তারা বড়ই ভাগ্যবান যারা প্রভূর সান্নিধ্য লাভের আশায় সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে বায়তুল্লাহর যিয়ারত করার সৌভাগ্য লাভ করে এবং বিশ্বনবীর রওজা পাকের সামনে দাঁড়িয়ে রাহমাতুললিল আলামীনকে সালাম জানাতে পারে। মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সত্যিকার অর্থে, বিশুদ্ধ নিয়তে যারা হজ্জ ও ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদীনার দিকে সফর করে এবং হজ্জ ও ওমরা সম্পাদন করে তারা মহান রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে দুটি পুরষ্কার প্রাপ্ত হয়। প্রথমত: তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত: তার দারিদ্রতা দূরিভূত করা হয়। সে ব্যক্তি নব্য প্রসুতের মত নিস্পাপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে। তাই একজন মুমিনের জন্য এই হজ্জ বা ওমরার সফরের চেয়ে উত্তম সফর আর হতে পারেনা। বান্দা তার প্রভূর সান্নিধ্যেই তো যাবে, গোলাম তার মনীবের কাছেই তো তার মনের আকুতি জানাবে, মক্কা-মদীনায় ইসলামের বাস্তব নিদর্শনাদি প্রত্যক্ষ করে অশ্রæ ঝরাবে আর মনের কালি দূর করে কলূষ কালিমা মুক্ত করবে কলব এবং দেমাগ তথা হৃদয় জগৎ এবং চিন্তা-চেতনা। একজন খাটি মুমিনের কাজও তাই।
মানুষ এ মর্তধামে এসেছে ক্ষণিকের তরে। অতঃ পর যাত্রা হবে সকলেরই পরকালের দিকে। কেউ আগে আর কেউ পরে। দুনিয়ার সব মায়া-মমতার ভেড়াজাল ছিন্নকরে মাত্র দু’খানা সফেদ চাদর আর একটি জামায় জড়িয়ে যেতে হবে মাটির ঘরে। অতঃপর মানব ইতিহাসের শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সবাই সমবেত হবে ময়দানে মাহশরে। অবশেষে শেষ বিচারের পরে পাপীদের জন্য জাহান্নাম এবং জান্নাত দেয়া হবে পূণ্যবানদের তরে। এই হল পরকাল। হজ্জ হল পরকালেরই এক প্রতিচ্ছবি, এক নমুনা। হজ্জে যাওয়ার সময় পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ সবকিছুর মায়া পরিত্যাগ করে দুটি সেলাই বিহীন শুভ্র কাপড়কে সঙ্গীকরে রওয়ানা করতে হয়, যেভাবে একদিন রওয়ানা দিতে হবে না ফেরার দেশে। হজ্জের অনুষ্ঠানাদির প্রতিটি কাজ কর্মই পরকালের এক একটি নিদর্শন। বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার সায়ী, মুযদালিফা ও আরাফায় অবস্থান এবং সবশেষে রওজায়ে পাকের যিয়ারত কবর জগত থেকে ইসরাফিলের ডাকে উঠে হাশরের ময়দানের দিকে দৌড়ানো, হাশরের ময়দানে অবস্থান, আল্লাহর আযাব ও শাস্তির ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া এবং সব শেষে রাহমাতুললিল আলামিনের শাফায়াতের আশ্রয় গ্রহণ করাকেই স্বরণ করে দেয় যিয়ারতে হারামাইন শরীফাইন।
হজ্জ ব্রত পালনের দ্বারা মানুষ অল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করে। এহরামের কাপড় পরে হজ্জের নিয়ত করে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নাআমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লাশারীকা লাক’ পড়ে পড়ে বান্দা যখন কাবা ঘরের দিকে অগ্রসর হয় তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপুর্ণ। না মাথায় টুপী, না আছে সুন্দর পোশাক, না জামা, না সুগন্ধি, এলো মেলো কেশে পাগলের বেশে সর্বান্তকরণে শুধু ‘আমি হাজির হে মাওলা! আমি হাজির।’ মুখে হজ্জের তাসবীহ আর মনে কাবা ঘর দর্শন করার এক সমুদ্র তৃষ্ণা নিয়ে বান্দা যখন আল্লাহর ঘরের প্রথম দর্শন লাভ করে তখন তার হৃদয়-মনে যে স্বর্গীয় অনুভুতি বিরাজ করে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না, তা কেবল ঝর ঝর করে ঝরিয়ে পড়ে চোখ দিয়ে অশ্রু হয়ে। এই তো দেখা যায় আল্লাহর ঘর-কাবা শরীফ, এই যে আমার স্বপ্নের বায়তুল্লাহ শরীফ, আদি পিতা ইবরাহীম আ. এর হাতে গড়া এবং মা হাজেরার স্মৃতি বিজড়িত জমজম কুপ তো এখানেই, এখানেই তো হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীম। হাজীগণের মনের এই পবিত্র অনুভূতি তাকে নিয়ে যায় পরয়ারদেগারের রহমত ও করুনার একেবারে কাছে। তখন প্রভূর দরবারে সে যে ফরিয়াদ করে তিনি তা মঞ্জুর করেন।
হাজারে আসওয়াদ বা কৃষ্ণ পাথর। মূলত এটা একটা স্বর্গীয় প্রস্তর। এটা শুভ্র ছিল, কিন্তু বনী আদমের পাপ তাকে কালো করে দিয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যদি মুশরিক-পৌত্তলিকরা এটা স্পর্শ না করত তাহলে রুগ্ন ব্যক্তি তা স্পর্শ করা মাত্রই আরোগ্য লাভ করত। এই হাজারে আসওয়াদে চুম্বন করা সুন্নত। হাজারে আসওয়াদের পাশ থেকেই শুরু হয় তাওয়াফ এবং এর দ্বারা হজ্জের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম ও শুরু হয়। এটা মানুষের জীবনের সর্বাধিক আকাঙ্খিত বিষয়। পৃথিবীতে আরো বহু নামী দামি ঘর এবং রাজপ্রসাদ রয়েছে। তবে কোনটাকেই প্রদক্ষিণ করার মধ্যে কোন পূণ্য নেই। কেবলমাত্র বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর কে তাওয়াফ করার হুকুম করা হয়েছে। বায়তুল্লাহকে বলা হয় বায়তে আতীক বা স্বাধীন-মুক্ত ঘর। কোন কালে কোন দিন কোন জালিম অত্যাচারী এ ঘরকে ধ্বংস করতে পারেনি, পারবে ও না। আবরাহা এসেছিল হস্তী বাহিনী নিয়ে কাবা মসজিদ ভেঙ্গে দিতে কিন্তু খোদার সৈন্য আবাবিল তাকে নিমিষেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। শুধু মানুষ নয় সৃষ্টির অন্যান্য সদস্যরাও এ ঘরের প্রতি সম্মান করে। কাবার দেয়ালে কোন পাখি বসা তো দূরের কথা এর উপর দিয়ে অতিক্রম ও করেনা। তাই যারাই এ ঘরের তাওয়াফ করে আল্লাহ তাকে দুনিয়ার অনেক বিপদ-শংকা থেকে মুক্ত রাখেন।
তাওয়াফের পর মুসাফিরগণ মাকামে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হন। মাকামে ইবরাহীম মূলত একখানা জান্নাতী পাথর। এ পাথরে দাঁড়িয়ে হযরত ইবরাহীম আ. কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন। যখন উপরে উঠার প্রয়োজন দেখা দিত তখন পবিত্র এ পাথর খানা আল্লাহর হুকুমে উচুঁ হয়ে যেত। আবার নীচে নামার প্রয়োজন দেখা দিলে নীচু হয়ে যেত। এ পাথর নবী ইবরাহীম আ. এর পদচিহ্ন ধারণ করেছে তার বুকে। যা আজো বিদ্যমান। এ পাথরের পেছনে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা হয়। এ পবিত্র স্থানে বান্দার কথা আল্লাহর দরবারে গ্রহণ যোগ্য হয়।
তাওয়াফের পর হাজীগণ তৃপ্তি সহকারে জমজমের পানি পান করেন। জমজম কুপ আল্লাহর রহমত ও বরকতের এক অনন্য বাস্তব নিদর্শন। আজ থেকে প্রায় পাচঁ হাজার বছর পূর্বে শিশু ইসমাঈল আ. এর পদাঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল এ ঝর্ণাধারা। আজ অবদি রহমতের এ স্রোতধারা নির্গলিত হচ্ছে অনবরত। রহমতের এ ঝর্ণাধারাকে কেন্দ্র করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল মক্কানগরী। এ জমজম কুপের নিকটে প্রভুর সান্নিধ্য লাভের জন্য মোনাজাত করলে মোনাজাত বিফলে যায়না।
এর পর সাফা মারওয়ার সায়ী। এ পাহাড় দুটির কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা বলে। এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে আসা যাওয়া করাকে সায়ী বলে। আরাফাহ, মুজদালিফায় অবস্থান, মিনায় রাত্রি যাপন এবং কোরবানী, জামারায় কংকর নিক্ষেপ বা রামী সবকিছূ নিয়েই হজ্জ। সাফা, মারওয়া, আরাফা, মুজদালিফা, মিনা সর্বত্রই রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয় অহরহ। সত্যিই তারা ভাগ্যবান যারা এসব স্থানে বিচরণ করে, অবস্থান করে ইহরাম পরে কেবল রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টির তরে। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, আমাদের হজ্জ, কুরবানী ও ইবাদত বন্দেগী সবই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই হতে হবে। দুনিয়াবী স্বার্থ চিন্তা নিয়ে ইবাদত করলে যাবতীয় ইবাদত বিফলে যেতে বাধ্য হবে। তাই হজ্জ-ওমরা ও যিয়ারতে হারামাইনের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে অবশ্যই নিয়তের পরিশুদ্ধতা থাকতে হবে। অন্যথায় হজ্জ কবুল হবেনা, আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবেনা, জীবনের পরিবর্তন ও পরিশুদ্ধতা আসবেনা। হজ্জের সর্বশেষ কাজ হলো তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ বিদায়ের তাওয়াফ। এ তাওয়াফের পরেই স্বাদের মক্কা ছেড়ে চলে যেতে হবে মদীনা মুনাওয়ারায়, রওজায়ে পাকের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে। মক্কার শেষ মুহুর্তগুলো হাজীদের জন্য খুবই হৃদয় বিদারক। মন কখনো চায়না কাবামসজিদ ছেড়ে যেতে, চোখ ফেরানো যায় না কাবার গিলাফের উপর থেকে। আর কখন দেখা হবে হে কাবা তোমার সাথে! আর কি আসতে পারবো তোমার পরশ পেতে? বিদায়ের সময় মনের এই উচ্ছাস ও আবেগ একসময় অশ্রুর রূপ নেয়, ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে দু‘চোখ দিয়ে। মনে হয় যেন এই মাত্র কোলের সন্তান কেউ বুক থেকে কেড়ে নিল। এমন ব্যথা নিয়ে মুসাফির রওয়ানা করে মদীনার দিকে। অত্যন্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিনয়ের সাথে হাজীগণ মদীনায় প্রবেশ করে সাইয়্যিদুল কাওনাইনের রওজা মুবারকের দিকে অগ্রসর হয়। এভাবে বিনয় ও নম্রতার সাথে যারা রওজায়ে পাকের যিয়ারত করে তারা কতইনা ভাগ্যবান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন