টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে। দেশের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ছিল একটি ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস রচিত হয় বর্তমান সরকারের আমলেই। ২০১৩ সালে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম ২ টাকা ৩ পয়সা হ্রাস পাওয়ার অবিশ্বাস্য সাফল্যও অর্জিত হয়। কিন্তু তারপর আবারও শুরু হয়েছে ডলারের ঊর্ধ্বগতি। ২০১৩ সালের পর এ পর্যন্ত টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৬ টাকা। এ মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকারখানার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের খরচ যেমন বাড়াচ্ছে, তেমন আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তা ইন্ধন জোগাচ্ছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হওয়ায় যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ডলারের দাম বাড়ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার দুটি উৎসব একটি হলো রফতানি পণ্যের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ, অন্যটি বিদেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি কর্মজীবীর পাঠানো রেমিট্যান্স। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শ্রমবাজার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও বিদেশে বাংলাদেশের কর্মজীবীর সংখ্যা কমার বদলে বেড়েছে। অথচ সবাইকে তাজ্জব করে রেমিট্যান্স আয় সে অর্থে বাড়ছে না। হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীরা যে টাকা পাঠায় তা সরাসরি দেশে না আসায় দেশের অর্থনীতিতে তার সুফল অনুভূত হচ্ছে না। দুর্নীতিবাজদের অনেকে এ দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশে সম্পদের মালিক হচ্ছেন। অসৎ ব্যবসায়ীদের একটি অংশও বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রাসাদ গড়ে তুলছেন পাচারকৃত অর্থে। ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে।
এ প্রতিকূল অবস্থায় আমদানিকারকরা পড়েছেন বিপাকে। দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা মূলধনী পণ্য আমদানিতে ডলার সংকটে ভুগছেন। বেশি দামে ডলার কিনে তাদের পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তেজি মুদ্রা হিসেবে টাকা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল তা ক্ষুন্ন হচ্ছে। ডলার সংকটের অবসানে হুন্ডি ব্যবসার ওপর কুঠারাঘাত হানতে হবে। জঙ্গি ও মাদক সন্ত্রাসীদের মতো হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের কালো হাত ভাঙার উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থ পাচার একটি গুরুতর অপরাধ। এজন্য শাস্তির বিধান রেখে আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। তারপরও টাকা পাচারের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না কেন, এটি একটি প্রশ্ন বটে! উল্লিখিত চারটি মাধ্যম ছাড়াও বিদেশে টাকা পাচারে ইদানীং অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। অফশোর ব্যাংকিং হচ্ছে ব্যাংকের ভেতর আলাদাভাবে পরিচালিত একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং এর মাধ্যমে বিদেশী কোনো কোম্পানিকে ঋণ দেয়া ও বিদেশী উৎস থেকে আমানত সংগ্রহ করা। এ ব্যবস্থায় স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে লেনদেন হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হল, ব্যাংকের কোনো নিয়ম ও নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না, কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসাবে। এ ধরনের ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে, যা বলাই বাহুল্য। বস্তুত বিদেশে অর্থ পাচারের একটি বড় মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থা। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘পানামা পেপারস’ নামে অর্থ পাচারের যে ঘটনা ফাঁস হয়েছে, তা মূলত অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই ঘটেছে। পানামা পেপারসে সে সময় বাংলাদেশ থেকেও একই পন্থায় অর্থ পাচারের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল।
দেশ থেকে যদি এভাবে অর্থ পাচার হয়ে যায়, বিনিয়োগ না হয়, তবে উন্নয়নের কথা বলা অর্থহীন ও অবিশ্বাসযোগ্য বলে পরিগণিত হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছি, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেলে সে স্বপ্নপূরণ যে সুদূর পরাহত হয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। যে হারে অর্থ পাচার হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে দেশ ‘শূন্য ঝুড়িতে’ পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। একদিকে অর্থপাচার ঠেকাতে হবে, অন্যদিকে অর্থ বিনিয়োগের সুব্যবস্থাও করতে হবে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম কারণ বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ করে দেয়া। আমাদের দেশেও অর্থ পাচার ঠেকাতে নির্ভয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অবারিত এবং বিনিয়োগের পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। দেশের টাকা যাতে দেশে থাকে এ ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন