দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বাস্তবতা এক চরম বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। পরিসংখ্যানের মানদন্ডে মানুষের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার কাছাকাছি থাকলেও একই সময়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার চিত্রও বেরিয়ে আসছে। গত এপ্রিল মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্যহ্রাসের হার ক্রমেই শ্লথ হয়ে পড়ছে। যেখানে ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাসের হার ছিল ১.৭ ভাগ সেখানে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যহ্রাসের হার ছিল ১.২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের জরিপে ২০১৬ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। ঢাকা শহরে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে আসে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে। সেখানে দেখা যায়, ২০১০ সালে শহুরে অতি দরিদ্র মানুষের হার ছিল ৭.৭ ভাগ, ২০১৬ সালে এসে তা’ ১২.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সামগ্রিক অর্থে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে গেলেও অতি দরিদ্র মানুষের হার বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রই প্রকট আকারে বেরিয়ে এসেছে। তা’ ছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের দাবীর সাথে বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশী থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোর মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যেন তেন প্রকারে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি দেখানোর মধ্যে অর্থনীতির সুষ্ঠু বিকাশের চারিত্র্যলক্ষণ ফুটে ওঠেনা। কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া অর্থনৈতিক বৈষম্য রোধ এবং দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়।
উত্তরের জেলাগুলোতে বিদ্যমান দারিদ্র্যের মূল কারণ হিসেবে কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং নদীভাঙ্গনের মত দুর্যোগকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। একটি দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত রিপোর্টে দেশের উত্তরের ৫ জেলায় গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ও শ্রেণীগত বৈষম্য বেশী। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির এলাকা কুড়িগ্রাম, দিনাজপুরে যেখানে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষই গরিব, সেখানে নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার ২. ৬ শতাংশ। উত্তরের জেলাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে যে নিরব দুর্ভিক্ষ চলছে তার স্থানীয় নাম মঙ্গা। উত্তরের জেলাগুলোতে বিদ্যমান মঙ্গা নিরসনে নানাবিধ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং মঙ্গা দূরীকরণে অনেকটাই সফলতার দাবী করছে সরকার। কোন বেসরকারী জরিপে নয়, খোদ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে প্রকাশিত রিপোর্টে সরকারের দাবীর বিপরীত চিত্রই ফুটে উঠেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর ও বান্দরবনের মত দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালে দরিদ্র মানুষের হার যথাক্রমে ৬৩.১শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০.৮ শতাংশ, ৩৭.৩ শতাংশ থেকে ৬৪.৪ শতাংশ এবং ৪০.১ শতাংশ থেকে ৬৩.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান অনুসারে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে দিন্জাপুর জেলায় গরিব মানুষের হার প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে,মঙ্গা নিরসন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বিশেষ উদোগগুলো তেমন সুফল দেয়নি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন প্রশ্নে বাস্তবতা ও সরকারের কথিত সাফল্য সম্পর্কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারী উদ্যোগগুলোর সাফল্য ও ব্যর্থতার যথাযথ মূল্যায়ন না হলে অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব। কৃষিভিত্তিক অঞ্চলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির পেছনে যে সব নিয়ামকগুলো সক্রিয় আছে সে সব বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো গবেষনা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত নদীভাঙ্গন, বিল ও হাওরের বাঁধ নির্মান ও রক্ষনাবেক্ষণের মত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে যে সব দুর্নীতি, অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে তার যথার্থ প্রতিকার ও নজরদারি এখনো নেই। কোটি কোটি কৃষক পরিবার দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রাণশক্তি। বাম্পার ফলনের পরও কৃষকের পুঁজি হারানো ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়েই গ্রামীন দারিদ্র্য বেড়ে চলেছে। নদীভাঙ্গনে নি:স্ব পরিবারগুলো মাথা গোঁজার আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের আশায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে ভীড় করে শহরে অতি দারিদ্যের হার বৃদ্ধিতে ভ’মিকা রাখছে। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যসহ অস্বাভাবিক হারে পণ্যমূল্যের স্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। নদীভাঙ্গন রোধ, পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের অন্য যে কোন উদ্যোগের চেয়ে বেশী ফলপ্রসু হতে পারে। নিত্যপণ্যের উপর মধ্যস্বত্বভোগিদের মুনাফাবাজি, কৃষকদের বঞ্চনা রোধে কার্যকর বিপণন ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। নদীভাঙ্গন রোধ, নদী ও হাওর ব্যবস্থাপনা এবং গ্রামীন কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জনে যুগোপযোগী মাস্টারপ্লান গ্রহণ করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন