মাদক সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করছে যে সেখান থেকে তাকে বের করে আনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাদকের আগ্রাসনে দেশের যুব সমাজ নৈতিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে সমাজের উপর দেশের-শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি-অগ্রগতি ও ভবিষ্যত নির্ভরশীল, তাদের উলেখযোগ্য অংশ যদি মাদকাসক্তিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে সেদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ংকর অভিশাপ থেকে আমাদের যুব সমাজকে রক্ষা করার কোন বিকল্প নাই। আগে সাধারণতঃ শহরের অতি ক্ষুদ্র এক শ্রেণির বিত্তবান ও নেশাখোর এবং গ্রামের গুনাগুনতি কিছু বিলাসী ধনাঢ্য ব্যক্তির মধ্যে এই নেশার আসক্তি দেখা যেত। এখন শহর ও গ্রাম অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের মধ্যেও এটা ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হিরোইন, মদ, স্পিরিট ইত্যাদির নেশায় মেতে উঠেছে। গরিব রিক্সাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কুলি, দিন মজুর, পথশিশুকিশোর ইত্যাকার শ্রেণির এক বিরাট অংশও নানারকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। সত্য কথা বলতে কি, মাদকাসক্তি বর্তমান সময়ে সমাজের এক সর্বনাশা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আরও ভয়ের কারণ, সমাজে মূল্যবোধের নানারকম পতন-স্খলনের ফলে বাড়ছে এই সর্বনাশা পাপ। মাদকাসক্তির ভয়াবহ ধ্বংস হতে রক্ষার জন্য অবশ্যই সামাজিক সচেতনা জোরদার করা খুবই দরকার।
পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজে যা তরুণদের জন্য হতাশার কারণ, সেই বেকারত্ব দূর করা। আরো একটি উদ্বেগজনক ঘটনা হচ্ছে মাদকাসক্তি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠা বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রের অনৈতিক ও সমাজ বিধবংসী বাণিজ্যিক কার্যকলাপ। খোদ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী শত শত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও এগুলোর সরকারিভাবে বৈধ অনুমোদন আছে কি-না সন্দেহ। এসকল নিরাময় কেন্দ্রের নেই কোন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ঔষধপত্র এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্স। মূলতঃ অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে স্পর্শকতার মাদকদ্রব্য বেচাকেনার আখড়াগুলোর সন্নিকটে। এসকল কেন্দ্রের অধিকাংশের মধ্যেই সার্বক্ষণিক কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিসিনের ডাক্তার নেই। মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় পরিষ্কার বিছানাপত্র, লকারসহ খাট, স্যালাইন স্ট্যান্ড, প্যাশেন্ট ট্রলি, স্ট্রেচার বেডপ্যান, ইউরিনাল, ড্রসক্যান, ফ্লেমিটার ও মাস্কসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার, ট্রান্সফিউসন সেট, ইলেকট্রিক শকার, স্টেরিলাইজার, সার্জিক্যাল কাঁচি, আধুনিক বেড, রেফ্রিজেরেটরসহ বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি এবং জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জেনারেটর থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এসবের বেশিরভাগেরই তা নেই। নেই অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণও। অথচ এসকল কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যয়ভার অত্যাধিক এমনও অভিযোগ রয়েছে, কোন কোন নিরাময় কেন্দ্র রোগীর আর্থিক স্বচ্ছলতা কিংবা পারিবারিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে রীতিমত বøাকমেইল করে। মাদকাসক্ত রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার নামে ক্লিনিকে রেখে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার হতে এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা করতে এসে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে। এমনকি চিকিৎসার নামে এসকল কেন্দ্রে মাকদাসক্তি বা রোগীদের মারধর করার অনেক অভিযোগও রয়েছে। কোন কোন নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীরাই জড়িত এবং প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে মাদকের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেও তাদের ব্যবহার করতে দেখা যায়। নিরাময় কেন্দ্রে দীর্ঘদিন রোগী ধরে রাখার জন্য স্বল্প পরিমাণ মাদক প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি চালানো হয়ে থাকে। এটিকে সম্পূর্ণ অনৈতিক পদ্ধতি আখ্যায়িত করে দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ পদ্ধতিতে রোগীকে কখনও সুস্থ করা সম্ভব নয়।
মাদক গ্রহণ ও এর বেচাকেনার সাথে জড়িত থাকা একটি সামাজিক ও নৈতিক অপরাধ। এই অপরাধের বিস্তার রোধে দেশের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব ও ভূমিকা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মাদকের ভয়াবহতা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, ভাষা, শ্রেণি, পেশা, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাইকে আক্রমণ করতে উদ্যত। এটি একটি সামাজিক অভিশাপ। বিশেষতঃ নতুন এবং তরুণ-তরুণী প্রজন্মই মাদকের ভয়াবহতার প্রধান শিকার। তাই শুধু বর্তমান না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে ও মাদক বিরোধী অভিযানে অংশ গ্রহণ সকলের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার, রোগ নিরাময়ের চাইতে রোগ প্রতিরোধ উত্তম। একইভাবে মাদকাসক্তি নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলো সঠিকভাবে চলছে কিনা সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি জোরদারের তাকিদ দিচ্ছি। দেশব্যাপী যে হারে মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে থানাভিত্তিক মাদক প্রতিরোধ কমিটি স্থানীয় কমিশনার, চেয়ারম্যান বা সমাজসেবকদের নিয়ে সরকারিভাবে গঠন করা যেতে পারে। এছাড়াও মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ড্রাগ সমস্যা মোকাবেলায় মূল্যবোধের শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। মাদকাসক্তিদের পরিচর্যা ও সুচিকিৎসা এবং সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করার কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে। এই সঙ্গে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে নিরীহ-নিরপরাধী মানুষ যাতে কোনোরূপে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক: কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন