(পূর্বে প্রকাশিতের পর) আর ‘ধূর্তামী, প্রবঞ্চনা ও প্রতারণার স্থান জাহান্নামে। এটি আল্লামা তাবারানী ‘কাবীর, ও ‘সাগীর’ গ্রন্থদ্বয়ে উত্তম সনদসূত্রে বর্ণনা করেছেন এবং আবূ দাউদ তাঁর ‘মারাসীল’ এ হাসান (রা.) থেকে মুরসাল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যার সংক্ষেপ, তিনি বলেন, ধূর্তামী, প্রতারণা ও খিয়ানতের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। (আল্লামা মুনযিরী (র.) এর তারগীব ও তারহীব গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)
অনুরূপভাবে হাদীস শরীফে এসেছে- “মুমিনগণ পরস্পর একে অন্যের হিতাকাঙ্খী হয়ে থাকে ; যদিও তাদের বাড়ীঘর ও দৈহিক অবস্থান দূরে দূরে হোক। আর পাপাচারী লোকজন পরস্পর একে অপরকে প্রতারিত করে থাকে ; যদিও তাদের বাড়ীঘর ও দৈহিক অবস্থান কাছাকাছি হোক না কেন। এটি শায়খ ইবনে হাব্বাম তাঁর ‘ভর্ৎসনা’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। (তারগীব)
অনুরূপভাবে সহীহ বুখারীর একটি হাদীসের কিছু বাক্যে এমনটি এসেছে- “অন্যতম বড় অপবাদ হচ্ছে, কোন ব্যক্তি তার পিতাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে পিতার স্থলে অধিষ্ঠিত করে এবং সে তার নিজেকে এমন কিছু প্রমাণ করতে চায়, বাস্তবে যা সে নয় বা তার মধ্যে নেই। অথবা মহানবী (সা:) এর সম্পর্কে এমন কিছু বলে, যা তিনি (সা:) বলেননি। (বুখারী : খ-১, পৃ-৪৯৮)
(তিন) : তৃতীয় অবস্থা বা ক্ষেত্র হচ্ছে, কেবল সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে কালো খেযাব ব্যবহার করা। যেন নিজ স্ত্রীর সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে গবেষণাকেন্দ্রিক মতভেদ হয়েছে। অধিকাংশ ইমাম ও বিশেষজ্ঞগণ এটাকে মাকরূহ বলে থাকেন। ইমাম আবূ ইউসূফ (র.) ও কোন কোন বিশেষজ্ঞ এটিকে জায়েয বা বলে থাকেন। যারা তা মাকরূহ বলেন, তাঁদের দলীল হচ্ছে মুসলিম শরীফের একটি হাদীস যার অংশবিশেষ হচ্ছে-
“চুলের এ শুভ্রতাকে কোন বস্তু দ্বারা পরিবর্তন করে দাও এবং কালো রঙ থেকে বেঁচে থাকো।” (প্রাগুক্ত : যাদুল মা’আদ সূত্রে)
একইভাবে সহীহ সূত্রে হযরত ইবন আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা:) বলেছেন- “শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায় হবে যারা কালো খেযাব ব্যবহার করবে এবং তারা বেহেশতের ঘ্রাণ পাবে না। (তারগীব) আর যারা জায়েয বলেন, তাঁরা কোন কোন সাহাবীর ফাতওয়াকে এবং পরস্পর চলে আসা (তা‘আমুল) বাস্তব আমলকে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন। আলোচিত নিষেধ সম্পর্কিত হাদীস বিষয়ে এরা বলেন, “নিষেধাজ্ঞা সেক্ষেত্রে প্রয়োজ্য যেখানে প্রতারণা প্রবঞ্চনা লক্ষ্য হয়ে থাকে। সাহাবাগণের যাঁদের বেলায় কালো খেযাব ব্যবহারের কথা বর্ণিত হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হযরত হাসান (রা.) ও হযরত হুসাইন (রা.) অন্তর্ভূক্ত রয়েছেন। এটি ইবনে জারীর (র.) ‘তাহযীবুল আছার’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। (যাদুল মা‘আদ : সূত্রে-জাওয়াহিরুল ফিকহে)
একইভাবে হাদীস শরীফে হযরত উসমান ইবন আফ্ফান (রা.) আব্দুল্লাহ ইবন জাফর সা’দ ইবন আবু ওয়াককাস (রা:) ওকবা ইবন আমের (রা:), মুগীরা ইবন শো’বা (রা), জারীর ইবন আব্দুল্লাহ (রা:), আমর ইবনুল আস (রা:) প্রমুখ সম্পর্কে এমনটিই উদ্ধৃত হয়েছে। আর ইমাম আবু ইউসুফ (রা) এসব সাহাবী মনীষীগণের পারস্পরিক কৃত আমল সামনে রেখেই সেটিকে বৈধতার দলীল গন্য করে বলে থাকেন- “যেমনটি আমার কাছে প্রিয় যে, সে (স্ত্রী) আমার মনরঞ্জনের লক্ষ্যে সাজগোজ করুক ; তার কাছেও এটি প্রিয় যে, আমি তার মন তুষ্টির লক্ষ্যে যেন সাজগোজ করি। (শামী : অধ্যায় : কারাহিয়াত, খ-৫, পৃ-২৯৫)
আলমগীরীতে রয়েছে, “যে ব্যক্তি তেমনটি (কালো খেযাব ব্যবহার) করবে তার নিজেকে (অন্য) নারীদের প্রতি আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে এবং তাদের প্রেম-প্রীতি বৃদ্ধির জন্য-তাহলে সেটা মাকরূহ। বিশেষজ্ঞগণ সাধারণত এ মত পোষণ করেন। আবার তাঁদের কেউ কেউ এটাকে মাকরূহ ছাড়াই জায়েয বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। ইমাম আবু ইউসূফ (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যেমনটি স্ত্রী আমার উদ্দেশ্যে সাজগোজ করুক, তা আমার কাছে প্রিয় ; তেমনি আমি তার জন্যে সাজগোজ করি, সেটিও তার কাছে প্রিয়।” ‘যখীরা’ গন্থে এমনটি বিদ্যমান। (আলমগীরী : খ-৫, পৃ-৩৫৯)
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞগণ মারফূ‘ ‘হাদীসগুলোকে আসল ধরে দলীল হিসাবে পেশ করেছেন এবং উপরে আলোচিত বিশিষ্ট সাহাবাগণের অনুসৃত আমলের জবাবে বলেছেন, এদের কালো খেযাব ব্যবহার শুধু কালো ছিল না বরং লালের সাথে কালো মিশ্রিত কালো ছিল। নতুবা তা কিভাবে হতে পারে যে, হাদীসের নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর ধমক সত্তে¡ও এঁরা তার বিরোধিতা করতে পারেন। এ কারণে ব্যাপক আমল ও ফাতওয়াদানের ক্ষেত্রে সতর্কতা হচ্ছে এটাই যে, একেবারে কালো খেযাব কেবল গাজী সৈনিকদের ক্ষেত্রেই জায়েয এবং অন্যদের বেলায় তা মাকরূহ। (সূত্র : মুফতী শফী (র.) ১৩৫১ হিজরী)
খেযাব ও ইমামতি :- প্রশ্ন-২ : দাঁড়ি বা চুলে কালো খেযাব ব্যবহারকারী হাফেজের পিছনে তারাবীহ পড়া জায়েয কিনা?
উত্তর : শরীয়তসম্মত ওযর বা প্রয়োজন ব্যতীত “কালো খেযাব ব্যবহারকারী ব্যক্তি ফাসিক বলে গণ্য। তাই তেমন হাফেযের পিছনে তারাবীহ পড়া মাকরূহে তাহরীমী।” (আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৩, পৃ-২৯৪)
একই গ্রন্থের ৮ম খন্ডে ১৮৩ পৃষ্ঠায় একটি প্রশ্নের জবাবে (বিজ্ঞ গ্রন্থকার) লিখেছেন- “দোষ মুক্তির লক্ষ্যে সাদা চুল উপড়ে ফেলা জায়েয। আর সময় আসার পূর্বে (বৃদ্ধ না হয়েও) চুল সাদা হয়ে যাওয়া দোষণীয় (রোগজনিত)। তাই তেমন ব্যক্তির জন্য তা জায়েয।” দলীল হিসাবে গ্রন্থকার ‘রাদ্দুল মুহতার’ : (খ-৬, পৃ-৪০৭) এর এ উদ্ধৃতি-
“আল্লামা হাসকাফী (র.) বলেন, “সাদা চুল বা পাকা চুল উপড়ে ফেলায় কোন বাধা নেই”। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আবেদীন শামী (র.) বলেন,“ফাতাওয়া বাযাযিয়া’ গ্রন্থে এটিকে শর্তাধীন করা হয়েছে। আর সেটি হচ্ছে, তা যেন সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে না হয়” (পৃ-৪০৭/খ-৬)-পেশ করেছেন।
এখানে প্রশ্ন জাগে, একজন যুবক বা কম বয়স্ক লোক যার জন্য সৌন্দর্য চর্চা একটা স্বাভাবিক, স্বভাবজাত, প্রকৃতিগত, স্ত্রী-পরিবার-সমাজ-স্বজন সকলের প্রত্যাশিত ; আবার সে বুড়ো হয়ে বয়সও গোপন করছে না ; আবার যে-ক্ষেত্রে সে অন্য নারীদের আকর্ষণের নিমিত্তে নয় বরং নিজ দাম্পত্য জীবন সুখী হওয়ার লক্ষ্যে-যা কিনা অবশ্যই শরীয়তসম্মত ‘প্রয়োজন’ (জরুরত/হাজত) এর মধ্যে গন্য- খেযাব ব্যবহার করবে, সে-ক্ষেত্রেও মাকরূহ বলা ; কিংবা ‘সৌন্দর্য’ -লক্ষ্য হতে পারবে না -বলা, এ ক্ষেত্রে বিবেচনার দাবী রাখে।
লক্ষণীয় যে, উক্ত গ্রন্থকার মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানী (র.) বৈধতার কারণ (ইল্লত) হিসাবে ‘সৌন্দর্য বৃদ্ধি’ এর বিকল্প হিসাবে দোষমুক্তি বা ‘ত্রæটিমুক্তি’ যা অসময়ে রোগজনিত কারণে সাদা হয়ে থাকে- সেটিকে কারণ বা ইল্লত স্থির করে বৈধ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। যদিও তা মূল উদ্ধৃতিতে অবর্তমান। অর্থাৎ তিনি এটিকে ‘তাদাবী’ বা চিকিৎসার আওতায় গন্য করে ত্রুটিমুক্তিস্বরূপ উপড়ে ফেলার কথা বলেছেন। এ থেকে সাধারণ জ্ঞানেও অনুমেয় যে, সাদা চুলগুলো উপড়ে ফেলার তুলনায় তা কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দেয়া অধিক সহজ ও যৌক্তিক। কারণ, এতে সংশ্লিষ্ট খেযাবদাতা পরিণত বয়সে উপনীত হননি মর্মে তার আসল রূপ/অবস্থান বহাল থাকে। যা কিনা একজন পরিণত বয়সের বৃদ্ধের ক্ষেত্রে প্রতারণার আওতায় পড়তে পারতো। মোটকথা, অল্প বয়সে চুল-দাঁড়ি সাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যতিক্রম হিসাবে তা উপড়ে না ফেলে , কালো খেযাব ব্যবহার করতে পারে।
স্ত্রী/অন্যান্য নারী সমান ?
প্রিয় পাঠক ! উক্তরূপ একইরকম বিস্তারিত বর্ণনা, গবেষণা অনুসন্ধান, আহসানুল ফাতাওয়া : খ-৮, ‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’র ৪র্থ খন্ডে, ‘জাদীদ ফিকহি মাসাইল’, ‘জাওয়াহিরুল ফিকহি’ ও ‘ফাতাওয়া মাহমুদিয়া’র বিভিন্ন খন্ড, ইত্যাদি গ্রন্থে বিদ্যমান। অবশ্য, সকলের ফাতওয়ার ঐক্যমত্য দেখা যায় কেবল মুজাহিদ/গাজী/সৈনিকদের ক্ষেত্রে কালো খেযাব ব্যবহার বৈধ হওয়া প্রশ্নে। বাকী যুবতী স্ত্রীর মনোরঞ্জন প্রশ্নে বৈধ হলেও ব্যবহার না করা উত্তম তথা ‘মাকরূহ’ বোঝা যাচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব গবেষণা বা ফাতাওয়ার মধ্যে কেউ কেউ নিজ স্ত্রীর মনোরঞ্জন বা দাম্পত্য জীবনের সুখের প্রত্যাশা বা পরস্পরের বৈধ আকর্ষণ বিষয়টি এবং ‘অন্য নারী’ বা ‘ভিন্ন নারী’কে অবৈধভাবে আকর্ষণ করার বিষয়টিকে একাকার করে ফেলেছেন। অর্থাৎ প্রশ্ন করা হচ্ছে স্ত্রীর আকর্ষণের ক্ষেত্রে বৈধতা নিয়ে ; অথচ তার জবাব দেওয়া হচ্ছে ‘ভিন্ন নারীর’ ক্ষেত্রের সূত্র/উদ্ধৃতি দ্বারা। যেমন- “নিজেকে অন্য নারীদের প্রতি আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে এবং তাদের প্রেম-প্রীতি বৃদ্ধির জন্য-তাহলে সেটা মাকরূহ”। ‘নিসা’ মানে স্ত্রী নয়, আর ‘যওজাহ্’ বা ‘আযওয়াজ’ বলতে সাধারণ নারী /মহিলাদের বোঝায় না। সুতরাং ফাতওয়াদান কালে বা এক্ষেত্রে গবেষণা করতে গেলে, এসব পার্থক্য অবশ্যই মনে রাখা আবশ্যক।
আর অল্প বয়সে চুল-দাঁড়ি সাদা হয়ে গেলে সেক্ষেত্রে ‘কালো খেযাব’ ব্যবহারকে রোগ বা চিকিৎসা বিবেচনায় বৈধতায় কাতারে ফেলা যায়।
অবৈধতার কারণ : অবৈধতার কারণ হিসাবে ‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’ ৪র্থ খন্ডে বলা হয়েছে- “কালো খেযাব নিষেধের ক্ষেত্রে শরীয়তের লক্ষ্য হল, বৃদ্ধাবস্থা ও যৌবন অবস্থার ক্ষেত্রে যেন সংশয় সৃষ্টি না হয় এবং বৃদ্ধ ও যুবক পরিচয়ে যেন সংশয়ের জন্ম না হয়” (পৃ-২১৭)।
বিধান গবেষণার মূলনীতি : একটি হল আইন, আরেকটি হল, আইন গবেষণার মূলনীতি বা নীতিমালা, যাকে পরিভাষায় উসূল বলা হয়। এ মূলনীতির দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে সংশ্লিষ্ট বিধানটি বোঝা ও বোঝানো সহজ হয়ে যায়। উদাহরণত, উসূল গ্রন্থটি উসূলে শাশী, নূরুল আনোয়ার, উসূলে বায়দূবী ইত্যাদিতে বিধায় চিহিৃত করার লক্ষ্যে এবং স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে (‘খাস’ ও ‘আম’) ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য বিধান এবং ব্যতিক্রম, ওযর ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান, অর্থাৎ ‘ব্যাপক-মূল বিধান’ ও ‘ব্যতিক্রমী বা বিশেষ বিধান’- এমনসব শ্রেণি বিন্যাস বা সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনা খোদ শরীয়তের মধ্যেই বিদ্যামান। সুতরাং এ আঙ্গিকে বিবেচনা বা গবেষণা করলে। চলবে
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন