নানা ঘটন-অঘটন আর চমকের মাধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপের প্রাক-কোয়ার্টার ফাইনাল পর্বের লড়াই। আসর থেকে সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও স্পেনের বিদায় যেমন ছিল ফুটবল প্রেমীদের কাছে অপ্রত্যাশিত; তেমনি চমক হয়ে এসেছে র্যাঙ্কিংয়ের সর্বনি¤œ দল হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া স্বাগতিক রাশিয়ার শেষ আটে জায়গা করে নেওয়ার খবর। এরপরও বলতে হয়, বিশ্বকাপ যোগ্য আট দলকেই বেছে নিয়েছে পরবর্তি রাউন্ডের জন্য।
রাশিয়ায় অঘটনের শুরু সেই গ্রæপ পর্ব থেকেই; টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বজয়ের অভিলাষ নিয়ে রাশিয়ার পা রাখা প্রতাপশালী জার্মানির বিদায়ের মাধ্যমে। একই পর্বে ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনা কোনমতে নক-আউট পর্বে এসে বিশ্ববাসীকে হতাশ করে। সেইসঙ্গে শেষ হয় লিওনেল মেসি নামক ফুটবল রাজকুমারের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। একই বাস্তবতার শিকার হন সময়ের আরেক সেরা তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও। বিশ্বজয়ী দল না হলেও ইউরোজয়ী হিসেবে শেষ ষোলর বাধা টপকাতে না পারা তো অপ্রত্যাশিতই।
আসরের ফেভারিট হিসেবে খেলতে নামা ব্রাজিল, ফ্রান্সও যে শুরুর দিকে ভক্তদের মন ভরাতে পেরেছিল তা বলা যাবে না। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঠিকই আপন ধারায় ফিরেছে তাদের ফুটবল। শিরোপার শক্ত দাবিও জানিয়ে রেখেছে তারা। দলীয় সংহতির ফলস্বরুপ শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, সুইডেনের মত দল। হ্যারি কেইনে উজ্জিবিত ইংল্যান্ড। ওদিকে সুয়ারেজ-কাভানিদের দারুণ ফর্ম স্বপ্ন দেখাচ্ছে দুবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকেও। শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাওয়া কোয়ার্টার ফাইনাল তাই যে নতুন রোমাঞ্চের অপেক্ষায় একথা বলা যেতেই পারে।
ফেভারিট হিসেবে খেলতে নামা আর্জেন্টিনা ও স্পেন বিদায় নিলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ফুটবল ভক্তদের মন ভরাতে পারেনি তারা। টুর্নামেন্টের আগে থেকেই কোচ হোর্হে সাম্পাওলির বিতর্কিত সব কান্ড আর্জেন্টিনকে অনিশ্চিয়তার শঙ্কায় ফেলে দেয়। বিশ্বকাপের মত আসরে এসেও ম্যাচের ছক ও একাদশ নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকতে দেখা গেছে তাকে। আসরে চার ম্যাচেই তিনি নামিয়েছেন ভিন্ন একাদশ, পরিকল্পনাও ছিল ভিন্ন। এমন ভঙ্গুর দশায় দল যে বেশিদুর এগুতে পারবে না তা অনুমিতই ছিল। তবু বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় দল ও একই সঙ্গে সেরা খেলোয়াড়ের বিদায়ে কিছুটা হলেও রং হারায় বিশ্বকাপ। স্পেনের টিকিটাকাও যে ভক্তদের মন ভরাতে পেরেছে তা বলা যাবে না। ফলস্বরুপ আগেভাগেই দেশের বিমান ধরতে হয়েছে ২০১০ বিশ্বকাপজয়ীদের।
দলের বিদায়ের সঙ্গে কিছু কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের বিদায়ও দেখেছে নক আউট পর্ব। রাশিয়ার কাছে টাইব্রেকার ভাগ্যে পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হয় সময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। স্পেনের ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো নামক ট্রেবলজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। ফুটবলের নাড়ি-নক্ষত্র যারা বোঝেন তাদের কাছে সাবেক বার্সেলোনা কিংবদন্তিকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তার মত এমন নিঁখুত মিডফিল্ডার খুব কমই দেখেছে ফুটবল বিশ্ব।
ইনিয়েস্তার মত আরো এক মাঝমাঠের যোদ্ধাকে বিদায় বলেছে রাশিয়া। তিনি ইনিয়েস্তারই এক সময়ের ক্লাব সতীর্থ। কিংবদন্তি না হলেও তাকে অনেকদিন মনে রাখবে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। আর্জেন্টিনাকে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে নেয়ার অন্যতম সেই কারিগরের নাম হাভিয়ের মাচেরানো। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফ্রান্সের কাছে সোচনীয় পরাজয়ের পরই প্রিয় আকাশী-সাদা জার্সি খুলে রাখেন।
ফুটবলে খুব বেশি আলো না ছড়ালেও আরো একজনের নাম আলাদাভাবে বলতেই হয়- মেক্সিকোর রাফায়েল মার্কুয়েজ। ব্রাজিলের কাছে পরাজয়ের পর আর্ন্তজাতিক ফুটবলকে বিদায় বলে দেন ৩৯ বছর বয়সী ডিফেন্ডার। ইতিহাস তাকে মনে রাখবে তৃতীয় ফুটবলার হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার কারণে।
শুধু বিদায়ের করুণ সুর নয়, রোমাঞ্চের ঝঙ্কারও দেখা গেছে নিজনি নভগোদোর-সামারা-সেন্ট পিটার্সবার্গে। এই পর্বেই তো দেখা মিলেছে ৬০ বছর পর নক আউট পর্বে ১৯ বছর বয়সে কিলিয়ান এমবাপের জোড়া গোলের কীর্তি। ৪৮ বছরের ঐতিহাসিক ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে ২-০ গোলে পিছিয়ে থেকেও বেলজিয়ামের দুর্দান্ত ঘুরে দাঁড়ানো জয়ের সাক্ষি তো এই পর্বই। আর ম্যাচের শুরু ও শেষের পেনাল্টি নাটকে রোমাঞ্চিত ডেনমার্কের বিপক্ষে ক্রোয়েশিয়ার ¯œায়ুক্ষয়ী জয়ের আবহ থেকে বের হতে একটু সময় লাগবে বৈকি।
সময়ের সেরা দুই তারকাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ কিছুটা রং হয়ত হারিয়েছে, কিন্তু তাদের অভাব পূরণ করতেই যেন নতুনভাবে জানান দিচ্ছেন কিলিয়ান এমবাপে, নেইমার, কুতিনহোরা। ফেভারিট না হয়েও দলীয় আগ্রাসনে প্রতিপক্ষের ভয়ের কারণ হচ্ছে বেলজিয়াম, উরুগুয়ে, ক্রোয়েশিয়ার মত দল। তরুণে বলিয়ান ফ্রান্স আটানম্বইকে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেলেসাও ফুটবলও নাচছে সাম্বার ছন্দে। রাশিয়াকে মাতাতে আর কি লাগে!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন