মরা পদ্মায় বান ডেকেছে। উজান থেকে আসছে বিপুল পরিমান পানি। ফারাক্কার গেটগুলো খোলা পেয়ে ধেয়ে আসা বানের পানিতে মরা গাঙ্গে বান ডেকেছে। ভাঙছে দু’পাড় বিলীন হচ্ছে গ্রাম জনপদ অফিস স্কুল বাজার ফসলের ক্ষেত। বিপদ সীমা ছুইছুই করছে। যে কোন সময় রাজশাহীর কাছে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে পদ্মা। গতকাল রাজশাহী নগর পয়েন্টে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছিল ১৭ দশমিক বিশ সেন্টিমিটার। বিপদসীমা হলো ১৮ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক জানান প্রতিদিন চার পাঁচ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। এখনো এক দশমিক ত্রিশ সেন্টিমিটার নীচে রয়েছে। যদি এভাবে পানি বাড়তে থাকে তবে বিপদসীমা অতিক্রম করতে সময় লাগবে না।
গতকাল পদ্মার তীর ঘুরে দেখা যায় পানিতে টুইটুম্বর নদী। বালিচরের নীচে চাপা পড়া পদ্মা হঠাৎ করে ক্ষনিকের জন্য যৌবনবতী হয়ে দুকূল ছাপিয়ে ছুটছে। গত দশ দিন আগেও পদ্মার চিত্র ছিল ভিন্ন। মাঝ বরাবর বালিচর, আর ডুবোচর জানান দিচ্ছিল পদ্মার শীর্ণ দশার কথা। সেই পদ্মা এখন হঠাৎ করে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে। কারন হিসাবে জানা যায়, এ অঞ্চলে এবার বর্ষা মওসুমে স্বাভাবিক বর্ষণ না হলেও ভারতে বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার চাপ সামলাতে ফারাক্কার গেট দিয়ে বিপুল পরিমান পানি আসছে। তাছাড়া পদ্মার তলদেশে বালি জমতে জমতে তা আঠারো মিটার পুরু হয়ে গেছে। ফলে ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে পদ্মা। শাখা নদ নদী গুলোর একই অবস্থা। ফলে একটুতেই উপচে পড়ছে নদী। প্রমত্ত হয়ে ভাঙছে পাড় জনপদ। চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, সদর উপজেলার চর বাগডাঙ্গায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চর আষাড়িয়াদহ, চরখিদিরপুর, শহররক্ষা বাঁধের টি গ্রোয়েন চারঘাটের টাঙ্গন, ইউসুফপুর, সাহাপুর, বাঘার পাকুড়িয়া, গোকুলপুর, জোতফাড়িপুর, কিশোরপুর, চকরাজাপুর, কালিদাস খালিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা ভাঙনে পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়েছে। হঠাৎ পদ্মার এমন ভয়ংকর রুপে নদী পাড়ের মানুষ আতঙ্কিত। আবার পদ্মার এমন ভরা যৌবন দেখতে হাজারো মানুষ ভীড় করছে পদ্মার তীরজুড়ে। প্রবীণরা স্মৃতি হাতড়ে বলছেন পদ্মাতে সব সময় এমনিই ছিল। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে নদীকে মেরে ফেললো। শুধু নদী মরেনি এ অববাহিকার জীব বৈচিত্র সবুজতা মৎস্য কৃষি নৌ যোগাযোগ সবকিছু ধ্বংস করেছে।
পদ্মার বর্তমান বন্যা অবস্থা দেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ভূতত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সরোয়ার জাহান সজল যিনি বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্ত পানির স্তর নিয়ে গবেষণা ও উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করছেন। গতকাল এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, নদী ভরে যেমন দুপাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তেমনি আবার খাল বিল শাখা নদ নদীগুলোকে ভরেছে। যা এবার পর্যাপ্ত বর্ষণের অভাবে ভরেনি। নদী তীরবর্তী ভূগর্ভের পানির স্তর পুন:ভরনের জন্য সহায়ক হবে। সবচেয়ে বেশী লাভবান হওয়া যাবে যদি এসব পানিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকে রাখা যায়। এখন যমুনা মেঘনায় পানি বাড়ার কারনে পদ্মার পানি দ্রুততা ঠেলে সাগর পানে যেতে পারছেনা। ফলে এদিকে বন্যাভাব দেখা দিচ্ছে। চলতি মওসুমে বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ফুসে উঠেছে পদ্মা। যমুনাসহ দেশের বিভিন্ন নদী ও শাখা নদী এরই মধ্যে উপচে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। দেশের উত্তর-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকিতে পড়ছে। নদীর পানি বাড়ছে। এখন যদি ভারী বর্ষণ হয় তবে তা হলে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণকরতে পারে। আমনসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যা মোকাবেলায় প্রয়োজন পদক্ষেপ আর প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন। আলাপচারিতায় তিনি বলেন আমরা এসব পানিকে যদি সংরক্ষন করতে পারতাম তা হলে এদিয়ে সেচ ব্যবস্থাপনার কাজে লাগানো যেত। ভূগর্ভস্ত পানির উপর নির্ভরতা কমতো। এসব পানি সংরক্ষণের জন্য নদ নদী খাল বিল গুলো খনন নদী গুলোয় রাবার ড্যামসহ বিভিন্ন উপায়ে পানি সংরক্ষন করা যায়। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ মহানন্দা ও আত্রাই নদীতে রাবার ড্যাম দিয়ে পানি সংরক্ষনের কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। পদ্মার পানি বৃষ্টির পানি সবইতো পদ্মা যমুনা মেঘনা দিয়ে সাগরে চলে যাচ্ছে। এ পানিকে আটকাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ।
নদী গবেষক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বলছেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে সমীক্ষা হলো। চারবার স্থান পরিবর্তনের পর রাজবাড়ি জেলার পাংশার হাবাসপুর সীমানায় ব্যারেজ নির্মানের বিষয়টা চুড়ান্ত করা হয়। এ ব্যারেজটি হলে প্রায় তিন মিলিয়ন কিউবিক মিটারের একটি জলাধার সৃষ্টি হতো। এ পানির গতিপথ ঘুরিয়ে পদ্মা নির্ভর নদী গুলোর পানি প্রবাহ ও নাব্য বৃদ্ধি করা হতো। যা দিয়ে দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার প্রায় দেড়শো কোটি হেক্টর কৃষি জমিসহ সাড়ে তিনশো কোটি হেক্টর জমির সেচ সুবিধা নিশ্চিত হতো। একই সাথে ব্যারেজ ও গড়াই নদীর মুখের অবকাঠামোর সঙ্গে একশো মেগাওয়াট পানি বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের জন্য দুটি হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল।
সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর দেশের মানুষ যখন এর নির্মাণ কাজ শুরু দেখার অপেক্ষায়। তখন হঠাৎ করে ভারতের দাদাগিরির নীচে সব চাপা পড়ে গেল। অজুহাত তোলা হলো এ ব্যারেজ হলে ভারতের ক্ষতি হবে। যদিও ভারতের এমন অজুহাত নিছক অমূলক। ভারত গঙ্গা পদ্মা বেসিনের উপর হাজারো প্রকল্প নিয়েছে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে। ভাটির দেশের উপর ভয়াবহ গজব নামিয়েছে। আর্ন্তজাতিক নিয়ম অনুযায়ী ভাটির দেশের পরামর্শ নেবার কথা থাকলেও তা নেয়া হয়নি। অথচ আমাদের ফারাক্কার বিকল্প ব্যারেজ গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে শেষ মুহুর্তে এসে বাগড়া দিয়েছে। যা কোনভাবে কাম্যনয়।
পদ্মার বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমানের বক্তব্য হলো বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য তাদের যে অবকাঠামো রয়েছে তা যেন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে তারা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন