সরকারের নীতিমালা সঠিক বাস্তবায়নের অভাব এবং কতিপয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের ৩শ’ ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এটি চলমান বোরো মৌসুমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মুনাফার টাকা।
জানা যায়, গত ১০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারন কমিটির এক সভায় কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে তা সম্ভব হয়নি। এ সভায় প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার টন ধান এবং ৩৮ টাকা কেজি দরে ৯ লাখ টন চাল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রায় ১ কোটি ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয়েছে। সরকারী হিসেব মতে সারাদেশে ২ কোটি ৫ হাজার কার্ডধারী কৃষক রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১ কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক।
কৃষিবিদ কবির আহম্মদ ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকই বর্গাচাষি। তারা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে চাষাবাদ করছে। ধান কাটার পরেই ঐ দাদন ব্যবসায়ীরা হাজির হয় কৃষকের বাড়ীতে। কৃষক আবারও দাদন পাওয়ার আশায় বাধ্য হয়ে কম দরে ধান বিক্রি করছে তাদের কাছে। সরকার কৃষকের কাছে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিলেও তাতে কৃষকের কোন লাভ হচ্ছে না। ঋণদাতাদের কাছেই ধান বিক্রিতে তারা বাধ্য। কখনো সরকার কৃষকের কাছে ধান ক্রয় করতে পারবে না। সরকার বাধ্য হয়ে এ মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে ক্রয় করছে। সরকার ঘোষিত কৃষকের মুনাফা যাচ্ছে কার কাছে সেটি এখন লক্ষ্যণীয়।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে কেজি প্রতি বোরো ধান উৎপাদনে ২৪ টাকা এবং ৩৬ টাকা খরচ হয়েছে। কৃষকের কেজি প্রতি চাল উৎপাদন খরচ পড়ছে ৩৬ টাকা আর সরকার ক্রয় করছে ৩৮ টাকা দরে। এখানে ধান চালের ক্রয়ের মাঝে ৩/৪ টাকার পার্থক্য রয়েছে। এ টাকাই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভাগীর পকেটে এবং মিল মালিকের কাছে। এটির যোগফল দাঁড়ায় ৩শ’ ৬০ কোটি টাকা। দাদন ও মহাজনরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দরে চাল, ধান ক্রয় করে নিয়েছে। এতে সরকারের সংগ্রহ মূল্য বাড়লেও উৎপাদনকারী কৃষকরা এ লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চলতি বোরো সংগ্রহ মৌসুমে গতবছরের সংগ্রহ মূল্য বাড়িয়ে কেজি প্রতি চাল ৩৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় সরকার ১০ লাখ টন বোরো ধান চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এর মধ্যে ৮ লাখ সিদ্ধ চাল, ১ লাখ টন আতপ চাল এবং দেড় লাখ টন বোরো ধান।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রতি মন ধান ৮শ’ টাকা থেকে ৮শ’ ৫০ টাকা এবং উত্তরাঞ্চলে ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। মোটা চাল প্রতি কেজি ৪০/৪১ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মোটা চাল সরকারী ক্রয়মূল্য ৩৮ টাকা। এতে দেখা যায়, সরকারী সংগ্রহ মূল্য অনুযায়ী কৃষকরা প্রতি মণ ধানে ২০০/২২০ টাকা কম পাচ্ছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারী কার্ডধারী একজন কৃষক ৮০ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন পর্যন্ত ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারবেন। অধিক সংখ্যক কৃষককে সুযোগ দিতে সরকারের এ উদ্যোগ। সে হিসেবে একজন কৃষকের কাছ থেকে ৫০০ কেজি করে ধান ক্রয় করলে ১৪ লাখ, ১ টন করে ধান ক্রয় করলে ৭ লাখ এবং ৩ টন করে ক্রয় করলে ২ লাখ ৩৪ হাজার কৃষক সরকারী সুযোগের আওতায় পড়বেন।
বিগত বছরগুলোতে সর্বোচ্চ ১ লাখ টন ধান ক্রয় করেছে খাদ্য বিভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পায় না, তাই ধান চাষে উৎসাহ হারাচ্ছে। কৃষকদের প্রণোদনা দিতে এবং মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমাতে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রদত্ত তালিকা মতে স্থায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করার কথা ছিলো সরকারের। কৃষকের নাম, পরিচয়পত্র, স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দ্বারা প্রত্যায়িত জমির খতিয়ান নাম্বার, জমির আয়তনের ভিত্তিতে উৎপাদনের পরিমাণ -এ সবের ভিত্তিতে একাউন্ট পেয়ী চেকের মাধ্যমে কৃষকের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার নিয়ম এখনও বহাল রয়েছে। চেক প্রদানের আগেই উপরোক্ত সবকিছু যাচাই-বাছাই করবেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা। সরকারের নীতিমালার পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে কৃষক হয়তো কিছুটা উপকৃত হবে এমনটি আশা করেন সাধারণ কৃষক। সরকারী নীতিমালা বহাল থাকলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন না করায় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে হত দরিদ্র কৃষক। লাভবান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দাদন ব্যবসায়ী, মিল মালিক, ফড়িয়া, সরকারী কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
এ বিষয়ে সরকার যত আন্তরিক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তত আন্তরিক নয় এমটি মনে করেন এমপি মোহাম্মদ নোমান। তিনি বলেন, এটি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে জনপ্রতিনিধি, কৃষি বিভাগ ও খাদ্য বিভাগের সমন্বয়ে সেল গঠন করে বাস্তবায়ন করলে প্রকৃত কৃষকরা উপকৃত হবে। উৎপাদনে বড় সাফল্য আসবে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন