কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক নদীই এখন শুকনো ধু ধু প্রান্তর। বুড়িগঙ্গার পানি হয়েছে আরো বেশি ঘোলাটে। মানুষের আবেগ-অনুভ‚তিগুলো কত সাবেক হয়ে গেছে। যেমনটি হয়েছেন দেশের ফুটবলের নক্ষত্ররা। ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠ এখন যেন স্রোতবিহীন নদী।
আশির দশকে সেইদিনগুলো...
ফুটবল রক্তের সাথে মিশে আছে আমাদের। শ্রাবণ দিনের বর্ষণমুখর সময়ে ফুটবল খেলে গায়ে কাদার মাখামাখি করেননি এমন মানুষ মেলা ভার। স্বাধীনতার পর দেশে মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে বড় জায়গাটি ছিল ফুটবল। সর্বত্র মানুষের তর্ক-বিতর্কে চায়ের দোকান পাড়া-মহল্লায় সকলের হৃদয়জুড়েই ফুটবল একটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল।
স্কুল-কলেজের ছেলে -মেয়েরা একজন আরেকজনকে খোঁচা দিত প্রতিপক্ষের নামে। কেউ আবাহনীর সমর্থক হলে বলত, ‘ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, মোহামেডান ভিক্ষা করে আবাহনীর বাড়ি’। আবার মোহামেডানের সমর্থকরা এর উল্টোটা বলত।
মোটামুটি সবার কাছেই ফুটবল ছিল জনপ্রিয়। বিকেলের শেষ আলো মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খেলা চলত সবার। ৫ নাম্বার সাইজের ‘মিকাসা’ বল যার কাছে ছিল পাড়ার মধ্যে সেই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপ‚র্ণ ব্যক্তি। তার সাথে সবার ভাব ভালো ছিল। সেই ছেলেটির সাথে মিশে মিকাসা বল দিয়ে খেলতে চাইত সবাই। এমনটাই ছিল সেই সময়কার দিনগুলো। ফুটবলের পাগলামি এতটাই যে সেই সময় ফুটবল নিয়ে গানও তৈরি হয়েছে বাংলা সিনেমায়। ‘জয় আবাহনী, জয় মোহামেডান’ গানটাও সবার মুখে মুখে তখন।
এখন আমরা দলবেঁধে ক্রিকেট খেলা দেখি। বাংলাদেশ জিতে গেলে সবাই মিলে ভিষণ হইচই হয়। এলাকার ছেলেরা মিলে পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে। আশির দশকেও এই উন্মাদনা হতো। সেটি ফুটবল নিয়ে। এলাকায় এপাড়া-ওপাড়া মিলে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন হয়। সব বয়সের মানুষ জড়ো হয় খেলা দেখার জন্য। এলাকায় ফয়জল ভাই নামে একজন ছিলেন। যদিও তিনি বয়সে অনেক বড়। আশির দশকে গ্রামের এক ফুটবল টুর্নামেন্টে গোল দিয়ে তিনি ব্যাপক সুনাম কুড়ান। তিনি যেই মেয়েটিকে পছন্দ করতেন, সেই মেয়েটিও খেলা দেখতে এসেছিল। ফয়জল ভাইকে মেয়েটি শর্ত দিয়েছিলেন গ্রামের হয়ে এই কাপ জিততে পারলে মেয়েটি তাকে বিয়ে করবে। এখন ফয়জল ভাইয়ের দুই ছেলে এক মেয়ে। আর সেই মেয়েটি তিন সন্তানের জননী। এসব হচ্ছে সেই সোনালি সময়ের কথা। ফুটবল তখন এতটাই জীবনের সাথে মিশে গিয়েছিল।
আবাহনী মোহামেডান দ্বৈরথ...
বাচ্চু মিয়া ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসায় করেন। আজ অবশ্য তিনি দোকান বন্ধ রেখেছেন। বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা। সে সময় বাংলা সিনেমায় ‘আবাহনী আবাহনী মোহামেডান, কেউ হারে কেউ জেতে সমান সমান’ গান বেশ জনপ্রিয় ছিল। গানটি ফিরছিল সবার মুখে মুখে। বাচ্চু মিয়া ছিলেন মোহামেডানের সাপোর্টার। বীর মহসীনকে বেশি পছন্দ করতেন। এই ছেলেটা গোলপোস্টের সামনে একাই পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
চায়ের দোকানদার শফিক আলীর মনমেজাজ আজকে অন্য দিনের চেয়ে বেশি ভালো। তার চেহারা চকচক করছে। খেলা উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরে তার দোকানে সবসময় ভিড় লেগে আছে। ম্যাচ যদিও আজকে, তবুও ম্যাচের এক সপ্তাহ আগে থেকে মানুষের আগ্রহের সীম নেই। এই তো গতকাল বড় বাজারের মিয়া বাড়ির দুই ভাই মারামারি লেগে গিয়েছিল। সম্পর্কে ভাই হলেও খেলার ব্যাপারে কেউ কাউকে ছাড় দেন না। বড়ভাই আবাহনীর স্ট্রাইকার আসলামের ভক্ত। ছোট ভাই আবার মোহামেডান ডিফেন্ডার কায়সার হামিদের ভক্ত। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে একসময় তারা হাতাহাতি শুরু করে দিলেন।
রাশুরা সবাই ক্লাস টেনে পড়ে। আবাহনী-মোহামেডানের খেলা। সবাই পতাকা লাগাচ্ছে। কে কার থেকে বড় পতাকা উড়াবে এ নিয়ে ভীষণ প্রতিযোগিতা। গতবার এলাকায় আবাহনীর সবচেয়ে বড় পতাকা উড়িয়েছিল ওরা। এইবার ওই পাড়ায় মুন্নারা মোহামেডানের সবচেয়ে পতাকা লাগাবে বলে উড়া উড়া খবর পাওয়া যাচ্ছিল। খেলার আগেই পুরো শহর পতাকার ছায়াতলে। সেলাই শিল্পীরা পতাকা সেলাই এ ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এদিকে সারাদিন অপেক্ষা করেও ম্যাচের একটা টিকিটও কিনতে পারেনি সাব্বির। ফুটবলটা তার বড় ভালো লাগে। সেও চায় বাংলার ম্যারাডোনা খ্যাত ওয়ালি সাব্বিরের মতো খেলোয়াড় হতে। বিদেশি খেলোয়াড় এমেকার খেলাও তার খুব পছন্দ। অথচ সে খেলা দেখতে যেতেই পারবে না। টিকিটের জন্য গতকাল মারামারি হয়েছে। আবাহনী-মোহামেডান খেলার টিকিট পাওয়া মানে মোটামুটি বিশ্বজয় করে ফেলার কাছাকাছি কিছু একটা। ব্যাংকে কিছু টিকিট আছে বলে সে শুনেছে। ঠিক করেছে যদি টিকিট পায় প্রয়োজনে তিনগুণ বেশি দাম দিয়ে হলেও টিকিট নিয়ে খেলাটা দেখবে। মোহামেডানের খেলা মিস করা সম্ভব নয়।
এই খÐচিত্রগুলো আশি-নব্বই দশকের নিয়মিত চিত্র। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ আবাহনী কিংবা মোহামেডানের সমর্থক ছিলেন। মাঠেও দুই দলের খেলোয়াড়রা যেন খেলা নয় যুদ্ধে নামতেন। সাজ সাজ রব চারিদিকে। মাঠের উত্তাপ বাইরে ছড়িয়ে পড়ত। এই দুই চিরপ্রতিদ্ব›দ্বীর খেলা হলে মানুষ ও দুই ভাগ হয়ে যেত। নিজ দলকে এরা সমর্থন দিতেন পাগলের মতো। এখন আমরা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল কিংবা বার্সা-রিয়ালের ম্যাচ হলে যেমনটা করি, তার চেয়েও বেশিই উন্মাদনা ছিলে তখন। কোনো কোনো দিন মাঠে হাঙ্গামা বা মারামারি হলে এর রেশ ছড়াত মাঠের বাইরেও। পল্টন-গুলিস্তান বাইতুল মোকাররমের আশেপাশে রণক্ষেত্র তৈরি হতো। এমনই গরম ছিল দেশের ফুটবল।
শূন্য মাঠ এবং প্রাণহীন ফুটবল
আইসিসির সদস্যপদ পেয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়া জগতের এক নবযাত্রার শুরু হয়। ক্রিকেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ফুটবল এক বর্ষার ‘পার্টটাইম’ শখের খেলা হয়েই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এর বদলে ব্যাট, স্ট্যাম্প আর টেপ-টেনিসের রাজত্ব শুরু হয়েছে।
ক্রিকেটের উত্থান যতটা না ফুটবলের জনপ্রিয়তা হারিয়ে যাওয়ার কারণ, তার চেয়ে বেশি দায়ী ফুটবল অবকাঠামো এবং ভালো মানের খেলোয়াড় উঠে না আসা।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে লিগে বিদেশি খেলোয়াড় কোটা বন্ধ করা হয়েছিল। সেবার দর্শকরা তেমন আগ্রহ দেখাননি, মাঠে আসেননি খেলা দেখতে। সেই থেকেই দর্শক খরার শুরু ঢাকা লিগে। এ ছাড়া মিরপুর স্টেডিয়ামকে ক্রিকেটের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে দেশের তারকা ফুটবলাররাও অবসর নিতে শুরু করলেন, কেউ কেউ দলে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছিলেন। এই তারকা সঙ্কট আর কাটিয়ে উঠতে পারল না বাংলাদেশের ফুটবল। ফুটবলারদের পারিশ্রমিক কমে গেল, স্পন্সররা ফুটবলে আগের মতো সহযোগিতা করছেন না। অথচ ৮৬-৮৯ সালেই সাড়া জাগানো ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। এই সময়টায় তার পারিশ্রমিক উঠানামা করেছিল ১০ থেকে ১৫ লাখে!
স্কুল ফুটবল থেকে শুরু করে জাতীয় লিগ ফুটবল কোনোটিই ঠিক পথে চলছে না। ভালো ফুটবলের প্রদর্শনী করতে পারছেন না খেলোয়াড়রা। ক্লাব ফুটবলের আমেজ নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। একসময় দলবদলের সময় সবাই চোখ-কান খোলা রাখতেন কে কোন দলের হয়ে খেলছে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলত। এখন দলবদল হয় অনেকটা দায়সারা গোছের। ফুটবলকে পেশা হিসেবে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটাও যুগের সাথে যাচ্ছে না। যখন সব অর্থকরি নিয়ে ক্রিকেটারদের পেছনে ছুটছে স্পন্সর থেকে হর্তাকর্তারা। ফুটবলের মাঠে এখন আর বিনা টিকিটেও দর্শকের দেখা মেলে না। ফুটবলের রুপকথা যেনো আজ চুপ কথা হয়ে গেছে।
মনে রবে কি না রবে ফুটবলের
দেশের ফুটবলের সোনালি দিনের কীর্তির ইতিহাস আজ পরিহাসে রূপ নিয়েছে। সবাই যখন যখন কোপা, ইউরো অথবা লিগের রিয়াল-বার্সা কিংবা নয়া ইংলিশ রুপকথা লেখা লেস্টার সিটিকে নিয়ে মুগ্ধ হওয়ার মাতম তুলছে, তখন সত্যিই মন খারাপ হয় নিজের দেশীয় ফুটবল অতীতের কথা ভেবে। এই প্রজন্ম দেশের ফুটবলের দৈন্যদশা দেখছে। তাই ফুটবলপ্রেমী হিসেবে হয়তো বিদেশি লিগ দেখে ফুটবলীয় ক্ষুধা মেটাচ্ছেন সবাই। দেশের ফুটবলের আগের সেই জনপ্রিয়তা, এসব এখন শুধুই স্মৃতি। তাহলে একসময় কি তবে দেশের ফুটবলের ইতিহাস মুছেই যাবে ফুটবলের এই দৈন্যদশার আড়ালে অথবা বিদেশি লিগের জনপ্রিয়তায়?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন