কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি বিস্ময়কর বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তার উত্থান। কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতীত সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, শব্দচয়ন এবং ছন্দের যে অপূর্ব গাঁথুনি ও আবহ সৃষ্টি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম ডিগ্রিধারীরাও তা দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। ভারতবর্ষের বাইরে অন্য কোনো জনপদে না গিয়েও তার লেখায় আন্তর্জাতিকতার এবং সার্বজনীনতার যে সুস্পষ্ট স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন, যা লিখেছেন তার যথার্থ পরিবেশ তৈরি করে, অপূর্ব সুর-মূর্ছনার সমগ্র পরিবেশকে যেভাবে আকর্ষণীয় করেছেন তার তুলনা নেই।
এক দরিদ্র ঘরের সন্তান কাজী নজরুল অর্থাভাবে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত এগিয়েও তিনি তা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হননি। তারপরও দেখা যায়, তার কবিতা এবং বিভিন্ন লেখায় যে সাংস্কৃতিক চেতনা এবং মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়েছে তা কোনো আধা শিক্ষিত ব্যক্তির নয়, নয় কোনা অপরিণত মনের মননশীলতা। বিশ্বের সাহিত্য ভান্ডারে এমন অনেক প্রথিতযশা কৃতী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাদের সম্পর্কে বিস্তৃত জানার সুযোগ নেই। তাদের পরিচিতি তাদের সৃষ্টিকর্মে। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারও ছিলেন এমনি এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তার জীবনের বৃহৎ অংশই রয়েছে রহস্যাবৃত। ছাত্রাবস্থা এবং তারপর এক যাত্রা পার্টি বা লেটু দলের সাথে তার কিছুদিনের সংস্রব ছাড়া কাজী নজরুল ইসলামের জীবন একটা খোলা বই-এর মতো। সব কিছুই দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। সবটাই প্রায় উন্মুক্ত। এ কারণেই এ প্রশ্ন প্রায় সকলকেই আচ্ছন্ন করে তোলে- কিভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় তিনি বাংলা ভাষায় এমন নিয়ন্ত্রণ লাভ করলেন? বাংলা কবিতা-কাব্যের উপযোগী এমন ছন্দের সাথে কিভাবে তিনি পরিচিত হলেন? কোন ওস্তাদের সাহচর্যে এবং দীক্ষায় তিনি ভারতীয় সনাতন সঙ্গীদের ধ্রুপদী তাল-লয়ের মহান ক্ষেত্রে কিভাবে ডুবে যেতে পারলেন? কেমন করে উর্দু এবং ফারসি শব্দভান্ডারের সন্ধান পেলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর কোনো নজরুল গবেষকের নিকট এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট হয়নি।
তার সমসাময়িক মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের সাথে তার সাহিত্যকর্মের তুলনা করলে আরো বিস্মিত হতে হয় এ জন্য যে, যেখানে তার সমকালীন মুসলিম লেখকরা নিজেদের সুনির্দিষ্ট গন্ডির বাইরে যেতে সক্ষম হননি সেক্ষেত্রে তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সমগ্র বিশ্ব চরাচরে। কোনো গন্ডির মধ্যে তার সৃজনশীল প্রতিভা সীমিত থাকেনি।
কবি জসীম উদদীনের কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, বহুদর্শী, বিশ্বের বিভিন্ন সমাজের সাথে পরিচিত, নগর জীবনের প্রতিটি আনাচে-কানাচের সাথে সংশ্লিষ্ট কিন্তু কাব্য কবিতায়, গীতি-নকশায় ঐ যে ছেলেবেলায় প্রাণভরে দেখা পল্লীর আদর্শ জীবনের ছবি হৃদয়ে অঙ্কিত করে রেখেছিলেন তারই প্রকাশ ঘটেছে পল্লী কবির অমর সৃষ্টিমালায়। নজরুল কিন্তু বর্ধমানের ঊষর গ্রাম চুরুলিয়ার ছন্দোবদ্ধ জীবনের বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজেকে। পল্লীর সুখ-দুঃখ অতিক্রম করে, দূরবর্তী উপজাতীয় আদিবাসীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এবং নগরজীবনের টানাপড়েনের সূত্রগুলো টেনে ধরেছেন। কৃষক ছাড়াও শ্রমিকদের জীবন সমস্যার ছবি এঁকেছেন বাস্তবতার সুনিপুণ তুলিতে।
পল্লী কবি জসীম উদ্দীন কেন, তার এক সমকালীন কবি ও লেখক গোলাম মোস্তফার কর্মের সাথে নজরুলের কাব্য কবিতার তুলনা করুন, দেখবেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফা একই ঐতিহ্য বৃন্তে যেন দু’টি গোলাপ, কিন্তু দুই-এর মধ্যে কত তফাৎ। গোলাম মোস্তফার নিকট ইসলাম ও ইসালামী ঐতিহ্যই মুখ্য বিষয়। এ সম্পর্কেই কবিতা লিখেছেন। তার প্রধান গদ্য ও কর্মও ইসলামী মূল্যবোধ সম্পর্কে। কিন্তু ইসলামের নবী সম্পর্কে, তার জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কে নজরুলের যে কবিতা তা গোলাম মোস্তফা কবিতা থেকে কত স্বতন্ত্র, কত বিচিত্র।
এমদাদ আলী ও ইসমাইল হোসেন সিরাজী ইসলামী জীবন ব্যবস্থা, ইসলামের অতীত গৌরব, ইসলামী ব্যবস্থায় সাম্য ও মৈত্রীর বন্দনায় অধিক সময় কাটিয়েছেন এবং সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য সাহিত্য। কিন্তু মুসলিম ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে নেয়া খলিফা সম্পর্কে অথবা শাত-ইল আরব প্রসঙ্গে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় যে কোনো দুটো লাইনের দিকে তাকালে বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না তাদের ভাব, ভাষা, আবেগ কত স্বতন্ত্র। যে কবিতাটির জন্য তিনি ‘বিদ্রোহ কবি’ অভিধায় ভূষিত হন সেদিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় কাজী নজরুল ইসলাম কত সার্বজনীন, কত সর্বগ্রাসী ছিলেন। বিভিন্ন সভ্যতার উপাদান একজন নিপুণ জহুরির মতো সংগ্রহ করে, হাজারো উপাখ্যানের বিচিত্র উপাদানে সাজিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে সৃষ্টি করেছেন শৈল্পিক সৌন্দর্যরূপে। ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’, আমি ইশ্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার’। ‘তাজি বোররাক আর উচ্ছৈঃশ্রবা বাহন আমার’, সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ’, স্বর্গীয় দূত জিব্রাঈলের ‘আগুনের পাখা সাপটি’, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’ এসব ইসলামের ঐতিহ্যমন্ডিত রেফারেন্সকে সংযোজন করেছেন। শিব, ইন্দ্রা, দুর্গা প্রমুখ হিন্দু দেব-দেবী এবং দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র প্রমুখ মুণি ঋষি বেদ-সভ্যতার বিভিন্ন খন্ডিচিত্র তুলে এনেছেন। এখানেই তিনি থামেননি। বিশ্ব ইতিহাসের ছন্নছাড়া বেদুঈন এবং নৃশংস অভিযানকারী চেঙ্গিসকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সংযুক্ত করেছেন যথাস্থনে।
মুসলিম ঐতিহ্য গঠিত মননে ইসলামী ভাবধারা হয়তো তার নিকট স্বাভাবিক। হয়তো স্বাভাবিক একই ভূখন্ডে বসবাসকারী হিন্দুদের ভাবনা-চিন্তার সাথে তার সম্পৃক্ততা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিঃসৃত যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জাম সম্পর্কে এ কথা বলা চলে। তাই তার পক্ষে বলা সহজ, ‘আমি টর্পেডো, আমি তীম ভাসমান মাইন’, কিন্তু অর্ফিয়াসের কিংবদন্তিকেও তিনি সংযুক্ত করেছেন অপূর্ব নৈপুণ্যের সাথে, ‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরি মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম, ঘুম চুমু দিয়ে করে বিশ্বে নিঝঝুম মম বাঁশরির তানে পাশরি’।
কে বলে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষাবর্জিত? রামায়ণ এবং মহাভারতের সাথে তার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তিনি ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে ছিলেন বিশেষভাবে সজ্ঞাত। রোমের মিথলজি সম্পর্কেও তার ছিল বিশেষ জ্ঞান। তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম মানব প্রকৃতি সম্পর্কে, মানব মনের বিচিত্র গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে মানবতার অপমান এবং বঞ্চনা সম্পর্কে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে লাইনে তার এই অনুভূতি বিবৃত হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিন :
‘আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ
আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত
পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ জ্বালা,
প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের’
তাই তিনি চিৎকার করে বলতে পেরেছেন :
‘আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।’
কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী মন অনেকটা ইংরেজ কবি শেলীর মতো। এই বিদ্রোহী মনের সঠিক প্রকাশের জন্য যেমন তিনি ব্যবহার করেছেন সাইক্লোন এবং কালবৈশাখীর মতো প্রলয়ঙ্করী প্রতীক, কবি শেলীর ডবংঃ রিহফ-ও তেমনি দুর্বার ও দুর্দমনীয়। কিন্তু অন্যদিকে তা নজরুলের বিদ্রোহীর মতোই-
‘আমি অভিমানী চিরক্ষুব্ধ হিয়ার
কাতরতা ব্যথা সুনিবিড়
চিত-চুম্বন চোর কম্পন আমি থর থর থর
প্রথম পরশ কুমারীর’
আর একটি ক্ষেত্রেও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে ইংরেজ কবি শেলীর অপূর্ব মিল লক্ষ করা যায়। নজরুল তার সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ যেমন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারের কথা বলেছেন, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিদ্যমান ব্যবধানকে নির্মমভাবে আঘাত করেছেন, নারী ও পুরুষের অসাম্য দূর করার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেছেন এবং কুলি-মজুর ও মালিকদের মধ্যে ব্যবধানকে ‘নিখিল মানব-জাতির লজ্জা’ বলে চিহিৃত করেছেন, শেলীও তার Prometheus Unbound কবিতায় মানব-জাতির উন্নয়নের জন্য দয়ামায়াহীন রাজা ও যাজকদের বিরুদ্ধে তুলেছেন বিদ্রোহের পতাকা।
এ ক্ষেত্রেও দুই-এর মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। শেলী যেখানে গডউইনের রাজনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অধিক মনোযোগী, নজরুল সেখানে জাতীয় অগ্রগতি অর্জনে অগ্রপথিক। একজনের চেতনা শ্রেণি সংগ্রামের বিজয়ে উদ্বেল, অন্যজন সেখানে জাতীয় বীরদের বীরত্ব ব্যঞ্জনায় অধিক আকৃষ্ট। কাজী নজরুল ইসলাম তাই তুর্কি বীর কামাল পাশার বন্দনায় অধিক আগ্রহী, শেলী সেখানে শ্রেণিচেতনায় অধিক সচেতন।
মোটকথা, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম সত্যি এক ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হন এবং সংযোজন করেন অজানা এক সুর, নতুন এক গতি এবং অভাবিতপূর্ব এক শক্তি। একজন সার্থক স্রষ্টার মতোই তিনি বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করেন এক সর্বগ্রাসী আবেদন যা কালের সঙ্কীর্ণতা জয় করে, ক্ষুদ্র গন্ডি অতিক্রম করে জীবনকে এক নতুন আলোকে জ্যোতির্ময় করে তোলে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতির জন্য যেমন তিনি গেয়েছেন মুক্তির গান, হাজারো প্রতিবন্ধকতায় শৃঙ্খলিত জীবনের জন্যও তেমনি তিনি তুলেছেন নতুন নতুন সুরের ব্যঞ্জনা। তুরস্কের কামাল পাশার বীরত্বের কাহিনীর মধ্যে তিনি নিজস্ব জনপদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দেখেছেন। মিসরের জগলুল পাশার কাহিনী যেন তার আপন ঘরের কাহিনী।
বঞ্চিত এবং ব্যথাতুর জনগোষ্ঠীর দুর্দশা চিত্রণে, নির্যাতিত মানবতার করুণ ক্রন্দনে ভাষা যোগাতে, অবহেলিত ও অস্পৃশ্যদের পক্ষে এমন শক্তিশালী লেখনী ধারণে কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বে কোনো কবিকে দেখা যায় না, অন্তত বাংলা সাহিত্যে। ওয়ালট হুইটম্যানের কবিতার বাংলা অনুবাদ, এমনকি বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তার যে রচনা তা পড়েও বিস্মিত হই এ কারণে যে, গভীর পান্ডিত্য বা গুরুগম্ভীর তাত্তিক জ্ঞানের অধিকারী না হয়েও কাজী নজরুল ইসলাম যা অর্জন করেছেন তা অসাধারণ। তার প্রতিভার পরশমণি যা কিছু স্পর্শ করেছেন তাকেই রূপান্তরিত করেছেন খাদবিহীন সোনায়।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন