বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

মনে রাখতে হবে, আদালতই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

মানুষ আইন ও শাসন ব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে। বিবেক বুদ্ধি বা উন্নতচিন্তা করার ধী শক্তি নাই এমন প্রাণীদের মধ্যে অনেক প্রাণীই গোষ্ঠীগতভাবে দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে। প্রকৃতির নিয়মে তাদেরও দলপতি বা দলনেতা রয়েছে, যাকে অন্যান্যরা অনুসরণ করে। যেমন- রাণী মৌমাছি, মাছের মধ্যে ‘মা’ প্রভৃতি। কথায় বলে, সব হরিণের গর্ভে মৃগনাভী জন্মে না, সব সাপের মাথায় মনি সৃষ্টি হয় না। মানব সমাজে ‘শক্তি’ থেকে শাসকের (অর্থাৎ জোর যার মুল্লক তার) এবং প্রতিশোধের প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সৃষ্টি হয়েছে বিচার ব্যবস্থা। পর্যায়ক্রমে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি থেকেই উৎপত্তি হয়েছে বিচার ব্যবস্থা। বিচার ব্যবস্থায় পদ্ধতির উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশ, বিবেকের বাস্তব প্রতিফলনের জন্য শক্তি (বাহুবল) থেকে উৎপত্তি। শাসক দলের সাথে লড়াই সংগ্রাম, কোথাও যুগের পর যুগ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে। এ জন্যই বিচার ব্যবস্থাকে থাকতে হয় স্বতন্ত্র অবস্থায়। যা শাসকের শাসন ব্যবস্থার গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে না, এতেই বিচার ব্যবস্থার সার্থকতা।
প্রতিষ্ঠিত প্রবাদ রয়েছে যে, ‘মানুষের বিবেকই শ্রেষ্ঠ আদালত’ এবং একথাও মানুষ দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে যে, ‘আদালতই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।’ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত। সংবিধানের ৯৪(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক, সর্বোচ্চ আদালতের যিনি প্রধান তিনি শুধু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নন, বরং তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি অর্থাৎ বাংলাদেশের যেখানেই মানুষের অধিকার শাসক (রাজা, বাদশা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত নির্বাহী প্রভৃতি) কর্তৃক মানুষের বা ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ন হবে সেখানেই প্রধান বিচারপতির হাত সম্প্রসারিত হবে, সাংবিধানিকভাবে তিনি এরূপই ক্ষমতাবান। তবে কেউ শত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে বিচারিক ক্ষমতা গণমানুষের জন্য প্রয়োগ করেন, কেউ নিজ ও নিজ পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপদ জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেন। কেউ ঝুঁকি গ্রহণ করেন, কেউ তাবেদারীতে তুষ্ট থাকেন। কারো নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে, কেউ দালালীর খাতায় নাম লেখান, অথবা ‘যেমনি চালাও তেমনি চলি’-এ মনোভাব নিয়ে গা ভাসিয়ে দেখেও না দেখার ভান করে সুখে স্বাচ্ছন্দে, আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়ে নিজেকে ধন্য ধন্য মনে করেন। কেউ চোখ বুঝে অন্যায়-অবিচার হজম করেন, কেউ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কারো মেরুদণ্ড সোজা থাকে, আবার কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই কারো মেরুদণ্ড এমনিতেই নেতিয়ে যায়। এটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট ব্যক্তির মানসিকতা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের উপর। কাকের মতো কেউ চোখ বুঝে নিজেকে আড়াল করেন, কেউ বাঘের মতো তীক্ষ দৃষ্টিতে অতন্ত্র প্রহরীর মতো নিজ কর্তব্য ও দায়িত্বের প্রতি সজাগ থাকেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে ৯ মার্চ ১৯৭১ বিচার বিভাগের জন্য গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে আছে। কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পরম শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব বিচারপতি বি.এ. সিদ্দিকী যদি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে কুখ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ প্রত্যাখান না করতেন তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে আরো বেশি রক্তের প্রয়োজন হতো। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ভ‚মিকা স্বাধীনতা আন্দোলনকে যেমন ত্বরান্বিত করেছে, তেমনি বিচার বিভাগের সম্মানকেও করেছে গৌরবোজ্জ্বল। তবে বিচার বিভাগের কলঙ্কজনক ইতিহাসও রয়েছে, যার পরিমাণও কম নয়। আইনজীবীরা বিচারপতিদের প্রতি মাথা ঝুঁকিয়ে গণ খঙজউ বলে সম্বোধন করেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃক সম্পাদিত অভিধানে খঙজউ শব্দের শব্দার্থ করা হয়েছে (১) স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তা, (২) সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও (৩) সর্বময় কর্তা প্রভৃতি।
বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গণহারে প্রতি থানায় থানায় সিরিজ আকারে গায়েবী মামলা হচ্ছে: যার মধ্যে মৃত, হজ্ব বা বিদেশে অবস্থানকারী মানুষকেও আসামি করা হয়েছে। ৮৫/৯০ বছরের বৃদ্ধ যারা দীর্ঘ দিন রোগশয্যায় মৃত্যুর দিন গুনছে তারাও গায়েবী বোমা মামলার আসামি হওয়া থেকে বাদ পড়েনি। দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছে যে, মৃত ব্যক্তি যারা কঙ্কালে পরিণত হয়েছে তারাও গোরস্তান থেকে সরকারের পদত্যাগ চাইছে। মক্কাশরীফে গিয়েও অনেকে সরকারের পতন কামনা করেছে। নতুবা তারা কেন নাশকতার পরিকল্পনা মামলার আসামি হবে? মামলার আসামি করলেও পুলিশের লাভ, ধরলেও লাভ, ছাড়লেও লাভ, রিমান্ডে নিতে পারলে আরো বেশি লাভ, ক্রস ফায়ারের ভয়ে কাবু করতে পারলে আরো অধিকতর লাভ। অধিকন্তু রয়েছে হাইকোর্ট কর্তৃক জামিন লাভের পর একটার পর একটা জেল গেইটে গ্রেফতার বাণিজ্য, যা খুবই মুনাফাভিত্তিক। সরকারি দলের একশ্রেণির পেট ভরাতে দেশের কোনো কোনো ব্যাংক লোপাট হলেও এবং মামলা সংক্রান্ত ব্যবসায়ে জনগণের নাভিশ্বাস উঠলেও সুখে শান্তি স্বগৌরবে মেডেল প্রাপ্তিতেও লাভ। বিষয়টি সম্প্রতি ফলাও করে পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলি বিভিন্ন সভায় অভিযোগ আনছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও সম্প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত। গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক বিরোধীদের উপর দমন-পীড়নের আর্তনাদ শুনতে পেলেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত শুনতে পাচ্ছেন? কারাগারে গেলেও বাণিজ্যের খপ্পরে পড়তে হয়। কারা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চ.ঈ অর্থাৎ চবৎংড়হধষ ঈধংয নামে একটি ব্যবস্থা আছে, যেখানে টাকা জমা দিলে নিজ চাহিদা মতো খাদ্য খাওয়া যায়, তবে মূল্য আকাশচুম্বী যার মুনাফা ভোগ করে কারা কর্তৃপক্ষ। যাদের অর্থ আছে তারা কারাগারে নিজেরা চাহিদা মতো খাদ্য খায়, আর যাদের টাকা নাই তারা চেয়ে চেয়ে দেখে। এ ব্যবস্থায় মুনাফা রাষ্ট্রীয় খাতে জমা হয় না, এটা কারা কর্তৃপক্ষের অলিখিত একটি ব্যবসা।
গায়েবী মোকাদ্দমাগুলি বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ১৫(৩) ধারা এবং ১৯০৮-এর বিস্ফোরক উৎপাদন আইনের ৩/৪ ধারায় রুজু করা হয়েছে এবং হচ্ছে যার শাস্তির সর্বোচ্চ বিধান করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। আসামি করা হয়েছে বিছানা থেকে উঠতে পারে না সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, সিনিয়র অ্যাড. খোন্দকার মাহাবুব হোসেন, আ. রেজেক খাঁনসহ সিনিয়র নাগরিকদের; যাদের এ দেশ ও জাতি গঠনে ব্যাপক ভ‚মিকা ও অবদান রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের বিনা ভোটে একতরফা নির্বাচনে পুনঃ নির্বাচিত হওয়ার জন্য যারা যারা প্রতিবন্ধক হতে পারে (গ্রাম ও ওয়ার্ড থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত) সকলকেই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। যাতে করে নির্বাচনকালীন সময়ে এ সকল ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় অতিথির মতো জেলখানায় থাকতে পারে। ইতিপূর্বে অনেক প্রধান বিচারপতিই মামলার জট কমিয়ে আনার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, আরো অধিক বিচারপতি নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন, আইনমন্ত্রী গলদধর্ম হয়ে কোর্টের একোমোডেশনের জন্য হন্য হয়ে পড়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় খরচে রাষ্ট্রীয় কর্মচারী পুলিশ/ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্পৃক্ত করে বিচার বিভাগের ঘাড়ে মিথ্যার যে আবর্জনা সরকার জমাচ্ছেন তা নিরসনের জন্য প্রধান বিচারপতি ভেবেছেন কি? সরকারকে পুনরায় বিনা ভোটে নির্বাচনের জন্য এতো মিথ্যা ও মিথ্যার বাতাবরণের জন্য আইন-আদালতকে জবাবদিহিতায় ফেলে লাভ কি? বাকশাল গঠন অর্থাৎ একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য সংবিধানে পুনরায় একটি সংশোধনী আনলেইতো রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে এতো নাটকের আর দরকার হয় না। এখন সংশোধনী আনতে এতো লজ্জা কেন? অতি উৎসাহী পুলিশ জজ মিয়া নাটক করেছিল, ‘প্রকৃতি’ কিন্তু তাদের রেহাই দেয়নি। সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে নাশকতার এতো নাটক মঞ্চস্থ করলো তার জবাবদিহিতা থেকে ভবিষ্যতে রক্ষা পাবে কীভাবে?
দায়িত্ব ও কর্তব্যের দায় নিয়েই মানুষের জীবন এবং এ কারণেই কেউ জবাবদিহিতার ঊর্র্ধ্বে নয়। প্রকৃতির নিকট সকলকেই জবাব দিতে হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহা নিজেকে সরকারি ঘরনার প্রতি ঘনিষ্ঠতা ও আনুগত্য প্রদর্শনে কোন কৃপণতা করেননি। তারপরও নিয়তি তাকে ক্ষমা করেনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলায় জড়িতদের (সরকারের প্রতিপক্ষ) বিচার পাওয়ার অধিকার অনেকাংশেই তিনি সংকুচিত করেছেন। যখন নিজেদের উপর (অর্থাৎ বিচারপতিদের অপসারণ ও আদালত অবমাননা সম্পর্কিত) আঘাত এসেছে তখনই ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিকতা প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু এর পূর্বে সরকারবিরোধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার যে দমন-পীড়নের নীতি প্রয়োগ করেছে, তা প্রতিরোধে আইনগত কোন ভ‚মিকা তিনি রাখেননি, তারপরও কি তিনি স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছেন? একজন প্রধান বিচারপতিকে কতটুকু পর্যন্ত অসম্মান করা যায় তাও সরকার দেখিয়ে দিয়েছে? ঘুরে ফিরে অসহায় মানুষের মুখে একটি কথা উচ্চারিত হয় তা হলো, ‘আদালতই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।’ সরকারের নির্দেশনায় রাষ্ট্রীয় অর্থে লালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক মিথ্যা মামলা, হামলা, গুম, খুনের কারণে মানুষ যখন সন্ত্রস্ত থাকে তখন আশ্রয়স্থলে যদি আশ্রয় না পাওয়া যায়, তবে এ স্বাধীন দেশের নাগরিকরা যাবে কোথায়? বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন কি? জনগণের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সংবিধান যে নিশ্চয়তা প্রদান করেছে তার বাস্তব প্রতিফলন কি হবে না? সংবিধানকে প্রটেকশন দেয়ার দায়িত্ব কার?
প্রধান বিচারপতির নিকট সরাসরি অভিযোগ দায়ের করার রেওয়াজ/নজির পৃথিবীতে রয়েছে। একজন কিশোরী ভারতের প্রধান বিচারপতিকে পোস্ট কার্ডে একটি চিঠি দিয়েছিল। সে চিঠি আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। এ কথা সকলেই জানবেন। সরকার আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করায় দেশে যে পুলিশী রাজত্ব কায়েম হয়েছে তার অবসান হবে কি না জানি না, তবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এ মর্মে জনগণকে রক্ষা করার কোন কর্তব্য ও দায়িত্ব যদি থেকে থাকে তা দেখার প্রত্যাশায় রইলাম, বিবেচনার ভার প্রধান বিচারপতির ওপর, যিনি সংবিধানকে প্রটেকশন করাসহ ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ গ্রহণ করেছেন এবং সকল প্রকার ভয়-ভীতি, অনুরাগ ব্যতিরেকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের শপথও নিয়েছেন।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন