সাখাওয়াত হোসেন : ঈদের কেনাকাটায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম জাল নোট। নতুন চকচকে ৫০০ অথবা ১ হাজার টাকার নোট দেখলেই নেড়েচেড়ে, হাতের আঙুলের আলতো ছোঁয়া লাগিয়ে তবেই ক্যাশবাক্সে ফেলছেন বিক্রেতারা। আর ক্রেতার মধ্যে কাজ করছে এক ধরনের আতংক। পাছে জাল টাকার বাহক হিসেবে ধরা পড়তে হয় কি না। গত দু’দিন রাজধানীর বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৭ জুন বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পুরো এক কোটি জাল টাকাসহ ১০ জন জাল টাকা কারবারিকে গ্রেফতার করে। এ সময় উদ্ধার করা হয় জাল টাকা তৈরির বিপুল পরিমান সরঞ্জাম।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য্য জানান, ঈদকে লক্ষ্য করে বাজারে ৫ কোটি টাকার জাল নোট ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল গ্রেফতারকৃতদের। এ ধরনের আরো আট-নয়টি জাল নোট তৈরির চক্র রয়েছে রাজধানীতে। কয়েকটি গ্রæপ ইতোমধ্যে গ্রেফতার হলেও বাকিদের বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জাল নোটের কারবারিদের দৌরাত্ম নিয়ন্ত্রনে বিপাকে পড়েছে প্রশাসন। এসব কারবারিরা বার বার আটক হলেও আইনের ফাঁক ফোকরের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে। ছাড়া পেয়ে আবার শুরু করছে তাদের অবৈধ কারবার। জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও ৮০ শতাংশ জামিনে মুক্তি পেয়ে পরবর্তী সময়ে আবারও নিয়োজিত হচ্ছে জাল নোটের ব্যবসায়। ঈদ এলেই তাদের সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সংস্থা ধারণা করছে, ঈদকে সামনে রেখে সারাদেশে প্রায় ৫০ কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা করেছে জাল নোট ব্যবসায়িরা। পুলিশ ও র্যাব মাদকবিরোধী অভিযানে ব্যস্ত থাকায় জালনোটের কারবারীরা ঈদকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২১০টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। আর ৪৬টি চক্র বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় জাল টাকা ছাড়ানোর কাজ করছে। রাজধানীতে সক্রিয় রয়েছে ২৫টি জাল টাকা জালিয়াত চক্র।
গত রোববার রাজধানীর নিউ মার্কেটে হালিমা আক্তার (৪৫) নামে এক গৃহবধূ একটি শাড়ি ক্রয় করেন ৭শ’ টাকা দিয়ে। দোকানদারকে এক হাজার টাকার নতুন দেয়ার পর অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয় তাকে। ওই মহিলা জানান, দোকান মালিক এক হাজার টাকার নোট নিয়ে পাশের একটি দোকানে যান নোটটি আসল না নকল সেটা পরিক্ষা করার জন্য। বেশ কিছু সময় পর ফিরে এসে ক্রেতাকে জানানো হয় নোটটি জাল নয়। পরে বাকী টাকা ও কাপড় নিয়ে ফিরে যান ওই মহিলা। ওই দোকানের মালিক আবুল কালাম জানান, ঈদের আগে জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে পড়া নতুন কিছু নয়। এর আগে নতুন নোট রেখে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তাই এবার আর কোন ঝুকি নিতে চান না তিনি। রাজধানীর মৌচাক, পলওয়েল, মালিবাগ ও বঙ্গবাজারসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। চক চকে নতুন ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট ক্রেতার কাছ থেকে দেয়া হলে এ নিয়ে এক ধরনের আতংক তৈরি হয়।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস) সহেলী ফেরদৌস দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে একাধিক চক্র সারাদেশেই জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি চক্রকে জাল টাকা ও জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ ধরনের যে সব চক্র এখনও ধরা পড়েনি তাদের গ্রেফতারে সারাদেশেই পুলিশ সক্রিয় রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাল টাকা নিয়ে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। জাল টাকা সংক্রান্ত কোন তথ্য পাওয়া গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করার জন্য সকলের কাছেই আহŸান জানিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোন ক্রেতা তার অজান্তের যদি জাল টাকা দোকান মালিককে দিয়ে যান তা হলে ওই দোকান মালিককে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। প্রশাসনসহ অনেকেই সন্দেহ করেন যে ওই দোকান মালিক জাল টাকা ব্যবসার সাথে জড়িত। নিজেকে ভাল প্রমান করতে অনেক দেনদরবার করতে হয়।
ষ্টেডিয়াম মার্কেটের জুবায়ের ট্টেডার্সের ম্যানেজার মজিবর রহমান জানান, এখনও জাল টাকা হাতে পরেনি। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ জন্য বাড়তি সর্তক থাকতে হয়। কোন ক্রেতা নতুন ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট দিলে তা সর্বোচ্চ সর্তকভাবে পরীক্ষা করেই গ্রহন করা হয়।
রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা সুপার মার্কেটের নিচতলার একটি তৈরি পোশাকের দোকানের ক্যাশবক্সের কাচের নিচে রাখা হয়েছে একটি ১ হাজার টাকার জাল নোট। ওই নোটে কয়েকটি বড় আকারের অংশ কেটে দেয়া হয়েছে। দোকানিরা জানান, ভিড়ের সময় জাল নোটের কারবারিরা আসল নোটের সঙ্গে গছিয়ে দিয়েছে। পরে ব্যাংক জাল নোট শনাক্ত করে নোটগুলো বাতিল করে দিয়েছে। এরপর সচেতনতার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ওই দোকানে মালিক মাসুম মিয়া জানান, জাল নোট আতঙ্ক সবার মধ্যে আছে। একটি জাল নোট মানে পুরোটাই ক্ষতি। তার ওপর নানান হয়রানি তো আছেই।
রাজধানীর খিলগাঁও রূপালী ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় ২০হাজার টাকার চেক দেন সোহরা আক্তার। ব্যাংকের কর্মকর্তা চক চকে ১০০০ টাকার ২০টি নোট দিলে তিনি পুরাতন টাকার দেয়ার জন্য বলেন। এ সময় ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আপা ঈদের সময় এসেছেন তাই নতুন টাকা দিয়েছি। সোহরা আক্তার এ সময় বলেন, নতুন টাকা নিয়ে কোন ঝামেলায় পড়তে চাই না। আসল আর নকল শনাক্ত করার ঝামেলার চেয়ে পুরাতন টাকাই নিরাপদ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন