শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কৃষকদের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করে উৎপাদনে জোয়ার আনতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

গবাদি পশুপালনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এক সময় প্রচুর গবাদি পশু ভারত-মিয়ানমার থেকে আমদানি হতো। যত আমদানি হতো, তার থেকে অনেক বেশি চোরাই পথে আসতো। বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বৈধাবৈধ পথে দেশের বাইরে চলে যেতো। হঠাৎ ভারত গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে ভারতের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হওয়ায় বাংলাদেশ বিপাকে পড়ে যায়। ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে পশুপালন এবং গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার খামার গড়ে তোলার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। পোল্ট্রি খামার করারও জোয়ার আসে। ফলে, কয়েক বছরের মধ্যেই গবাদি পশু ও গোশতের দিক থেকে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ডিম-দুধের উৎপাদনও অনেক বেড়ে যায়। এই যে প্রাণীজ আমিষ ও ডিম-দুধের প্রাচুর্য আসে, তা মূলত কৃষক ও খামারিদের অবদান। সরকার সহযোগিতার ভূমিকা পালন করে। সেই কৃষক ও খামারিরা এখন ঘোরতর সঙ্কটে পতিত হয়েছে। তাদের হাতে টাকা নেই। গবাদি পশুর খাদ্যের অভাব ও উচ্চমূল্য এবং শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়ায় পশু বাঁচিয়ে রাখা বা খামার টেকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন চর এলাকায় গড়ে তোলা হাজার হাজার গবাদি পশুর খামারে চলছে হাহাকার অবস্থা। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মড়ার ওপর খাড়ার ঘা বসিয়ে দিয়েছে। ফসলাদি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমতাবস্থায়, কৃষক ও খামারিরা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছে। এখনই যদি তাদের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না দেয়া যায়, তবে খামারগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, ব্যক্তি পর্যায়ের পশুপালন বন্ধ হয়ে যাবে। আর এটা হলে গবাদি পশু বা গোশতে প্রায় স্বনির্ভর হওয়ার অবস্থা থেকে আমরা অনেক পেছনে চলে যাব। কৃষি অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নেমে আসবে। গোশত-দুধ ইত্যাদির দাম মানুষের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে চলে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত কিছুদিন ধরে লাগাতার বলে আসছেন, আগামীতে দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তার এ সতর্কবাণী যথার্থ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। ফাও’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মন্দার কারণে বিশ্বজুড়েই খাদ্যোৎপাদন কমবে। বিভিন্ন সংস্থার তরফে এমন আশংকাও ব্যক্ত করা হয়েছে, বিশ্বে খাদ্যোৎপাদনে বিরূপ প্রভাব এতটাই পড়বে যে, অনেক দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দেবে। ইতোমধ্যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে প্রচÐ খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে খাদ্যোৎপাদনে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জিত হলেও গত কয়েক মওসুমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বিপর্যয়ে উৎপাদনলক্ষ্য অনর্জিত রয়েছে। খাদ্য সংগ্রহলক্ষ্য পূরণ হয়নি। খাদ্যের মজুদ উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। সরকারি তরফে খাদ্যোৎপাদনে বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার যত দাবিই করা হোক, সে দাবি বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। দেশ যদি খাদ্যোস্বয়ম্ভরতা অর্জন করে থাকে, তবে প্রতিবছর লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয় কেন? ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্য নিরাপত্তা রীতিমত হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বাড়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারেও দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সাধারণ ও সীমিত আয়ের মানুষের বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি ইত্যাদি পণ্যের দাম বাড়ছেই। সরকার আমদানির চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কটে আমদানি ব্যহত হচ্ছে। অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। অর্থাভাবে শিল্পের কাঁচামাল পর্যন্ত আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে উৎপাদন হ্রাস ও শিল্প বন্ধ হওয়ার আশংকা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ওদিকে সার সঙ্কটে কৃষি উৎপাদনে বড় রকমে মার খাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটে সার আমদানিও করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী যখন বারবার বলছেন, খাদ্যোৎপাদন বাড়াতে হবে, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না, তখন বিদ্যুতের অভাব, তেলের উচ্চমূল্য এবং সার সঙ্কটে কৃষক নাকাল, দিশেহারা। কৃষি উপকরণের যোগান পর্যাপ্ত, মসৃণ এবং দাম সস্তা না হলে উৎপাদন বৃদ্ধি কীভাবে আশা করা যায়?

কৃষির ওপর দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত বিশেষভাবে নির্ভর করে। কৃষি মানে ধান-গম ইত্যাদি খাদ্যশস্যের উৎপাদন নয়; মৎস্য চাষ, গবাদী পশু পালন, পোল্ট্রি, তরিতরকারি, শাক-সবজির আবাদ সব কিছুই কৃষির অন্তর্ভুক্ত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতির বর্তমান সঙ্কট উত্তোরণে কৃষিই আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন হতে পারে। কাজেই, কৃষির প্রতি অধিক নজর দিতে হবে, কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ধানচাষি, মাছচাষি, সবজিচাষি, গবাদি পশুপালনকারী, পোল্ট্রিখামারি কারো হাতেই নেই প্রয়োজনীয় অর্থ। তাদের জন্য অর্থের সংস্থান করতে হবে। উপকরণ ও অর্থ পেলে তারা তাদের চাষ-আবাদ-উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। সরকারের উচিত কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, উপকরণ সাপোর্ট দরকার, তা নির্ণয় করা ও যোগান নিশ্চিত করা। এনজিওগুলো কৃষকদের সহয়াতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যান্য সোর্স থেকেও অর্থের সংস্থান করা যেতে পারে। খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। কৃষি উৎপাদন বাড়লে খাদ্যের সরবরাহ বাড়বে, কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের কাঁচামালের যোগান নিশ্চিত হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, গণমানুষের জীবনযাত্রা সহজ ও নিরাপদ হবে। অতএব, কৃষি উৎপাদনে জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন