শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ইভিএম কেনায় এত গরজ কেন?

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম


যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনছে বাংলাদেশ। একেকটা মেশিনে ক্রয়ে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকার পার্থক্য। এটা কি সম্ভব? বাংলাদেশ একটি ইভিএম কিনছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকায়, সেখানে ভারতে ব্যবহৃত নতুন মডেলের ইভিএমের দাম মাত্র ২১ হাজার ২৫০ টাকা। কোথায় ২ লাখ ৩৪ হাজার, আর কোথায় ২১ হাজার। একে ‘তুঘলকি’ কাণ্ড ছাড়া আর কি বলা যায়? এর ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইভিএম ক্রয় নিয়ে আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। দামের আকাশ-পাতাল ফারাকে সন্দেহ তৈরি হয় যে, তড়িঘড়ি করে প্রকল্প নেয়ার উদ্দেশ্য কি ইভিএম কেনা, নাকি অন্যকিছু?

সংবিধানিক পদে থেকে, দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করে, যেন তেনভাবে জনগণের কষ্টার্জিত টাকা বেহিসাবী অপব্যায়, অপচয় করা অনুচিত। জনগণের প্রতিটি টাকা হিসাব করে খরচ করতে হবে। যে দেশের সব মানুষ দুবেলা পেটভরে খেতে পারে না, সে দেশে ভোটের জন্য মেশিন ক্রয়কে তুঘলকি কান্ড ছাড়া আর কি বলা যায়? ইভিএম প্রকল্পে কেনাকাটার নামে অহেতুক ও বিস্তীর্ণ বিলাসিতার হেতু কী?

’৭১ সালে লাখো দেশপ্রেমিক যুদ্ধ করেছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুশীল, সুশাসিত ও শোষণহীন দেশের প্রত্যাশায়। হয়েছে কি দুর্নীতি ও নিপীড়নের শ্বাসরোধী অবস্থা থেকে দেশবাসীর মুক্তি? ইতোপূর্বে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতি করা হয়েছিল। ভোটিং মেশিন ইভিএম নিয়েও দূর্নীতি হবে এটা কল্পনা করা যায় কী? ইভিএমে নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের আপত্তি পূর্ব থেকেই। তাহলে- ভোটপর্ব উদ্ধার ও ক্রয় নিয়ে ব্যবসা, ‘এক ঢিলে দুই পাখি শিকার’ হবে নাতো!

ভারত বহু বছর আগে থেকেই ইভিএম ব্যবহার করছে। তাদের ইভিএমের মান খারাপ নয়। তাদের ইভিএম আর বাংলাদেশের ইভিএমের কনফিগারেশন হুবহু এক না হলেও তাতে এত বেশি পার্থক্য নেই যে, দুই দেশের ভোটযন্ত্রের দামে ১১ গুণ পার্থক্য হবে। বাংলাদেশের ইভিএমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি যা হাতের আঙুলের ছাপ দিয়ে বা স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভোটারের পরিচয় নিশ্চিত করা হবে। ভারতের ইভিএমে এই সুবিধা নেই। তবে ভারতের ইভিএমে ভ্যারিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) সংযুক্ত আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইভিএমে সেই সুবিধা নেই। তাহলে গুণগত মানের বিশেষ পার্থক্য কোথায়? বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে কিছু পার্থক্য থাকলেও দামের এ বিশাল পার্থক্যকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

ইসি দাবি করছে, গুণগত মান বিবেচনায় বাংলাদেশের ইভিএমের দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম পড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে ইভিএম তৈরির জন্য যে কারিগরি পরামর্শক কমিটি করা হয়েছিল, ইসি সে কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি আমলে নেয়নি কেন? এর আগে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন বাংলাদেশে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে। ওই ইভিএম তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েটের তৈরি ইভিএমে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছিল। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বাড়াতে বুয়েটকে দিয়েই ইভিএম তৈরি করা দরকার ছিল, যাতে ইসির খরচও কম পড়তো।

বিশ্বে বাংলাদেশের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি রয়েছে। তাই গোপনে যে ইভিএম সরবরাহ করা হবে না এমন নিশ্চয়তা অন্তত বাংলাদেশে আশা করা যায় না। ইভিএমের প্রতিটি ইউনিট চালু অবস্থায় পৃথক করার সম্ভাবনার সাথে কেন্দ্র দখলের পর গোপনে সরবরাহকৃত অগ্রিম ভোট দিতে ইভিএমের শুধু কন্ট্রোল ইউনিট প্রতিস্থাপন করলেই চলবে। ইতোমধ্যে ইভিএমে ভোট গ্রহণ ও ফল ঘোষণার কাজে মোবাইল রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম (ওয়াকিটকি) ব্যবহার করতে অতিরিক্ত দুই হাজার ৫২ কোটি টাকা চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ইসি। মাইক্রোকন্ট্রোলার চিপ নিয়ন্ত্রিত এই ইভিএমের প্রতিটি স্মার্টকার্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ। অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতা পেলে কোনো প্রার্থীর কর্মীরা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কয়েকশ মিটার দূর থেকেও কন্ট্রোল ইউনিট নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হতে পারে, যাতে ফলাফল শতভাগ অনুকুলে যেতে পারে ভোট চোরদের।

ইভিএমের সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে? দ্বদ্ব আর বিতর্কের পাঠ চুকিয়ে এই মেশিন কি আমাদের অগ্রগতির সহায়ক হবে না প্রতিবন্ধক? এই প্রশ্ন দেশপ্রেমিক সর্বসাধারণের।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন