ফার্সি ‘শবে কদর’, আরবি ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ মহিমান্বিত রাত। এ রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চাইতে উত্তম। পবিত্র কোরআনে ‘কদর’ নামে স্বতন্ত্র একটি সুরা রয়েছে। ৫ আয়াত বিশিষ্ট এ সুরায় লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে ইসলামি শরীয়তে এ রাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। আরবি মাসগুলোর মধ্যে রমজান যেমন শ্রেষ্ঠ মাস, তেমনি রমজানের একটি রাত লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আমি এই কেতাব কদরের রাতে নাজিল করেছি। কদরের রাত সম্পর্কে তুমি কী জান? কদরের রাত হাজার মাস থেকে উত্তম। এ রাতে জিবরাইলসহ সকল ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে। এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ (সুরা কদর)।
কোরআনের বর্ণনা দ্বারা পবিত্র এ রাতের মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামাজ পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী: ১৯০১)। হাদিসে ‘ঈমান সহকারে’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, এই রাতের মর্যাদা ও বিশেষ আমল শরিয়তসম্মত হওয়ার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আর ‘প্রতিদানের আশায়’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, নিয়্যতকে আল্লাহ তাআলার জন্য একনিষ্ঠ করা। সুরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আমি এটা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি একটি বরকতময় রাতে।’ আর এ রাত হলো শবেকদর। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘ফেরেশতারা এ রাতে রহমত, বরকত ও প্রশান্তি নিয়ে অবতরণ করেন।’ কারো কারো মতে, ‘আল্লাহ তায়ালা এ বছর যেসব বিষয় নির্ধারণ ও ফয়সালা করেছেন, ফেরেশতারা তা নিয়ে অবতরণ করেন।’
লাইলাতুল কদর অতি মূল্যবান রাত হওয়ায় মহান রাব্বুল আলামিন এর সুনির্দিষ্ট তারিখ গোপন রেখেছেন। মুমিন বান্দা-বান্দিরা যেন এ রাতকে কষ্ট করে অন্বেষণ করে, যাতে তারা কেবল ঐ নির্দিষ্ট তারিখই ইবাদত করে অন্য রাতে অলসভাবে না কাটায়। তাই রমজানের বেজোড় রাতগুলোকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)- কে অনুসরণ করে পুরো রমজান বিশেষত শেষ দশকের বেজোড় রাতে বেশি বেশি ইবাদত ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন।
কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা নিয়ে আলেমদের মাঝে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ফাত্হুল বারী গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ সংক্রান্ত অভিমত ৪০টির উপরে পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক মত হলো, লাইলাতুল কদর রমজান মাসের শেষ দশকের কোন এক বেজোড় রাত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল ক্দর অনুসন্ধান কর।’ (বুখারী: ২০১৭)। রমজান মাসে নির্দিষ্ট কোন রাতকে লাইলাতুল ক্দর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর কোন একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর এর মধ্যে ২৭তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিভিন্ন হাদিস থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে একজন মুসলিমের নির্দিষ্ট কোন রাতকে লাইলাতুল কদর হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। কারণ এতে করে এমন বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়, আসলে যে বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভবপর নয় এবং এতে করে ব্যক্তি প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। হতে পারে লাইলাতুল কদর ২১তম রাতে অথবা ২৩তম রাতে অথবা ২৯তম রাতে। তাই কেউ যদি শুধু ২৭তম রাতে নামায আদায় করে তবে তিনি অফুরন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং এই মুবারকময় রাতের ফজিলত হারাবেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কোরআনের সূরা কদরের গবেষণা করে করে ২৭ তারিখ লাইলাতুল কদর হওয়ার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তার গবেষণা সূত্র হচ্ছে, কোরআনে লাইলাতুল কদর শব্দটি তিনবার বলা হয়েছে। এ শব্দটিতে ৯টি অক্ষর আছে। সুতরাং ৩ গুন ৯ = ২৭ রমজানে লাইলাতুল কদর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। তাই বলে সাতাশের রাতকেই সুনির্দিষ্টভাবে লাইলাতুল কদর বলা উচিত নয়। খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, এ রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার অধিক সম্ভবনা রয়েছে। রমজানের শেষ দশকের ফজিলতই সবচেয়ে বেশি। প্রিয়নবী কারীম (সা.) শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (মুসলিম: ১১৭১)।
এ রাতে মহাগ্রন্থ কোরআন নাজিল হয়, মানবজাতির এই বিরাট নিয়ামতের কারণেই এ রাতের এত মর্যাদা ও ফজিলত। এই কুরআনকে ধারণ করলেই মানুষ সম্মানিত হবে, একটি দেশ ও জাতি মর্যাদাবান হবে; গোটা জাতির ভাগ্য বদলে যাবে। কাজেই এ রাতে বেশি বেশি কুরআন পড়তে হবে। কুরআনের শিক্ষাকে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করতে হবে। বাছাইকৃত কিছু আয়াত এ রাতে মুখস্থও করা যেতে পারে। যাদের কুরআনের ওপর প্রয়োজনীয় জ্ঞান রয়েছে তারা এ রাতে একটি দরসও প্রস্তুত করতে পারেন। কুরআনের এ গভীর অধ্যয়ন আমাদের সৌভগ্যের দ্বার খুলে দেবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের লাইলাতুল কদর সম্পর্কে অবগত করানোর জন্য বের হয়ে এসেছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তির ঝগড়ার কারণে আমাকে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারী) সুতরাং দুই ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যকার ঝগড়াবিবাদ মিটিয়ে দেওয়া এ রাতের অন্যতম ইবাদত। তা ছাড়া হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! যদি আমি শবেকদর পেয়ে যাই, তবে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুল (সা.) বলেন, এ দোয়া পড়বে- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নকা আফুয়্যুম তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাটা তুমি ভালবাসো। তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
উম্মতে মুহাম্মদ (সা.)-ই এ মহিমান্বিত রাত পেয়েছে। আর কোনো উম্মতের ভাগ্যে তা জোটেনি। মহান রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তার নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হিসেবে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এ রাত দান করেছেন, যাতে তারা স্বল্প বয়সেও এ রাতে ইবাদত করে মহাসাফল্য লাভ করতে পারে। এ সুবর্ণ সুযোগ সদ্ব্যবহার করা আমাদের উচিৎ। সুতরাং একজন মুসলিমের উচিত রমজান জুড়ে আনুগত্য ও ইবাদতের কাজে সর্বোচ্চ সাধনা চালানো। আর শেষ দশকে আরো বেশি তৎপর হওয়া। এটিই নবী (সা.)-এর আদর্শ। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজানের শেষ দশ রাত্রি শুরু হলে রাসুল (সা.) কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং তাঁর পরিবারবর্গকে ইবাদাতের জন্য জাগিয়ে দিতেন।’ (বুখারী :২০২৪)।
লেখক: শিক্ষাসচিব, বাইতুন নূর মাদ্রাসা, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন