বর্তমান সময়ে অভিবাবকসহ সচেতন মহলে মাদকাসক্তি নিয়ে ব্যপক উৎকন্ঠা দেখা যায়। বিশেষ করে অভিবাবকরা তাদের টিনেজ সন্তানদের নিয়ে এসব বিষয়ে খুবই চিন্তিত থাকেন। মাদকাসক্তি অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মত। নিজেদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ মাদকসেবী হলে তার থেকে অন্যরা নতুন অভিজ্ঞতা লাভের আশায় এ পথে পা বাড়ায়। এভাবেই তাদের মাদকের পথে যাত্রা শুরু হয়। এসব পরিস্থিতি এড়াতে প্রয়োজন সকল স্তরে সব পর্যায়ে বিশেষ সচেতনতা। যাতে করে নতুন কেউ এই পথে না যেতে পারে। আমরা সবাই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সম্যক অবগত। একটি পরিবার একটি জীবন কিভাবে মূহুর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে মাদকের বিষাক্ত ছোবলে তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। মাদকাসক্তি থেকে বাঁচতে হলে এবং বাঁচাতে হলে আগে জানতে হবে মাদকাসক্তি কী?
নেশায় বুদ হয়ে পড়া বা মাদকাসক্তি মূলত একটি রোগ বা ব্যাধি। মেডিকেল সাইন্সে মাদকাসক্তিকে বলা হয়, ক্রনিক রিলাক্সিং ব্রেইন ডিজিজ যা বার বার হতে পারে এমন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন ব্যক্তিকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কিছু শর্ত আছে। যেমন যেকোনো উপায়েই হোক নেশাদ্রব্য সংগ্রহ করতে হবে, যেটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ক্রেভিং। দ্বিতীয়ত নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণের মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দেয়া যাকে বলা হয় টলারেন্স। তৃতীয়ত নেশা জাতীয় বস্তুর প্রতি একধরনের মনোদৈহিক নির্ভরতা তৈরী হয়। নেশাদ্রব্য গ্রহণ করতে না পারলে তার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। স¤প্রতি কিছু গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সা¤প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি ৩ দশমকি ৩০ শতাংশ, ১২-১৭ বছর বয়সী ১ দশমিক ৫০ ও ৭-১১ বছর বয়সীদের মধ্যে ০ দশমিক ২০ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। অর্থাৎ, ৭ বছরের শিশুও মাদকাসক্ত হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সার্বিকভাবে দেখা যায়, পুরুষদের মধ্যে ৪ দশমিক ৮০ এবং নারীদের ০ দশমিক ৬০ শতাংশ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তদের মধ্যে গাঁজায় আসক্ত ৪২ দশমিক ৭০, মদে ২৭ দশমিক ৫০, এমফেটামিন জাতীয় ওষুধে ১৫ দশমিক ২০, আফিম জাতীয় দ্রব্যে ৫ দশমিক ৩০ এবং ঘুমের বড়ি বা ট্যাবলেট খায় ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ জরিপ থেকে আমরা বাংলাদেশের মাদকাসক্তের সার্বিক একটা ভয়াবহতার চিত্র বুঝতে পারি।
আশংকার ব্যাপার হলো, দেশের তরুণ-তরুণী কিংবা কিশোর-কিশোরীরা মাদকে বেশি আসক্ত হচ্ছে। দেশে মাদকাসক্তের প্রায় ৬৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী। কিশোর বা তরুণদের ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই আমরা বলে থাকি, ওদের আবেগ অনিয়ন্ত্রিত এবং বয়সটিতে বন্ধুদের প্রভাব অনেক বেশি। এদের মধ্যে অনেকেই নিছক কৌতূহল এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের বশে নেশা করে। অনেকের ক্ষেত্রে সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো হতাশা থেকে শুরু হয়। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত হয়েও অনেকে কিন্তু মাদকে ঝুঁকে পড়ে। দেশে নানা জাতীয় মাদকের সহজলভ্যতাও মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। এ ছাড়া মাদকাসক্তের পেছনে পারিবারিক অনেক কারণও আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। যেমন, কোনো সংসার বা পরিবারে পারিবারিক কলহ দিনের পর দিন চলতে থাকে, মা-বাবা কিংবা বড় ভাই-বোনদের কেউ মাদকাসক্ত, মা-বাবার সাথে শিশু-কিশোর বয়সে সন্তানের স্নেহপূর্ণ সম্পর্কের ঘাটতির কারণেও মাদকে আসক্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এখন আসা যাক তরুণ-তরুণীরা মূলত কোন কোন মাদকে আসক্ত হয়। সা¤প্রতিক ডিএসএম-৫ বা ডায়াগনোস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিস-অর্ডারসের পঞ্চম সংস্করণে ১০টি দ্রব্যকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো, অ্যালকোহল বা মদ, ক্যাফেইন, ক্যানাবিস বা গাঁজাজাতীয় দ্রব্য, হ্যাল্যুসিনোজেনস বা বিভ্রম সৃষ্টিকারী দ্রব্য (এলএসডি, বিভিন্ন ধরনের ইনহ্যাল্যান্টস অর্থাৎ যেগুলো শ্বাসের সাথে গ্রহণ করা হয়), অপিওয়েডস বা আফিম জাতীয় দ্রব্য, সিডেটিভ বা উত্তেজনা প্রশমনকারী দ্রব্য (ঘুমের ওষুধ, হিপনোটিকস বা সম্মোহক পদার্থ), অ্যানজিওলাইটিকস বা উদ্বেগ প্রশমক দ্রব্য, স্টিম্যুলেন্টস বা স্নায়ু উত্তেজক দ্রব্য (অ্যামফিটামিন জাতীয় দ্রব্য বা কোকেইন) এবং বিভিন্ন তামাকজাতীয় দ্রব্য।
আশার কথা হচ্ছে, সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মধ্যদিয়ে একজন মাদকসক্তি ব্যক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারে এবং মাদক থেকে দূরে থাকতে পারে। মাদক গ্রহণজনিত রোগকে অনেক সময় ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের সাথে তুলনা করা হয়, কারণ যে ব্যক্তির একবার ডাইবেটিস বা হৃদরোগ হয় তার সারাজীবন কিছু বিধি-নিষেধ বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকতে হয়। ঠিক তেমনি মাদক নির্ভরশীলতার চিকিৎসার পরেও রোগীকে কিছু বিধি-নিষেধ বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকতে হয়। এর ব্যাতিক্রম ঘটলে রোগী পুনরায় মাদক গ্রহণ শুরু করে। মাদক নির্ভরশীলদের চিকিৎসায় বিভিন্ন দেশে একাধিক পদ্ধতি প্রচলিত আছে বা অনুসরণ করে থাকে। একসময় মাদক নির্ভরশীলদের চিকিৎসা ছিল বিচ্ছিন্ন। কিছু চিকিৎসা কেন্দ্র ঔষুধ নির্ভর চিকিৎসাকে গুরুত্ব প্রদান করত। আবার কোন কোন কেন্দ্র ঔষুধ বর্জিত পুনর্বাসন কেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুসরণ করত। কাউন্সেলররা শুধু কাউন্সেলিং ভিত্তিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব প্রদান করত। এসমস্ত চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক সময় রোগীর সমস্যা কেন্দ্রিক না থাকায় অনেকাংশেই চিকিৎসা ফলপ্রসূ হয়নি। একজন মাদক নির্ভরশীলকে মাদকমুক্ত করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা। কারণ একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্বিক ও পারিবারিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণের কারণে অনেকেরই আচরণ ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে থাকে বিধায় তাকে মাদকমুক্ত থাকতে হলে তার আচরণ ও চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন। আচরণ পরিবর্তন একটি কষ্টসাধ্য বিষয় হলেও মাদকমুক্ত থাকার সাথে আচরণ পরিবর্তন গভীরভাবে জড়িত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর চিন্তা ও আচরণ পরিবর্তনকে গুরত্বের সাথে মাদক চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। এজন্য চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তির দৈহিক চিকিৎসার পাশাপাশি আচরণ পরিবর্তন, নৈতিক গুণাবলী শিক্ষা প্রদান এবং এমনভাবে সুস্থ করে তোলা যাতে সে জীবনের সাধারণ সমস্যার মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট, নিউরোলজিস্ট এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সম্বনয়ে চিকিৎসা শুরু করলে দ্রæত সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এসব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং অথবা সাইকোথেরাপি খুব উপকারি। শুরু থেকেই যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যায় দ্রæত ফল পাওয়া সম্ভব। তাই দেরী না করে মাদকাসক্তির চিকিৎসায় দ্রæত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করতে হবে।
লেখক ঃ জনস্বাস্থ্য গবেষক, সেন্টার ফর সাইকোট্রমাটোলজি অ্যান্ড রিসার্চ চিকিৎসক, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন