আবুল কাসেম হায়দার
জীবন বীমা ব্যবসা রমরমা বলে অনেক দিন ধরে শুনে এসেছি। একই কারণ দেখিয়ে বর্তমান সরকার তার প্রথম মেয়াদকালে বেশ কয়েকটি সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে। অনুমোদিত নতুন বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক বয়স প্রায় তিন বছর অতিক্রম করেছে। এসব নতুন বীমা কোম্পানি খুব যে ভালো ব্যবসা করতে পারছে তা বলা যায় না। তবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সব বীমা কোম্পানি ভালো ব্যবসা করার জন্য নানা উদ্যোগ, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের ব্যবস্থাপনা ভালো, সেসব কোম্পানি এগিয়ে যাবে; অন্যদের নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হবেÑএটাই স্বাভাবিক।
জীবন বীমার একচেটিয়া বাজার এখন দেশীয় কোম্পানিগুলোর দখলে। ২০১৪ সালে ২ হাজার ২২৬ কোটি টাকা আয় করেছে দেশীয় জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। এবার তাদের একচেটিয়া মুনাফায় ভাগ বসাতে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানি। জীবন বীমায় এবার বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর অনুমোদন পেয়েছে বিশ্বের নামি বীমা প্রতিষ্ঠান এবং এশিয়া ষষ্ঠ বৃহত্তম লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। সারা বিশ্বে বর্তমানে ২ হাজার ৪৮টি ব্রাঞ্চ অফিস রয়েছে এ কোম্পানির। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় আসছে। নতুন এ কোম্পানির নাম দেয়া হয়েছে এলআইসি বাংলাদেশ। আর এতে কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়তে যাচ্ছে দেশীয় জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। অন্যদিকে দীর্ঘ সময় থেকে এদেশে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের জীবন বীমা কোম্পানি আলিকো, যা বর্তমানে মেটলাইফ নামে পরিচিত।
এদিকে বিদেশি কোম্পানি এলে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে কয়েকটি দুর্বল কোম্পানি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, বিদেশি কোম্পানি কেবল অনুমোদন পাচ্ছে। তারা কী ধরনের পণ্য নিয়ে আসে এবং ব্যবসার ধরন দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে দেশীয় উদ্যোক্তারা। তাদের দাবি দেশীয় শিল্পের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে দেশে ৭৫টি বীমা কোম্পানি রয়েছে। এরমধ্যে জীবন বীমা ৩০টি এবং সাধারণ বীমা ৪৫টি। আর এ দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৬টি। আর এসব খাতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান। দেশের গার্মেন্ট খাতের পরে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মসংস্থানের খাত। তবে এ খাতে গ্রাহকদের বীমা দাবি পূরণ না করাসহ কোম্পানিরগুলোর বিরুদ্ধে গুরুতর বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে এ খাতে।
জানা গেছে, এলআইসি বাংলাদেশ নামের এ যৌথ বিদেশি কোম্পানির ৫০ শতাংশ শেয়ার থাকবে ভারতীয় এলআইসির। ১০ শতাংশ শেয়ার থাকবে দেশীয় দুই প্রতিষ্ঠান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ও মিউচুয়াল ফান্ড এসইএমএলের। বাকি ৪০ শতাংশ শেয়ার অন্যান্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া হবে। এছাড়া অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ব্রিটিশ কোম্পানি প্রুডেনশিয়াল লাইফ। সম্প্রতি কোম্পানিটির একটি প্রতিনিধি দল বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার (আইডিআরএ) চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে ব্যবসায় তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আর ব্যবসার অনুমতি পেলে এ খাতে তারা ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন বলেন, বিদেশি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়ার আগেই একটি প্রবিধান করা উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়নি। এখন কোম্পানিগুলো কীভাবে চলবে, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাই জানে। বিদেশি কোম্পানি এলে দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়বে। তবে তাদের কাজের ধরন দেখে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। দীর্ঘদিন থেকে জীবন বীমা খাতটি ভালো অবস্থায় ছিল ২০১৪ সালে। দেশের বীমা খাতের লাইফ ফান্ডে এক বছরে আয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। এ সময়ে এ খাতে আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এছাড়া এক বছরে সাধারণ ও জীবন বীমা মিলিয়ে প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে ৬০৯ কোটি টাকা। একই সময়ে সম্পদ বেড়েছে ৪ হাজার ২০৪ কোটি, বিনিয়োগ ২ হাজার ৮২৫ কোটি এবং প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে ৬০৯ কোটি টাকা।
গ্রাহক জীবন বীমা খাতে যে টাকা জমা করে তাকে লাইফ ফান্ড বলে। আইন অনুসারে ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি বছর সরকারি ট্রেজারি বন্ডে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হয়। সে হিসেবে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ রয়েছে ৭ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। বাকি টাকা থেকে আরও ২০ শতাংশসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগসহ মোট ৫০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে এখনও বিনিয়োগযোগ্য তহবিল রয়েছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৪ সালে জীবন বীমা খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ৬ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এ হিসেবে আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া ২০১৪ সালে বীমা খাতে বিনিয়োগের স্থিতি ২২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ১৯ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। এ হিসেবে বিনিয়োগ বেড়েছে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এ খাতে সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। কিন্তু আগের বছর ছিল ২৫ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। এ হিসেবে সম্পদ বেড়েছে ৩ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। বি আইএ সূত্র জানায়, বীমা খাতের টাকা অবকাঠামো বিনিয়োগের জন্য ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন তারা। এরপর তার পরামর্শে তিন সদস্যের একটি গঠন করা হয়েছিল।
জীবন বীমা থেকে জনগণ কী পাচ্ছে
১. আমাদের দেশে সকল ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা একান্ত নিজের মতো করে চালানোর জন্য মালিকগণ চেষ্টা করেন। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সরকার কর্তৃক আইনের মাধ্যমে সরাসরি পরিচালিত হয়। যেমন বাংলাদেশে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরাসরি সরকার কর্তৃক আইনের মাধ্যমে পরিচালিত। বাংলাদেশ ব্যাংক- ব্যাংক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি দেখভাল করে। বীমা কোম্পানিকে দেখাশোনার দায়িত্ব কন্ট্রোলার অব ইন্স্যুরেন্স বর্তমানে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ)। সব সময় আমরা দেখেছি এই নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটি বেশ দুর্বল। অনেকটা দুর্নীতিতে আচ্ছাদিত। বর্তমানে নাকি কিছুটা ভালো পর্যায়ে এসেছে। প্রধান নির্বাহী বেশ স্বচ্ছ; কর্মঠ ও উদ্যোগী। তাই বেশ কিছু পজেটিভ পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন। তাই কিছুটা হলেও বীমা ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এসেছে।
২. তবে আরও বেশি পদক্ষেপ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসার উন্নতির জন্য নেওয়া প্রয়োজন। যেসব কোম্পানির বয়স তিন বছরের অধিক হয়েছে, শর্ত অনুযায়ী ওইসব কোম্পানিকে আইপিও’র মাধ্যমে ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি করার শর্ত রয়েছে। তাদের তা করতে বাধ্য করতে হবে। নতুন বা ওইসব কোম্পানিকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সময় দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুই-একটি সম্পর্কে সরকার সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অন্য সকল কোম্পানি সতর্কতার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করতে বাধ্য হবে।
৩. জীবন বীমা কোম্পানিসহ সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোতে স্বচ্ছতার বেশ অভাব রয়েছে। শক্ত তদারকির অভাবে নানা দুর্নীতিতে বীমা খাত দীর্ঘদিন ধরে রোগগ্রস্ত। এই ক্ষেত্রে বীমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি দায়ী। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে বীমা কোম্পানিগুলো পাল্লা দিয়ে দুর্নীতির বাণিজ্য চালিয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। কিছু আমলা, ব্যক্তি, মালিক বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে পুরো বীমা জগতে ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এই অবস্থার জন্য বীমা কর্তৃপক্ষকে শক্ত, সৎ, স্বচ্ছ ব্যক্তি সমেত একটি মজবুতভিত্তির মধ্যে গড়ে তোলা দরকার।
৪. বিশেষ করে জীবন বীমা খাতের ওপর একটি বস্তুনিষ্ঠ জরিপ করা দরকার। দেশে বর্তমানে যে সংখ্যক জীবনবীমা কোম্পানি রয়েছে, আরও কোম্পানি দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা? তাছাড়া বিদেশি জীবন বীমা কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করার পর সিদ্ধান্ত সরকারকে নেওয়া উচিত। আমরা আমাদের ব্যবসা করতে সক্ষম হলে কেন বিদেশি কোম্পানিকে আমাদের ব্যবসার ভাগীদার করতে হবে? তার তো কোনো প্রয়োজন দেখি না। দেশের মানুষের স্বার্থ প্রথমে দেখা প্রয়োজন। অবশ্যই সরকার দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে বিদেশি কোম্পানিকে সারাদেশে ব্যবসা করার অনুমতির কথা ভাববেন।
৫. মেটলাইফ আলিকো বিদেশি কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সদ্য অনুমোদনে পেয়েছে ‘এলআইসি বাংলাদেশ’। আলিকো সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আজ পর্যন্ত করা হয়নি। কোম্পানিটি কী কী কাজ করছে, কীভাবে করছে, দেশ ও জনগণ কতটুকু উপকৃত হচ্ছে, নতুবা দেশের কোনো আর্থিক ক্ষতি করছে কিনা প্রভৃতি। আজ আমাদের এই সকল বিষয় জানার সময় এসেছে। যখন তখন যে কোনো বিদেশি কোম্পানিকে দেশে বীমা খাতে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ দেওয়ার পূর্বে সব বিষয় খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
৬. সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, আমাদের সৎ হতে হবে। শুধু বীমা ব্যবসা নয়, সকল ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা ছাড়া মানবতার কল্যাণ করা যায় না। সৎ না হলে নিজের জীবনেরও দীর্ঘ মেয়াদি কল্যাণ আসে না। অন্যায়, দুর্নীতি, ঘুষ, জালিয়াতির মাধ্যমে আমরা কেউ কেউ হয়তো সাময়িক চমক দেখতে পারি। কিন্তু এই চমক দীর্ঘ স্থায়ী হয় না। দীর্ঘ স্থায়ী হয় সততা, সৎকর্ম, ন্যায় কাজ ও সৎ উপদেশ। দেশে আজ সেই বিষয়টির বড়ই অভাব। শুধু বীমা খাত নয় সকল খাতেই সততাকে সর্বোচ্চে স্থান দিতে হবে। তবেই বিজয় আসবে সহজে।
য় লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন