২০১৮ ব্যালন ডি’অরের অন্যতম শক্ত দাবিদার মোহাম্মদ সালাহ। ক্লাবের হয়ে মৌসুম মাতানোর পর এখন তিনি বিশ্বকাপের অপেক্ষায়। কিন্তু আসল সত্যটা হলো বিশ্বকাপে সবার দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও নেইমার। সময়ের সেরা তিন ত্রয়ীও প্রস্তুত রাশিয়ায় আলো ছড়াতে।
গত এক দশক ধরে ক্লাব ও ব্যক্তিগত সাফল্যে নিজেদের অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন মেসি ও রোনালদো। জাতীয় দলেও তাদের কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে সকল পরিকল্পনা। এর প্রমাণও তারা দিয়ে আসছেন দশক ধরে। এক্ষেত্রে অবশ্য কিছুটা এগিয়ে থাকবেন রোনালদো। এবং সেটা শুধুমাত্র ২০১৬ ইউরো জয়ী দল হওয়ার কারণে। আর্ন্তজাতিক আসরে তিনবার ফাইনালে খেললেও মেসির অর্জনের ঝুলিটা শূন্য।
বিশ্বকাপে অংশ নিতে দলের সঙ্গে রোনালদো অবস্থান করছেন মস্কো থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ক্রাতোভোয়। বিরক্তিকর একটা জায়গা কিন্তু ফুটবলের ক্যাম্প করার জন্য আদর্শ। একেবারেই নিরিবিলি। রোনালদোরও হয়ত এই সময় এমন জায়গারই দরকার ছিল। রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। দাবী অনুযায়ী বেতন ভাতা বাড়াচ্ছে না ক্লাব। যে কারণে তিনি দল ছাড়তে চান। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সে এসে প্রত্যাশামত বেতন মেটানো ক্লাব খুঁজে পাওয়াও ভার। সবকিছু মিলে বেশ ঘোলাটে সময়ই পার করছেন ৫বারের বর্ষসেরা। এর প্রভাব বিশ্বকাপে পড়বে কি না সেটা বোঝা যাবে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিন ও স্পেনের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই।
ক্লাবে মেসি সুখে থাকলেও জাতীয় দলকে নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। দলকে একা বহন করতে করতে ক্লান্ত দলীয় অধিনায়ক। সতীর্থদের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন না পাওয়াই এর মূল কারণ। কিংবদন্তি হওয়ার পথে পেলে পেয়েছিলেন গ্যারিঞ্জো, ভাভা, আমারিলদো, জিরজিনহোর মত তারকাদের। গ্যারিঞ্জোকে বলা হতো ড্রিবলিংয়ের রাজা। প্রতিপক্ষের ডি বক্সে আতঙ্কের নাম ছিলেন গ্যারিঞ্জো। তিনটি বিশ্বকাপ জিততে পারলে হয়ত পেলের মত তার নামও ইতিহাস মনে রাখত ভিন্নভাবে। ম্যারাডোনার পাশে ছিলেন বুরুচঙ্গা, ভালদানোর মত খেলোয়াড়রা।
কিন্তু জাতীয় দলের সার্জি পরলেই যেন বাঘ থেকে বিড়াল বনে যান মেসির সতীর্থ হিগুয়েইন-আগুয়েরোরা। এর প্রমাণ ফুটবল বিশ্ব দেখেছে বহুবার। অথচ রোনালদো-নেইমারের মত সতীর্থদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পেলে গেল বিশ্বকাপ ও দুটি কোপা আমেরিকাজয়ী কিংবদন্তি হতে পারেতেন মেসি। ফাইনালে এসে সতীর্থদের হাস্যকর সব গোল মিসের মহড়া মেসিকে তো বাধ্যও করেছিল জাতীয় দলকে বিদায় বলতে। সেসব অবশ্য অনেক পুরোনা কথা। ভালোবাসার টানে অভিমান ভুলে ফিরেছেন মেসি। দলকে প্রায় একাই টেনে তুলেছেন বিশ্বকাপের মূল পর্বে।
সোজা কথায় আর্জেন্টিনা দলকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। এক হলো মেসিহীন আর্জেন্টিনা, যে দলকে যে কোন দলই হারাতে পারে; দুই. মেসির আর্জেন্টিনা, যে দল যে কাওকে হারিয়ে দিতে পারে। লাতিন আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের কথা নিশ্চয় ভূলে যাননি। যেখানে ৮ ম্যাচ খেলতে পারেননি মেসি। তা থেকে সম্ভব্য ২৪ পয়েন্টর মধ্যে তাদের অর্জন ছিল মাত্র ৭ পয়েন্ট (১ জয়, ৪ ড্র, ৩ পরাজয়)। পক্ষে গোল মাত্র ৭টি, বিপক্ষে ৯টি। আর মেসিসহ আর্জেন্টিনা ১০ ম্যাচে অর্জন করে ২১ পয়েন্ট (৬ জয়, ৩ ড্র ও ১ পরাজয়। ৭ গোল খাওয়ার বিপরীতে দিয়েছিল ১২টি। এর মধ্যে ৭টি গোল ও ৩টি অ্যাসিস্ট মেসির। মূল মঞ্চেও ভক্তরা তাকিয়ে থাকবেন ৫বারের বর্ষসেরা ফুটবল জাদুকরের দিকেই।
পর্তুগাল যে পুরোপুরি রোনালদো নির্ভর একথা বলা যাবে না। ফাইনালে তাকে ছাড়াই ফ্রান্সকে হারিয়ে প্রথমবারের মত ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল। তবে দলে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। কিন্তু আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। নিজে পারফর্ম করেই দলকে এগিয়ে নিতে হয় মেসিকে।
লিভারপুলের হয়ে দুর্দান্ত মৌসুম কাটিয়েছেন সালাহ। ২৫ বছর বয়সী তারকার এখন সময় কাটছে অনুশীলনের বাইরে বিশ্রাম নিয়ে। দলে থাকলেও বিশ্বকাপের কোন ম্যাচে অংশ নিতে পারবেন কিনা এখনো নিশ্চিত নয়। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে সের্জিও রামোসের সেই আঘাতের মূল্য এখনো দিতে হচ্ছে ‘মিশরের মেসিকে’। মাঠে যদি নামতেও পারেন তাহলে ২৮ বছর পর বিম্ভকাপের মূল পর্বে সুযোগ পাওয়া দলকে কতদূর নিতে পারবেন সেটাই এখন দেখার। কারণ রোনালদো নেইমারের মত উচ্চ মান সম্পন্ন খেলোয়াড় তার পাশে নেই। মেসির মত যা করার করতে হবে সালাহকেই।
আন্তর্জাতিক কিংবা ব্যক্তিগত কোন বড় সাফল্য না পেলেও এবারের বিশ্বকাপে মেসি ও রোনালদোর চেয়ে এগিয়ে রাখতে হচ্ছে নেইমারকে। সেটা তিনি ব্রাজিল দলের বলেই। ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে হলুদ জার্সির যেন একটা রক্তের বন্ধন আছে। যে জার্সিতে তারা হয়ে ওঠে আরো ভয়ঙ্কর, আরো ক্ষুধার্ত। তাছাড়া নেইমারকে দলে সহযোগিতা করবেন কুতিনহো-মার্সেলোরা-কাসিমিরো-জেসুস-পাওলিনহোর মত বিশ্বমানের সব তারকারা। ভাবতেই অবাক লাগে ফার্নান্দিনহো, ফিরমিনহোদের মত তারকাদের একাদশে সুযোগ পেতে রিতিমত লড়াই করতে হয়। বেঞ্চের একাদশ নিয়েই বিশ্বকাপের শক্ত একটি দল হওয়ার যোগ্যতা রাখে ব্রাজিল। রক্ষণ, মাঝমাঠ, আক্রমণ সব জায়গায়তেই একেবারে পরিপূর্ণ। হেক্সা জয়ের মিশনে থাকা এই দলের দায়ীত্বে আবার এমন একজন যার অধীনে ব্রাজিল এখনো অপরাজেয়। দলীয় রসায়নকেও অমায়ীক বন্ধনে বেধেছেন তিতে।
রাশিয়ায় কেমন ব্রাজিলকে দেখা যাবে তার কিছুটা নমুনা পাওয়া গেছে পরশু অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। তিন মাস পর একাদশে ফিরে নেইমার বুঝিয়েছেন শুধু তার উপস্থিতিতেই কেমন পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে একটি দল। সঙ্গে মার্সেলো-কুতিনহো-জেসুসরা তো ছিলেনই। রাশিয়াকে যেন তারা জানান দিয়ে রাখলেন- আমরা আসছি, তোমাদের আঙ্গিনায় ফুটবলের রং তুলিতে শীল্প রচনা করতে, মায়াময়ী ফুটবলে বিশ্বকে মুগ্ধতার জালে বাধতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন