এম মাফতুন আহম্মেদ
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় লিখেছেন ‘-যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ও অভাগা, যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে, সবাই করে ভয়, তবে পরাণ খুলে ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বল রে’। সবাই যদি বাংলার জমিন থেকে হারিয়ে যান, ভয়ে সন্ত্রস্ত হন, নির্বাক হয়ে যান, আতঙ্কে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেন, একলা চলেন, একলা মনের কথা বলেন তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের কী একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে না?
কারণ গাজী-শহীদের দেশ প্রিয় বাংলাদেশ। আন্দোলন-সংগ্রামের দেশ বাংলাদেশ। প্রতিবাদের দেশ বাংলাদেশ। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা লাল-সবুজের পতকায় আচ্ছাদিত বাংলাদেশ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের দেশ বাংলাদেশ। এই উপমহাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার সবুজ-শ্যামল এই বাংলাদেশ। বাঙালিদের অতীত ইতিহাস রয়েছে। ঐতিহ্য রয়েছে। নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। একদিন তারা অধিকার আদায়ে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। বেনিয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। লড়াই করেছেন। বিজয়ের মালা ছিনিয়ে এনেছেন।
বাঙালিরাই এই উপমহাদেশে সর্ব প্রথম মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমির স্বপ্ন দেখেছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন এ.কে ফজলুল হক। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি; বঙ্গের শার্দুল। সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালিদের অবদান ছিল অগ্রগণ্য। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালিদের ভূমিকা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য। আবার পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা লড়েছেন। রক্ত দিয়েছেন। শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তানীদের বিদায় দিয়েছেন। অতঃপর সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালিদের একমাত্র দেশ যার নাম বাংলাদেশ।
তারা সা¤্রাজ্যবাদকে কখনও মেনে নেয়নি। আধিপত্যবাদকে গ্রহণ করেনি। সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। তবুও কোনো অশুভ শক্তির কাছে মাথানত করেননি। কোনো অপশক্তির কাছে আত্মসমর্পন করেননি। তাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য তমদ্দুনকে বিকিয়ে দেননি।
বহু আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশ। দীর্ঘ এক ইতিহাস। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় টিপু পাগলা, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমির, ফকির মজনু শাহ, দেশবন্ধু সি আর দাস, এ.কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, আবুল হাসিম প্রমুখদের নাম ভেসে উঠে। এরা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নায়ক। জাতির কিংবদন্তি। এসব মহান পথিকৃতরা আমাদের সকল আন্দোলন সংগ্রামের পুরোধা। তারা ছিল হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গ। কারণ দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের অন্তরে ছিল আগুন। তারা অন্যায়, অত্যাচার ও অসত্যের সামনে কোনদিন মাথানত করেননি। হিমালয়ের মতই তারা মাথা উঁচু করে থেকেছেন চিরজীবন। পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙ্গে তারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পথ দেখিয়েছেন। নতুন আশা দেখিয়েছেন। দেশ মাতৃকার লোভে বিপ্লবের আদর্শে দীক্ষিত করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন কীভাবে লড়াই করতে হয়। শিখিয়েছেন জীবনবাজী রেখে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়?
জাতির এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানরা নির্লোভ, নির্মোহ এবং ত্যাগী ছিলেন। অন্যায় অসত্যের কাছে তারা মাথানত করেননি। এক কথায় বাঙালিরা বীরের জাতি। সকল আন্দোলন-সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলে ধরেছিলেন। সেদিন তিনি কম সাহসের পরিচয় দেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পাকিস্তানী স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন। এসব ছিল একজন জাতীয় বীরের জীবনে শ্রেষ্ঠ অর্জন। যা আজকের প্রেক্ষাপটে ভাবা যায় না। কাজী নজরুল মাথার ওপর শত শত গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েও সারা ভারতে আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন। বিপ্লবী শহীদ তিতুমীর স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জানতেন, সা¤্রাজ্যবাদের আধুনিক সমরাস্ত্রের কাছে পরাজয় নিশ্চিত। তবুও জেনে-শুনে ঈমানি শক্তির বলে বলিয়ান হয়ে বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজ দুঃশাসনের জবাব দিয়েছিলেন। হাজী শরিয়তুল্লাহ জমিদার-মহাজনের অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। দাড়ি রাখা, কর প্রথার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। তাদের অনুপম আর্দশ ছিল। দেশাত্ববোধ ছিল। জাতীয়তাবোধ ছিল। জনগণের কাছে জবাবদিহিতা ছিল। তাই তাদের আদর্শিক লড়াই কোনদিন বৃথা যায়নি।
তাদের উত্তরসূরি আমরা। কেন সেই বাঙালিরা আজ এত দুর্বল? কেন আমরা আজ নানা ক্ষেত্রে ছন্নছাড়া? ভীত বিহ্বল, নানা শংকা কেন আমাদের আজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে? কেন আমরা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি? কেন আমরা আজ নীরব, নিথর, নিশ্চল, জিম্মি?
৪৫ বছর পরেও গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র নেই বলে চিৎকার করছি। গলা ফাটিয়ে সারা বাংলায় চষে বেড়াচ্ছি। সোনার হরিণ গণতন্ত্রকে টর্চলাইট মেরে খুঁজছি। নতুনভাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। অথচ গণতন্ত্রের মর্মবাণি জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। এই কথাটি মনে-প্রাণে লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। জনগণের শাসন নিশ্চিত করতে না পারলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে না। ন্যায় বিচার নিশ্চিত না হলে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো আজও কাগজে-কলমের স্বীকৃতি মাত্র। বাস্তবতা লাভ করেনি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ হয়নি। ফলে আজ অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রাষ্ট্রশক্তিকে দুর্বল করে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। মুক্ত চিন্তা চর্চার অবাধ সুযোগ দিতে হবে। বুট-বুলেট আর ডা-াবেড়ি পরিয়ে কিছু দিন হয়তো ক্ষমতায় থাকা যায়। তবে এসব স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। পরমতকে সহ্য করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ভিন্নমতকে সম্মান জানাতে হবে। সমালোচনাকে টনিক হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ভিন্ন মতকে গ্রহণ করব না। আবার গণতন্ত্র গেল, দেশ গেল বলে চিৎকার করব। উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে পার পাবার চেষ্টা করব। এসব কোনো ভালো লক্ষণ নয়। মনে রাখতে হবে, যে জাতি যত বেশি বুদ্ধি চর্চায় এগিয়ে, সে জাতি তত উন্নতির শিখরে। বুদ্ধি চর্চার মৃত্যু হলে প্রতিবাদের ভাষা ফুরিয়ে যায়। প্রতিবাদীর ভাষা হারিয়ে গেলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। একটি জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। দেশে জঙ্গিবাদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হবে। গোটা জাতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো সৎ সাহসের কেউ কি এই দেশে নেই? অবশ্যই আছে; আবার অবস্থার প্রেক্ষাপটে নেই বললেই চলে। কারণ প্রতিটি সেক্টর এখন বাজিকরদের নিয়ন্ত্রণে। তবে পার্থক্য একটু কম আর বেশি। প্রেক্ষাপট এমনই হয়েছে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কেউ কথা বলবেন খুন হবেন, অপহরণ হবেন। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলবেন, হামলা-মামলার শিকার হবেন। দুঃসহ এই পরিস্থিতিতে কে এই অসীম সাহসীর ভূমিকা পালন করবে? কে সিপাহ্সালারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিবেন? একটি স্বাধীন জাতিকে আগামীর প্রত্যাশায় কে এগিয়ে নিয়ে যাবেন?
অথচ এই বাঙালিরা একদিন আইনের শাসন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে হাটে-মাঠে আন্দোলন করেছে। রক্ত দিয়েছে। কারাদ- ভোগ করেছে। অনেকে দ্বিপান্তরিত হয়েছে। কিšুÍ আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হননি। প্রতিবাদের ভাষায় ছন্দপতন ঘটেনি। রাজশক্তি স্টিম রোলার চালিয়েছে। শুধুমাত্র তাদের শাসন-শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য। তবে দেশে দেশে মানবাধিকার বিরোধী অত্যাচার নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চলছে, পরাধীন শাসনামলেও অবস্থা এত ভয়াবহ ছিল না। আর আজকে স্বাধীন দেশে! কেটে গেল স্বাধীনতার ৪৫ বছর। কোথায় আজ মানবাধিকার? কোথায় আজ গণতন্ত্র? কোথায় আজ আইনের শাসন? সবই আছে। তবে খাতা কলমে। ফাঁকা আওয়াজ, বুলি সর্বস্ব মাত্র। কারণ আজ এত বছর পরেও আমরা হামাগুড়ি দিয়ে সাবালকত্ব হতে পারিনি। আজকের স্বাধীন দেশে আইনের শাসন এক প্রকার নেই বললেই চলে। অনেকে অনেক কথা বলেন। নানা প্রতিশ্রুতি দেন। অথচ জনগণকে নিয়ে সাপ খেলাও করেন। কারণ এ দেশে ‘যে যায় লংকায় সে হয় রাবন’। প্রতিবাদ করলে একজন নাগরিকের জীবনে নেমে আসে হামলা-মামলা। বুলেটের আঘাতে প্রতিবাদীর ভাষাকে নির্বাসিত করা হচ্ছে। বাক শক্তিকে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে। সমাজে এমন ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, যেখানে নাগরিকরা অসহায় এবং তারা ভীত ও আত্মসমর্পণমুখী। ভীতি মানুষকে দুর্বল করে। ভীত মানুষ নীরবে অন্যায়কে মেনে নেয়। ইতিহাসের দিকে তাকালেই তার অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। যে দেশে, যে সমাজে ভয়ের আবহ তৈরি করা গেছে, সেখানেই আমরা দেখেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এসব কারণে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাসের ডাস্টবিনে প্রতিবাদীরা দিশাহীন অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাংলার আনাচে-কানাচে কত জন খুন হয়েছে? কত লোক অপহরণ হয়েছে? অবশ্যই প্রত্যেকটি খুন-অপহরণের সু-নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান রয়েছে। সরকারের দপ্তরে নির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে। আইন-আদালতে মামলা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ সব খুন-অপহরণের মামলা বিচার তালিকায় রয়েছে। কতটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। সংখ্যা খুবই কম। বিচারহীনতার কারণে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। দুর্বৃত্তরা জানে, অপরাধ করলে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু হয় না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরস্কৃত হয়। ফলে অপরাধীরা দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এক পর্যায়ে সমাজের প্রতিবাদীরা নীরব, নিস্তেজ হয়ে যায়। তাদের ভেতরে কাজ করে নানা শঙ্কা। তাই বিচারহীন সংস্কৃতি রুখতে না পারলে সমাজের প্রতিবাদীরা একদিন হারিয়ে যাবেন।
একজন বিপ্লবীর মৃত্যু আছে। তবে বিপ্লবের কোনো মৃত্যু নেই। আদর্শের কোনদিন মৃত্যু হয় না। আদর্শকে সামনে রেখে মানুষ এগিয়ে চলে। এখন আদর্শ বড় বালাই। জ্ঞাতি-দেশ-জাতির কোনো বিচার করছি না। ক্ষমতার মোহে আমরা শুধু ছুটছি। কোন মনজিল মকসুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তা জানি না। যেখানে আদর্শ অনুপস্থিত সেখানে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? জনগণের ভাগ্য কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? ঔপনেবেশিক শাসন আমলে এই বাংলার মানুষ একটি ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন করেছেন। উদ্দেশ্য ব্রিটিশ খেদিয়ে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করা। এসব আন্দোলনের পেছনে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। পরাধীন শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এখন রুখে দাঁড়ান দূরের কথা। একটু ফুস করলে নেমে আসে অত্যাচারের নির্মম খড়গ। হয় ফাঁসি, না হয় জেল-জলুম, হুলিয়া। তাই যে সমাজে মুক্ত চিন্তার কোন সুযোগ নেই, প্রতিবাদের ভাষা নেই, আলোচনার কোনো স্পেস নেই, সেই সমাজে প্রতিবাদির জন্ম হবে কীভাবে? যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারা মনে করেন যে, কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের আজন্ম কালের রাজতন্ত্র কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কাজেই যে কোনো মূল্যে প্রতিবাদের ভাষাকে স্তব্ধ করতে হবে। বুলেট দিয়ে, মামলা দিয়ে আলোচনা-সমালোচনাকে নিস্তব্ধ করতে হবে। জনগণের মুখের কথা কেড়ে নিতে হবে। ভয়ে আতঙ্কে সে দেশে প্রতিবাদীরা হারিয়ে যাচ্ছে? অনেকে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছে।
এক সময় ভাসানী-মুজিব রাজনীতির মাঠ গরম করেছেন। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে ‘খামোশ’ উচ্চারণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাত কোটি বাঙালির মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন। তারা রাজনীতির মাঠে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছেন। তারা শাসকের চক্ষুসূল হয়েছেন। তবুও রাজশক্তি তাদের সম্মান জানিয়েছেন। শ্রদ্ধা করেছেন। তাদের সমালোচনাকে টনিক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে সম্মান জানিয়েছেন।
আর এখন! উচিত কথায় শত্রু বাড়ে। কারণ পরমত সহিষ্ণুতার বড় অভাব। এদেশে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। মনে হয় একে অপরের শত্রু। শ্রেণি বিভাজন এত প্রকট যে, রাজনৈতিক গ-ির বাইরে কিছুই ভাবা সম্ভব নয়। ছেলে-মেয়ে বিবাহ থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তির জানাজায় পর্যন্ত এখন বিভাজনের রেখা চলছে। কারণ প্রকৃত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা সমাজে অনুপস্থিত। প্রতিবাদের ভাষা ফুরিয়ে যাবে। সেখানে হক কথা বললে বা কিছু লিখলে অপশক্তির কোপানলে পড়তে হবে। জীবন ভেসে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এই রুগ্ন বিচারহীন সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিবাদীর ভূমিকা সাহস করে কেউ কী নিতে চাইবে? কারণ একটি সমাজ যখন রুগ্ন হয়ে যায় তখন আইনের শাসন বলে কিছুই থাকে না। কেউ কোনো দায়িত্ব কাঁধে নিতে চায় না। ঝুঁকি নিতে চায় না। জবাবদিহি বলে কিছু থাকে না। যদিও বিবেকের কাছে একরাশ প্রশ্ন থেকে যায়। তবুও সবার অভিন্ন প্রশ্ন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’।
চার পাশে শুধু দুর্নীতি আর অনিয়ম। দুর্নীতি অথই সাগরে দেশ ভাঁসছে। এ সব কে দেখবে, কে প্রতিবাদ করবে? কে কা-ারির ভূমিকা পালন করবে? এটাও সত্য যে, এদেশে অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লোকের কোনো অভাব নেই। অভাব শুধু প্রতিবাদীর সামাজিক নিরাপত্তার। প্রতিটি সেক্টরে কম-বেশি অনিয়মে ছেঁয়ে গেছে। প্রতিটি অনিয়মের পেছনে সরকারি-বিরোধী দলের চেলা-চামচারা কম-বেশি জড়িত। তারা মাসহারা পান। তাই তারা দুর্জনদের পাশে থাকেন। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে টিকে থাকা কঠিন। কারণ রাজনৈতিক তদবিরের কাছে সবাই হার মেনে যান। ভয়ঙ্কর এই পরিস্থিতিতে সরকারি প্রশাসন বা যে কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। ফলে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আইন-আদালত-প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তাই সমাজে আইন ভঙ্গকারীরা ফ্রি-স্টাইলে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে।
অবক্ষয়ের অতলান্তে নিমজ্জিত গোটা দেশ। তখন সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক অঙ্গন, ছাত্র-শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ কেন? বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন, কেন আপনারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন? কেন মোসাহেব চাটুকার, বন্দনাকারীদের কাতারে হাত মিলিয়েছেন? এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে কেন রুখে দাঁড়াচ্ছেন না? অন্যায় অন্যায্য কাজের প্রতিবাদে উজ্জীবিত হচ্ছেন না? বাঙালি আত্মবিশ্বাসী জাতি। তারা দেশ সম্পর্কে নির্বিকারও নয়। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অতীতে প্রতিবাদ করছে, লড়েছে, রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। শুধু এখন দরকার একটু সাহস করে এগিয়ে আসা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলা। তা না-হলে এই দেশ, এই মাটি একদিন হারিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। এটা মাথায় রেখে যে যেখানে যে পরিবেশে বসবাস করছেন প্রতিদিন একটি অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। ভালো কাজকে লালন করুন। স্বাগত জানান। মনে রাখবেন, শেষ পর্যন্ত পাশের প্রিয় বন্ধুটি হয়তবা আপনাকে ছেড়ে চলে যাবেন। তবুও ভীতি, শঙ্কার ঊর্ধ্বে উঠে বলি ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। যেখানে যেভাবে পারি চেষ্টা ও সাধ্যনুযায়ী সকল অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। প্রতিবাদের নতুন ভাষা খুঁজে বের করি। সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসি।
য় লেখক : আইনজীবী ও খুলনা থেকে প্রকাশিত আজাদ বার্তা পত্রিকার সম্পাদক ধুধফনধৎঃধশযঁষহধ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন