উপজেলা চত্বরে ঘটনাটি ঘটে। নাজমুল ইসলাম উপজেলা চত্বরে গেলে শিমুলতলী গ্রামের মামুনুর রশীদসহ ৪ জন তাকে ঘিরে ধরে। এ সময় মামুন তাকে কিল-ঘুষি ও চড়-থাপ্পড় মারে।’ তারা নাজমুল ইসলামের কাছ থেকে নমিনেশন পেপার চায়। তারা নাজমুলকে বলে ‘তুই কার হুকুমে প্রার্থী হয়েছিস। তোর বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা দেওয়া হবে... ইত্যাদি’। মামলা-হামলার ভয়ে বিএনপি প্রার্থীরা মাঠ ছেড়ে দিয়ে নিরাপদে থাকছে যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে খুবই দুঃখজনক ও হতাশাজনক। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। তারা প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।
তাছাড়া নির্বাচনের দিন প্রভাব বিস্তার, ভোট জালিয়াতি, গণহারে সিল মারা, বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্বাচনের আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরাট করা, প্রশাসনের লোকজন ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন দলীয় কর্মীর মতো কাজ করছে। এগুলো প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ জানতে পারছে। বালির মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলে যেমন প্রলয় বন্ধ হয় না, তেমনি প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতির কথা গোপন রাখা যাচ্ছে না। মানুষ নিজের চোখ-কানকে অবিশ্বাস করতে পারছে না। জাতীয় সংসদ, সিটি, পৌরসভা প্রভৃতি নির্বাচনে অনিয়ম ও জালিয়াতি দেখে দেশ-বিদেশের মানুষ হতাশ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সকলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংলাপের আহ্বান জানাতে থাকেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার একটি সুষ্ঠু পদ্ধতি উদ্ভাবনের তাগিদ দিতে থাকেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন ২৩ আগস্ট ২০১৩ দুই নেত্রীকে টেলিফোন সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান জানান। উদ্যোগ না দেখে তিনি ৩১ সেপ্টেম্বর ’১৩ একটি বিবৃতি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তিনি দুনেত্রীকে পত্র দিয়ে আবার সংলাপের তাগিদ দেওয়া হয়। জাতিসংঘ, ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি ক্ষমতাধর সংস্থা ও রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ও সংলাপের তাগিদ দিতে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থবহ নির্বাচন চায়। দেশের ৯০% মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রত্যাশা করে। শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ৬ ডিসেম্বর ’১৩ ঢাকা আসেন। তিনি দফায় দফায় বৈঠক করে সরকারি ও বিরোধী দলকে সংলাপের টেবিলে বসাতে সক্ষম হলেও সরকারি দলের অনমনীয় ও একগুঁয়েমি মনোভাবের কারণে ফলাফল ছাড়াই তিনি ১১ তারিখে ঢাকা ত্যাগ করেন। মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব। তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের উৎস, কারণ, সরকারী দলের অনিচ্ছা প্রভৃতি অবগত হয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। তারানকোর সফরের শেষ দিন মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করেন। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সহিংসতা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রত্যাশা করেন।
সরকার সংলাপ আয়োজনে আন্তরিকতার পরিচয় না দিয়ে ৫ জানুয়ারি (২০১৪) একদলীয়, একপক্ষীয়, অংশগ্রহণহীন, ভোটারবিহীন এক তামাশার নির্বাচন সেরে ফেলে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া গঠিত সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালো চোখে দেখেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জিএসপি সুবিধা বাতিল করে নানারকম শর্তাবদ্ধ করে। সরকার অধিকাংশ শর্ত পূরণ করলেও রাজনৈতিক কারণে জিএসপি সুবিধা ফেরত দেয়নি। ব্রিটিশ সরকার পণ্যবাহী কার্গো বিমানের ব্রিটেনে সরাসরি গমন বন্ধ করে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা উন্নয়নমূলক কর্মকা- থেকে অর্থছাড় না করে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ইইউ পার্লামেন্টের এশিয়া বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান জাঁ লাম্বাটের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল ১০-১২ ফেব্রুয়ারি ’১৬ তিন দিন সফর করে সংবাদ সম্মেলনে বলেন- ১. গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পথ জরুরি, ২. নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এবং ৩. সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাসহ প্রভৃতি বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, শ্রমমানের অগ্রগতি, ব্লগার হত্যা, মুক্তমনা লেখক হত্যা, সাংবাদিক নিরাপত্তা ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন। মোদ্দা কথা তারা বাংলাদেশী নাড়ি-নক্ষত্র অবগত আছেন। সূচনা বক্তব্যে তারা মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নির্বাচনসহ সকল বিষয়ের ঐকমত্য প্রত্যাশা করে ফিরে গেছেন।
সরকারকে ভাবতে হবে বিশ্বায়নের এই যুগে একটি মাত্র দেশের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে চলবেন, না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে চলবেন। গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণতন্ত্রের সংকট, সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব, সাংবাদিক হয়রানি ও নির্যাতন, দুর্নীতি, দুঃশাসন আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি, নির্বাচনী ব্যবস্থায় চরম ধস প্রভৃতি কর্মকা-ে বীতশ্রদ্ধ। বাংলাদেশে সম্পর্কে তাদের মনোভাব নেতিবাচক। বাংলাদেশের কৌতুকপূর্ণ তামাশার নির্বাচন দেখে পশ্চিমা দুনিয়া নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। তারা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চান। এ লক্ষ্যে সরকারকে কার্যকর ও সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশ ক্রমান্বয়ে খারাপ অবস্থায় নিপতিত হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মকা-কে সন্ত্রাসী কর্মকা- বলে আর বেশি দিন চালানো সম্ভব হবে না। ব্রিটিশ পত্রিকা ইকনোমিস্টের পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্র প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৭ দেশের মধ্যে ৮৫তম। মনে রাখতে হবে, উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো গণতন্ত্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বলেন, ‘যারা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে অসম্ভব করে তোলে, তারা সহিংস বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে’।
আমরা প্রথমেই বলেছি, কাজের সাফল্য নির্ভর করে ব্যক্তির মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার ওপর। তবে কাজ করার জন্য স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব করার অধিকার আবশ্যক। লক্ষ রাখতে হবে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব চর্চার ক্ষেত্রে কর্তা যেন স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্বপরায়ণ না হন। ব্যক্তি যতই মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন হন না কেন তার পেছনে শক্তি ও সমর্থনের সাথে কর্তৃত্ব করার অধিকার থাকতে হবে। রাজনীতিতে সরকারের শক্তি, সমর্থন ও কর্তৃত্ব করার অধিকার দেবার মালিক হলো জনগণ। জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সরকারের ভীত, দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়। বাংলাদেশ সরকারকে তার ভিত শক্ত করার পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানাচ্ছি। শক্ত ভিতের ওপর সরকার দাঁড়াতে পারলে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনা সহজ হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে কোনো ষড়যন্ত্রই নস্যাৎ করতে পারবে না।
 লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন