শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বিএনপির নতুন নেতৃত্ব ও দেশবাসীর প্রত্যাশা

প্রকাশের সময় : ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. কে এ এম শাহাদত হোসেন মন্ডল

গত ১৯ মার্চ ’১৬ দীর্ঘ ছয় বছর পর ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল-২০১৬ অনুষ্ঠিত হলো। কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাণচাঞ্চলের সৃষ্টি হয় এবং এটা যে দলটিকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হয়েছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কাউন্সিলের পূর্বে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলের চেয়ারপার্সন এবং বিলেতে অবস্থানরত তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমে প্রকাশ পেল জিয়া পরিবারের প্রতি দলের নেতাকর্মী-সমর্থক এবং দেশের মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মাটি ও মানুষকে বাঁচাতে খালেদা-তারেকের নেতৃত্বের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হলো আবার।
ষষ্ঠ কাউন্সিলের ১১ দিন পর বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দলের মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন। একই সঙ্গে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমদকে এবং কোষাধ্যক্ষ পদে মিজানুর রহমান সিনহাকে নিয়োগ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ৩০ মার্চ দুপুর ১টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির চেয়ারপার্সনের পক্ষে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ দলের মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ঘোষণা করেন। তিন নেতার নাম ঘোষণা করে রিজভী আহমেদ বলেন, কাউন্সিলে সব সদস্য বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে দায়িত্ব দিয়েছেন, ক্ষমতা দিয়েছেন, তিনিই জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করবেন। কাউন্সিলরদের দেওয়া ক্ষমতাবলে চেয়ারপার্সন নির্বাহী কমিটির তিনটি পদে নেতাদের মনোনয়ন দিয়েছেন।
এরপর দ্বিতীয় দফায় ৯ এপ্রিল বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির ৭ জন যুগ্ম মহাসচিব ও ৮ জন সংগঠনিক সম্পাদক পদে নিয়োগ দেন। বিএনপির নবনিযুক্ত যুগ্ম মহাসচিবরা হলেন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, হারুনুর রশিদ, লায়ন আসলাম চৌধুরী। সাংগঠনিক সম্পাদক হলেন ঢাকায় ফজলুল হক মিলন, চট্টগ্রামে ডা. শাহাদৎ হোসেন, খুলনায় নজরুল ইসলাম মঞ্জু, রাজশাহীতে অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বরিশালে বিলকিস জাহান শিরিন, রংপুরে আসাদুল হাবিব দুলু, ময়মনসিংহে ইমরান সালেহ প্রিন্স ও ফরিদপুরে শ্যামা ওবায়েদ।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় তা হলো বেগম জিয়া দলের মহাসচিব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসব পদে নিয়োগ দিয়েছেন- বিগত আন্দোলন সংগ্রামে তাদের প্রত্যেকের অবদান ও ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বলিষ্ঠ। বিএনপির ৭ যুগ্ম মহাসচিব ও ৮ সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে ১২ জনই নতুন মুখ। দীর্ঘ প্রায় ৯ বছরের গুম, খুন, মামলা-হামলা, সহায়-সম্পদ বেহাত, কারাবাস ও নির্যাতনের ফলে দলীয় নেতাকর্মীদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা থেমে যাচ্ছে। কারণ শীর্ষ নেতৃত্ব ত্যাগের মূল্যায়ন করছেন। নেতাকর্মীরা প্রচ- আশাবাদী। অবশ্য দুই-একজনকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বলেও তারা জানান। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দীর্ঘ পাঁচ বছর নানা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উচ্চশিক্ষা, ব্যক্তি ইমেজ এবং দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতার মূল্যায়ন করে বেগম খালেদা জিয়া ৩০ মার্চ মির্জা ফখরুলকে মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামে আরেক ত্যাগী ছাত্র নেতা রিজভী আহমেদ। তার ত্যাগের মূল্য দিয়েছেন বিএনপি প্রধান। গত কমিটিতে দলের ৮ যুগ্ম মহাসচিবের তালিকায় তার নাম ৮ নম্বরে থাকলেও এবার তাকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নির্বাচিত করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। যে পদে ছিলেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত বিচক্ষণতা, সততা, দক্ষতা আর বিশ্বাসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ আসতে পারে তার (রিজভী) হাতেই। রাজপথে ত্যাগের খতিয়ান স্বল্পদৈর্ঘ্য হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে উত্তীর্ণ আরেক নেতা মিজানুর রহমান সিনহাকে এবারো কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছেন বিএনপি প্রধান। নতুন ৭ যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে মাহবুব উদ্দিন খোকন বাদে সবাই এই পদে নতুন মুখ। উল্লেখ্য, ১/১১-এর সময় জিয়া পরিবারের অতন্দ্র প্রহরী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। আইনাঙ্গনে তার ভূমিকা/অবদান ও গ্রহণযোগ্যতার কমতি নেই। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে সকল মামলায় তিনি লড়াকু সৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। প্রতিদানস্বরূপ গত কমিটির মতো এবারো আছেন যুগ্ম মহাসচিব পদে।
এটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, যদিও বিএনপির মূল কমিটিগুলো যেমন স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, নির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ এখনও গঠিত হয়নি- তবুও এ পর্যন্ত ঘোষিত পদগুলোতে দেয়া নিয়োগ প্রমাণ করেছে যে, বিগত দিনগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে যারা মাঠে থেকেছেন, যারা সরকারের হামলা মামলা নির্যাতন ও গুমের ঘটনাকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে সম্পৃক্ত থেকেছেন, তাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিকেও এই আলোকে অবশ্যই পুনর্গঠিত হতে হবে। বিএনপির চেয়ারপার্সন নিশ্চয়ই এই সব কমিটি পুনর্গঠনে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদেরকেই স্থান দিবেন।
বিগত দিনগুলোতে দেশের মানুষ দেখেছে বিগত কমিটিগুলোর শীর্ষের পদধারী কিছু কিছু নেতার দুষ্কর্মকে, সরকারের নির্যাতনের ভয়ে কিংবা লোভে কেমন একটা গাছাড়া গাছাড়াভাবে কিংবা সরকারের সঙ্গে এক প্রকার আন্ডারগ্রাউন্ড সমঝোতা করে আত্মরক্ষার পাশাপাশি আন্দোলন সংগ্রামকে বানচাল করার হীন নীতিতে অটল ছিলেন। ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থাকলেও ঐসব নেতাদের দেখা যায়নি। এ কারণেই ব্যর্থ হয়েছে ‘রোড মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র মতন কর্মসূচি। ঢাকার নেতাদের কারণেই রাজধানীতে আন্দোলন শুরু হতেই পারেনি। এই সব নেতাদেরকে কমিটি থেকে বাদ দেয়ার যে দাবি তৃণমূল নেতাকর্মীদের ছিল- বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তা বিবেচনায় নিয়েছেন বলে আপাতত মনে হচ্ছে। ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতাদের পাশাপাশি ক্লিন ইমেজধারী নেতাদেরকে নেতৃত্বে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোমতেই ব্যক্তি, পরিবার কিংবা বিশেষ বিশেষ জেলার নেতাদেরকে অকারণে-অহেতুক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা যাবে না।
এখানে আরো একটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে তা হলো- গুলশানস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের ভূমিকা। এই কার্যালয় সম্পর্কে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে বিগত দিনগুলোতে যা থেকে এটি স্বাভাবিকভাবে মনে হয় যে, গুলশান কার্যালয়টি মূলত কর্মকর্তা-কর্মচারীনির্ভর। এই কার্যালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাকি দলীয় নেতাদেরÑ এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্যকেও নাকি তুচ্ছ জ্ঞান করে, খুব একটা পাত্তা দেয় না। এ বিষয়টি যদি সত্য হয় তাহলে সেটি দলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং রাজনীতিবিদদের জন্য অবমাননাকরও বটে। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। মনে রাখতে হবে, কার্যালয়টি দলের চেয়ারপার্সনের এবং সে কারণেই এই কার্যালয়ে আগত দলীয় নেতাকর্মীদেরকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। যাবে না এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া কিংবা ব্যবহার করা যাতে দলের চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দলীয় নেতৃবৃন্দের (কেন্দ্রীয় কমিটি অথবা দেশের বিভিন্ন জেলা/মহানগর কমিটির) দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিএনপির চেয়ারপার্সন বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। দলের চেয়ারপার্সন ও দলীয় নেতৃবন্দের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি হবে যা একটি দলের ঐক্য ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
তাছাড়া দলের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন কমিটিতে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী পেশাজীবী বিশেষ করে শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে সব ঢাকাকেন্দ্রিক না করে বিভিন্ন বিভাগ পর্যায় থেকে পদায়ন করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য/উপ-উপাচার্যকে রাখা হয়। কিন্তু চরম দুঃখজনক যে, বিগত সময়ে তার বিপরীতে বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে রাখা হয়নি। এ বছর উপদেষ্টা পরিষদ করার সময় দলের ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের জন্য নিবেদিতপ্রাণ যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য/উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনও দল ও আদর্শের জন্য জাতীয় পত্রিকাসমূহে লিখনীসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অবদান রাখছেন তাদেরকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি। এতে দলের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে, উপদেষ্টা পরিষদ সমৃদ্ধ হবে এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের বিপরীতে দেশবাসীর কাছে বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের গ্রহণযোগ্য বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা নির্বাহী কমিটিতে দলের জন্য নিবেদিত সাংবাদিক/সম্পাদককে অন্তর্ভুক্ত করাও একান্ত জরুরি। পাশাপাশি বিএনপির ‘প্রকাশনা’ ও ‘মিডিয়া’কে শক্তিশালী ও গণমুখী করতে হবে। চরম দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিএনপির মিডিয়া অত্যন্ত দুর্বল। মিডিয়া নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও বিএনপি মিডিয়ার ক্ষেত্রে চরম উদাসীন। প্রিন্ট মিডিয়ার মধ্যে এখন একমাত্র সম্বল ‘দৈনিক দিনকাল’। বলতে দ্বিধা নেই যে, পত্রিকাটিকে এখনও জাতীয় পত্রিকার মানে উন্নিত করা সম্ভব হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পত্রিকাটিকে টিকিয়ে রাখার কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। এর পাঠক সংখ্যা দেখলেই পত্রিকাটির করুণ অবস্থা পরিলক্ষিত হবে। এটি দলের জন্য লজ্জাজনক। যারা নিয়মিত লেখা দিয়ে পত্রিকাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তাদেরকেও মূল্যায়ন করা হয় না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। যাই হোক, মিডিয়াকে উন্নত ও সম্প্রসারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচারণের (মিডিয়া) উপর একটি রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের অস্তিত্ব নির্ভর করে। জনগণের মধ্যে দলের উপর আস্থা সৃষ্টি ও ভিত শক্তিশালী করতে মিডিয়ার কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান প্রতিকূল অবস্থায় সরকারের দমন-পীড়ন ও খড়গ থেকে দলকে রক্ষা করে ঘুরে দাঁড়াতে হলে বিএনপিকে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য বিকল্প নেতৃত্বকেও গড়ে তুলতে হবে। যাদের দায়িত্ব হবে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের অবর্তমানে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং বেগবান করা আন্দোলন সংগ্রামকে। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, “বিএনপির রাজনীতি এখন অনেকটা প্রতিদিনের প্রেসব্রিফিং এবং দু’একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ভেতর আটকে আছে। এমন বিরুদ্ধ অবস্থায় বিএনপির ঘুরে দাঁড়াতে হলে এখন বোধ হয় আর শর্টকাট পথ নেই। একটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথেই হাঁটতে হবে। যেহেতু দেশজুড়ে বিএনপির অসংখ্য কর্মী-সমর্থক দলটির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে তাতে বলা যায় নেতৃত্বের নিরাশ হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশে ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক ধারা বজায় থাকার জন্য বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। ইউপি নির্বাচন বিএনপিকে তৃণমূলে চাঙ্গা করতে পারেনি। আমাদের রাজনীতির নিয়তি হিসেবেই পেশিতন্ত্র পরিচালিত ‘গণতন্ত্র’ থাকবেই। তাই সরকারি তাপ-চাপ দেখে বিএনপির চমকে বা থমকে যাওয়ার কিছু নেই।
নেত্রীও ক্রমে যেন একা হয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনেকটা পাকাপাকিভাবে প্রবাসে। অন্যদিকে দেশে যারা আছেন তারা তো সকলে আদেশ পালনকারী নেতা। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে হয় না। বিএনপির দুই প্রধান যে পরিমাণ মামলা-মোকদ্দমায় রয়েছেন তাতে মনে হয় না আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তারেক জিয়ার দেশে ফেরা হবে। আর বেগম জিয়ার চলমান মামলায় তার ভবিতব্য কী সে সম্পর্কেও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এমন একটি অবস্থায় বিএনপির নেতানেত্রীদের দলের পুনর্গঠনে নিজ নিজ নেতৃত্ব গুণে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিএনপির বড় পাথেয় হতে পারে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কর্মী-সমর্থক। সরকারি সুবিধা কাজে লাগিয়ে এবং কৌশলী রাজনীতি করে দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিত্তি এখন বেশ শক্ত। শেখ হাসিনা সরকার পররাষ্ট্র নীতির দিক থেকেও নিজেদের অবস্থান বেশ দৃঢ় করে ফেলেছে। সুতরাং রাত পোহালেই ক্ষমতার মসনদ ফিরে পাবো অমন স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হবে। ফলে একটিই পথ খোলা তা হচ্ছে দলকে সুসংগঠিত করে রাজনীতির সরল পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। আর এর জন্য বেগম জিয়া যদি নিজ জীবদ্দশাতেই ক্ষমতা ফিরে পেতে বা অচিরেই তারেক জিয়াকে মুক্ত করে নেতৃত্বে বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেন তাতে আরো স্খলন ঘটতে পারে। এতে রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোটা বিলম্বিত হবে। হতাশা নামবে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। অনেকেই নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাবে। ফলে দলটিকে পরিচালিত করা নেতৃত্বের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আর প্রধান বিরোধী দল- বিএনপির অমন দুর্বলতা দেশের সার্বিক রাজনীতির জন্য তো ক্ষতির হবেই। রাজনৈতিক সততা নিয়ে সবল নেতৃত্ব যদি কর্মী-সমর্থকদের সম্মান দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায় তবে বিএনপি নিশ্চয়ই দৃশ্যমান অবস্থায় নিজের অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারবে” (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ এপ্রিল ২০১৬)।
দলের বর্তমান নাজুক অবস্থা এবং দলে নেতৃত্ব সংকট সম্পর্কে সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) মো. আখতারুজ্জামান জাতীয় দৈনিকে একটি নিবন্ধে লিখেছেন, “বিএনপি একটি বিশাল রাজনৈতিক দল কিন্তু এই দল এখন বিস্ফোরণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বিএনপি এখন মধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দলের সব দায়দায়িত্ব এক বা দু’জনের ওপর। পৃথিবীর তাবৎ রাজনৈতিক দলই এভাবে চলে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতা বা নেতৃত্ব দলকে পরিচালিত করে যাতে দলের প্রতিটি নেতাকর্মী দলকে শক্তিশালী করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। দলে অন্য কোনো নেতৃত্বের বলয় নেই। নেই কোনো ছাত্রনেতা যে নিজের সাহসে ও ক্ষমতায় রাজনীতিতে কোনো সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। তেমনি নেই কোনো গ্রহণযোগ্য যুবনেতা বা শ্রমিক নেতা বা কোনো পেশাজীবী নেতা বা আঞ্চলিক বা জেলা নেতা। এমনকি নিজের পরিচয়ে কথা বলার কোনো জাতীয় নেতাও নেই। আছে কতগুলো চাকর-বাকর যারা নেত্রীরই চারপাশে ঘুর ঘুর করে পদ ভিক্ষা করে। ‘পদ পাইলেই বিশাল নেতা, না হলে সমাজে দাঁড়ানোর মতো ভিত তাদের নেই’। দলের ভিতরে কোনো ঘর্ষণ নেই, তাই দলের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। ম্যাডাম একমাত্র দলের ভিতরে ক্ষমতার উৎস। কিন্তু ম্যাডামকে সরকার সুপরিকল্পিতভাবে ঘরে বসিয়ে দিয়ে তার ক্ষমতাকেও হ্রাস করে দিয়েছে। ম্যাডাম এখন চার্জার থেকে বিচ্ছিন্ন বিশাল শক্তিশালী একটি ব্যাটারি যার পাওয়ার দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ সরকার ম্যাডামের চার্জার বা ক্ষমতার উৎস জনগণের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে। যদি বিএনপি আরেকজন সমান্তরাল নেতৃত্ব সৃষ্টি করে দলকে জনগণের কাছে নিয়ে না যেতে পারে তাহলে ম্যাডামকে জনবিচ্ছিন্ন করার সরকারের পরিকল্পনা সফল হবেই’’ (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৬ এপ্রিল ২০১৬)।
এছাড়া অতীতের আন্দোলন সংগ্রামে নিজের ভূমিকা/অবস্থানের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত পদের জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। যে কোনো মূল্যে দলের প্রতি আনুগত্য ও নেতৃত্বের প্রতি আস্থা অটুট থাকতে হবে। এগুলো থাকলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করে নতুন কমিটিতে পদায়ন করবেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আগামীতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন-সংগ্রামের সফলতা নির্ভর করবে বিএনপির আন্দোলন করার ক্ষমতার ওপর। আর বিএনপির এই ক্ষমতানির্ভর করবে দলটির সাংগঠনিক শক্তির ওপর। সাংগঠনিক শক্তি নির্ভর করবে নতুন করে গঠিত স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়নসহ তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দেশপ্রেম, দলের প্রতি আনুগত্য এবং সর্বোপরি তাদের ঐক্য ও আন্তরিকতার ওপর। দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইস্পাত কঠিন ঐক্যের মাধ্যমে রাজপথ-জনপথে জনগণকে সংগে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করতে হবে।
এক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১৪ এপ্রিল রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বেগম জিয়ার বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেগম জিয়ার ভাষায়, “পেছনের অনেক দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা ও বেদনা ভুলে আমরা সকলে হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করি। সামনের দিকে এগিয়ে যাই। শুভদিন আমাদের সামনে আসবেই। আমরা আশা করি, নতুন বছরে আমরা গণতন্ত্র ফিরে পাব, উন্নয়ন হবে, শান্তি আসবে, হত্যা-গুম-নির্যাতন থেকে মানুষ মুক্ত হবে। দেশে প্রতিটি মানুষের দাবি প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য বেশি প্রয়োজন গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। এই নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুদিন বয়ে আনবে, শুভ হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আসুন, নববর্ষে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই; শপথ নেই, বিভেদ নয়, ঐক্য গড়ে জাতিকে মর্যাদার পথে নিয়ে যাই। শহীদরা যেমন রক্ত দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি সকলে মিলে বাংলাদেশকে বহিঃবিশ্বে শান্তি ও উন্নয়নের দেশ উপহার দিব। আসুন, গণতন্ত্রের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
গণতন্ত্র ফেরাতে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অনেক বেদনা, অনেক কষ্ট ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সেজন্য বিভেদ ভুলে ঐক্য গড়ে তুলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা অনেক দুঃখ, যন্ত্রণা, বেদনা ভোগ করছি। সেই দুঃখ যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে হাসি, আনন্দ ও কল্যাণের জন্য আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই। শুভদিন আমাদের সামনে আসবে’’।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবিকে সম্মান দেখিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটিসমূহে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদেরকে মূল্যায়ন করে পদায়ন করবেন এবং আগামীতে নবগঠিত কমিটিসমূহের সঙ্গে ঘন ঘন মতবিনিময় করবেন। এক্ষেত্রে গুলশানস্থ চেয়ারপার্সনের কার্যালয়কে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। গুলশান কার্যালয় ও পল্টনস্থ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। ১/১১-এর সময় তথাকথিত সংস্কারপন্থী দলছুট নেতাদেরকেও ক্ষমা করে কাছে টানতে হবে এবং তাদেরকেও দলে সম্পৃক্ত করতে হবে বিভিন্ন কমিটিতে পদায়নের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত নতুন কমিটিসমূহ তারুণ্যের গতিতে এগিয়ে যাবে প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের মাঠে। তাহলেই একদলীয় শাসনের হাত থেকে রক্ষা পাবে দেশ। বর্তমান প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি। দেশে ফিরে আসবে নির্বাসিত বহুদলীয় গণতন্ত্র। বাঁচবে দেশ, বাঁচবে মানুষ।
লেখক: প্রফেসর, ইন্সটিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস ও সাবেক প্রো-ভিসি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সড়হফধষংয৫২@ুধযড়ড়.পড়স

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন