শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

মালয়েশিয়ার দর্পণে সুশাসন ও যোগ্য নেতৃত্বের স্বপ্ন

উ বা য় দু র র হ মা ন খা ন ন দ ভী | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গত ৯ মে মালয়েশিয়ার বহু আলোচিত জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। ঘটনাক্রমে সেদিন আমি মালয়েশিয়া ছিলাম। ৪টি দেশ ভ্রমণের কর্মসূচি আগে থেকে তৈরি ছিল। কিন্তু সময়াভাবে দু’দেশে যাওয়া হয়নি। কুয়ালালামপুরেই তিন দিন থাকা হয়। এর মধ্যে নানা কর্মসূচির মাঝে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘মুলতাক্বা ওলামায়ে দেওবন্দ’ শীর্ষক বিশ্ব ওলামা-মাশায়েখ ইজতেমা। উদ্যোক্তারা বলেছেন, সারা বিশ্ব থেকে পাঁচশ’ আলেম এতে অংশগ্রহণ করেছেন। স্থানীয় ও আশপাশের মিলিয়ে মোট উপস্থিতি ছিল নয়শ’। দারুল উলূম দেওবন্দের ১৮ জন আসাতে যা ছাড়াও ভারতীয় ওলামা, পীর-মাশায়েখ ছিলেন দেড় শতাধিক। ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, দুবাই, হংকং, সউদী আরব, জার্মানি, ফ্রান্স, জাম্বিয়া, ব্রিটেনসহ বহুদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলাদেশেরও বহু আলেম এতে অংশ নেন। নির্বাচনের দিনটি সম্মেলন কর্তৃপক্ষ এমনভাবে সাজান যেন কোনো ডেলিগেটকে সম্মেলনস্থলের বাইরে যেতে না হয়। আমি বরাবরই মালয়েশিয়ার দিকে একটু বেশি মনোযোগী। কারণ, এটি বিশাল এক মুসলিম রাষ্ট্র। যা আধুনিকতার শীর্ষে অবস্থান করেও যথাসম্ভব দীনদারি ধরে রেখেছে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলামের গুরুত্ব ও ছাপ ঈর্ষণীয়। হাজার বছরের সুলতান শাসিত শরীয়তী দেশ মালয়েশিয়া নিজের পরিচয় ঠিক রেখেই উন্নতি ও আধুনিকতার শীর্ষ স্পর্শ করেছে। দেশটিকে আমার ভালোবাসার এটি বড় কারণ। দেশটির ৬০% মালয় জাতি, যার অধিকাংশই মুসলমান। সাধারণত তারা শাফেঈ মাযহাব অনুসারী। তবে উদারমনা। দীনি চেতনা তারা পেয়েছে তাবলীগ জামাত থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাথে তাদের তাবলীগি ওঠা-বসা বেশি। মালয়েশিয়াকে উন্নত ও আধুনিক করার পেছনে বাংলাদেশি মেধা ও শ্রমের ভূমিকা অনেক। এটা তারা মনে রাখে এবং বলেও। বহুবার সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া ভ্রমণের সময় বিশেষ করে এবার ঐতিহাসিক মালাকা প্রণালী ঘুরে দেখার সময় মালয়দের সাথে আমার দোভাষীর মাধ্যমে এসব নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এবার সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিবিজড়িত মালাকা প্রণালী দেখতে গিয়ে সেখানে তাবলীগি এক জামাতের সাথে কথাবার্তা হয়। (আরব থেকে যারাই জাভা, সুমাত্রা ও চীনে গিয়েছেন তারা এই প্রণালী হয়েই গিয়েছেন। সেখানে এখনো ফলকে লেখা আছে, ‘মাদীক মালাক, আতওয়ালু মাদীক ওয়া আকছারুহু ইযদিহামান ফিল আলাম’ অর্থাৎ সমুদ্রপথে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ও অধিক জাহাজে পূর্ণ প্রণালী। ইতিহাসে চীনগামী সাহাবীদল এই প্রণালী হয়ে গিয়েছিলেন এবং মালয়েশিয়ায় তারা যাত্রাবিরতি করেছিলেন বলে বর্ণনায় পাওয়া যায়। তাদের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাটিতে মালয়েশিয়ার সুলতানরা বহু বছর আগে থেকেই মসজিদ নির্মাণ করে রেখেছেন। বর্তমানে এ স্থানের মসজিদটি বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় মসজিদ। যার এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রে। সৈকতে গড়ে উঠছে বিশাল মালাকা শহর। শত শত আধুনিক হোটেল ও রিসোর্ট। বড় একটি পার্ক। পার্কের ভেতর একটি ফলকে সুলতানী আমলে লেখা হয়েছিল, ‘তোমরা ব্যাভিচারের কাছেও যেওনা, কারণ নিঃসন্দেহে ইহা চরম অশ্লীলতা ও মন্দ পন্থা।’- আল কোরআন। আয়াতটি আরবীতে লিখে সাথে মালয় ও ইংরেজী ভাষায় তরজমা করে দেওয়া হয়েছে।) বাংলাদেশিদের প্রতি তাদের মহব্বত অনেক গাঢ়। দেশের কিছু লোক ভারতীয় তামিল আর কিছু চায়নিজ। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়া মুসলমানদের একটি গৌরবের দেশ। কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত এ দেশ মূলত অতীতে শত শত বছর ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সুলতানী শাসনের আওতায় চলেছে। বর্তমানে সুলতানরা আছেন। পাঁচ বছর পর পর প্রাদেশিক সুলতানরা রাজধানীর কেন্দ্রীয় সুলতান হন। সংসদ তাদের সম্মান দিয়ে দেশ চালায়। সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রাধান্য সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। বিশেষ করে নামায খুবই ব্যাপকভাবে পরিপালিত এবং বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত বলা চলে ঘরে ঘরে প্রচলিত। মালয় মুসলমানরা পর্দা ও দীনি চেতনায় খুবই অগ্রগামী। সারা দেশে সকল পর্যায়ে ইমাম, আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষকের মর্যাদা আমাদের দেশের ভিআইপিদের মতো। এয়ারপোর্ট থেকে গোটা রাজধানী ও বিভিন্ন প্রদেশে ঘোরাফেরার সময় বহুবার পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে একজন আলেম হিসাবে যে সমীহ ও শ্রদ্ধা আমি লাভ করেছি তা দুনিয়াতে নজিরবিহীন। সুতরাং মালয়েশিয়ার জন্য দুআ ও শুভকামনা শুধু আমার নয়, সে দেশের সম্পর্কে যারা জানেন, বিশেষ করে মালয়েশিয়া ভ্রমণকারী ওলামা-মাশায়েখ সবার মনেই থাকার কথা।
এ পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাপ্ত কিছু অনুভূতির কথা বলা সমীচীন হবে বলে মনে করছি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মালয়েশিয়ার এ পরিবর্তন বেশ সাড়া জাগিয়েছে। মিশর, জর্দান, সিরিয়া, সউদী আরব, ইরাক ইত্যাদির সচেতন নাগরিক, বিশেষ করে তরুণরা তাদের ব্যক্তিগত পেইজে বা বøগে নিজ নিজ দেশের ক্ষমতাসীন ও জনগণের মধ্যকার হতাশাপূর্ণ সম্পর্ক, যুদ্ধ, দুরবস্থা, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি তুলে ধরছেন। অনেক গ্রæপে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। সবকিছুর মূল ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক এত বৈরী পরিবেশেও এমনকি ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী বিশ্বসমাজেও নিজ প্রজ্ঞা, ভারসাম্য ও নীতি-নিষ্ঠার ফলে একটি অধঃপতিত দেশকে কতটুকু উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন তা বর্ণনা করে যেন আরবরা গর্ববোধ করছে। কোনো কোনো আলোচনায় নাম আসছে তুরস্কের নেতা রজব তায়্যিব এরদোগানের। শত হতাশার মধ্যে অনারব মুসলিম দেশগুলোতেও এ দু’নেতার বিশ্বাস, সাহস, প্রজ্ঞা ও কর্মপন্থার কথা প্রশংসার সাথে আলোচিত হচ্ছে। মূলত বিশ্বের মানুষ এখন জুলুম, দুর্নীতি, শোষণ ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডার পাঁকচক্রে আটকে পড়েছে। তারা ক্ষমতার লালসায় মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা একটি দুষ্টচক্রের হাতে বন্দী। এ চক্রের হাত থেকে মানবজাতির মুক্তি খুবই প্রয়োজন। এ মুক্তি তাদের অধিকার। যা ইসলাম তাদের দিতে পারে। ৬০৯ খ্রি. থেকে ১৯১৭ খ্রি. পর্যন্ত ১৩০০ বছর ইসলাম বিশ্ববাসীকে যে শান্তি ও স্বস্তি দিয়েছে। বিশ্বের শাসনে গত ১০০ বছর ইসলাম না থাকায় মানবজাতি এখন ধ্বংসের পথে। যাকে ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, আজন্ম মুক্ত আত্মা মানবজাতিকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্তি দিয়ে আল্লাহর গোলামির মুক্ত আকাশে ছেড়ে দেওয়া। তাদেরকে ধর্ম, সংস্কৃতি ও নানা মনগড়া রীতিনীতির অত্যাচার থেকে মুক্ত করে ইসলামের ন্যায়বিচার ও সুশাসনের স্বর্গীয় ভুবনে নিয়ে যাওয়া। তাদের পার্থিব সংকীর্ণ জীবনবোধ থেকে মুক্ত করে উদার প্রশস্ত মানবিক জীবন উপহার দেওয়া। পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামই মানুষকে প্রকৃত ন্যায়বিচার, সুশাসন, মুক্তি ও উন্নয়ন দান করেছিল। আবার যদি পৃথিবী বাঁচতে চায়, তা হলে তাকে ইসলামের পথেই ফিরে আসতে হবে। এ জন্য প্রকৃত ঈমানদার, আমানতদার, মানবতাবাদী, প্রাজ্ঞ ও কৌশলী নেতৃত্বের প্রয়োজন। নেতৃত্বের এ দুর্ভিক্ষের সময় তুলনামূলক কিছু যোগ্য নেতা বা মন্দের ভালো কোনো সরকার দেখতে পেলেই হতাশ ও অবহেলিত মুসলমানদের মনে আশাবাদ জেগে ওঠে। আমরা আরববিশ্বের জন্য যোগ্য নেতা, সংগঠন ও সরকার যেমন চাই তেমনি গোটা মুসলিমবিশ্বের প্রতিটি দেশে কামনা করি সম্ভাব্য সর্বাপেক্ষা ঈমানদার, আমানতদার, যোগ্য, দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব। যারা আখেরাতকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দেবেন। বর্তমান সময়েও সকল ফেতনা ও বাধা মোকাবেলা করে মুসলমানদের কেন্দ্রীয় শাসন শৃঙ্খলা ‘খেলাফত আলা মিনহাজিন নবুওয়ত’ প্রতিষ্ঠার পথ ধীরে ধীরে সুগম করবেন। কারণ, আল্লাহ কোনো ব্যক্তি বা জাতির অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ তারা তাদের নিজেদের অবস্থায় পরিবর্তন না আনে। -আল কোরআন। আর এ কথা সত্যি যে প্রতিটি বড় অভিযান প্রথমে ছোট একটি পদক্ষেপ দিয়েই শুরু হয়। আমাদের দায়িত্বশীলেরা কি ভেবে দেখবেন?
লেখক: সাংবাদিক, ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রতত্তবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন