বলতে গেলে সারা বছরই দেশে হাইস্কুল/ মাদ্রাসা ও হায়ার সেকেন্ডারি অনার্স, মাষ্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলতেই থাকে। প্রায় প্রতি বছর এসব ফাইনাল পরীক্ষায় একাংশ অসাধু চক্রের সৌজন্যে অসদুপায় অবলম্বনের ঘটনা ব্যাপক পর্যায়ে সংঘটিত হয়ে থাকে বলা যায়। এমনকি বলতে বাধা নেই যে, কিছু কিছু এলাকায় এ-ধরনের প্রবণতা এক স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ছাত্রজীবন থেকে দেখে আসছি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনে একাংশ পরীক্ষার্থী ও তাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমর্থকরা কী ধরনের তৎপর থাকেন, তারা সেটা না-করে যদি নিজ নিজ পড়াশুনার জন্য যতœবান হতেন তাহলে পরীক্ষার সময় অসদুপায় অবলম্বনের কথা হয়তো তাদের মাথায়ই আসত না। কিন্তু একাংশ ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষায় নকল করার অভ্যাস, তা বোধহয় আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে চলে আসছে। বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকায় পরীক্ষায় অসুদপায় অবলম্বনের নানা দিক সম্পর্কে আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। যারা অসদুপায় অবলম্বন করে, তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে আশ্চর্য হতে হয়। এরা যদি তাদের প্রতিভাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাত, তাহলে শুধু পাশ নয়, পরীক্ষায় অনেক ভালো ফল করতে পারত।
পরীক্ষায় অসদুপায় বন্ধ করার জন্য পরীক্ষা বিভাগ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এ বিষয়ে প্রতিটি পরীক্ষা বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট নিয়মাবলি রয়েছে। কিন্তু শুধু নিয়ম থাকা যথেষ্ট নয়, যদি এটার সুষ্ঠু প্রয়োগ না-হয়। স্কুলজীবন থেকে সকলে একটি বিষয়ে অবগত থাকেন, তা হল এক্সটার্নাল এগজামিনার। পরীক্ষার পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে অনেক সময় এঁরা নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হন। অনেক সময় প্রাণঘাতী আক্রমণের কবলেও পড়েন। আজকাল অবশ্য সরকারি পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা কঠোর করা হয়েছে। কিন্তু এস.এস.সি/এইচ.এস.সি পরীক্ষার মতো সারা দেশব্যাপী বিশাল সংখ্যক পরীক্ষার্থী থাকায় পরীক্ষার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। আসলে মানুষ নিজে থেকে না-শুধরালে বল প্রয়োগ করে তাকে শোধরানো অনেক কঠিন।
পরীক্ষার অসদুপায় অবলম্বন এবং তাতে সমর্থন জোগানো এক ধরনের বড় মাপের দুর্নীতি। অনেক সময় কেউ কেউ নগদ অর্থের বিনিময়ে প্রক্সি পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় এবং ধরা না-পড়লে এটাকে তেমন দোষের কিছু বলে মনে করে না। আমাদের দেশ দুর্নীতির উর্বর ক্ষেত্র ও কালো টাকার ভান্ডারে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়।
পরীক্ষায় অসদুপায়ের আশ্রয় নেওয়া ও প্রশ্রয় দেওয়া আমাদের সমাজে এক সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে বললে বোধহয় ভুল হবে না। সৃষ্টির সেরা দান জ্ঞানকে নিয়ে যেভাবে অপবিত্রতায় মেতে ওঠেন একাংশ তথাকথিত শিক্ষিত জন, তা সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের মনে অবশ্যই আঘাত দেয়। আমরা যদি বিশেষভাবে ইসলামি অনুশাসনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব ইসলামি শিক্ষায় প্রতারণা তথা অসদুপায়ের আশ্রয় নেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যারা এ-ধরনের কাজ করেন, তারা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে মহানবী (স.) তাঁর অনেক বাণীতে উল্লেখ করেছেন।অসৎ মানুষ জীবনে অনেক ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তার মধ্যে একটি হল বিভিন্ন পরীক্ষায় বিশেষভাবে স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজের পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা ও এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া। দুঃখের বিষয় যে, পিএইচডি ডিগ্রির মতো সম্মানজনক ডিগ্রি অর্জনে অসদুপায় অবলম্বনের কথা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যারা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করে তারা আইনের চোখে অপরাধী এবং ধর্মের দৃষ্টিতে পাপী। আর যারা প্রশ্রয় দেয় তারা তো মহাপাপী বললে বোধহয় ভুল হবে না।
পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীরা প্রথমত পরীক্ষার পবিত্রতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, সদুপায়ে পরীক্ষা দেওয়া পরীক্ষার্থীদের হক নষ্ট করার অপরাধের জন্য নিজেদের হারাম কাজে জড়িয়ে ফেলে। অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে যে ফললাভ করে তা অবশ্যই অবৈধ হয় এবং এ অবৈধ ফলাফল নিয়ে জীবনে যা কিছু অর্জন করেতা চিরকালের জন্য অপবিত্রতায় কুলষিত হয়ে যায়। এ-ধরনের লোক জীবনে যে পেশা অবলম্বন করবে, তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অপবিত্রতায় জড়িত করার দায়ে ইহকাল, পরকাল সর্বত্র ধিকৃত হবে। আর এতে সন্দেহের কিছু আছে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যের কথা, অনেক সময় দেখা যায় এ ধরনের গর্হিত কাজে একাংশ তথাকথিত শিক্ষক বা শিক্ষিত মানুষ বা বকধার্মিকরা তেমন কোনো অন্যায় খুঁজে পান না। পবিত্র কুরআন দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে-‘হে মানুষেরা! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র (খাদ্য) আছে, তা হতে তোমরা খাও, এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রæ (০২ : ১৬৮)।’ তাই পবিত্র কুরআনে বিশ্বাসী কোনো মানুষ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করতে পারে না। কারণ সততা, ন্যায়পরায়ণতা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের সুবাদে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় পেয়েছি যে, ধর্মের পোশাক পরা তথাকথিত অনেক সজ্জল বাঁকাপথে পরীক্ষা পাশের জন্য আমার সাহায্য নিতে চেয়েছেন। কিন্তু এসব সম্ভব নয় বলায় এরা আমাকে দুর্বল বলে সমাজে অপপ্রচার করেছেন। মহান আল্লাহ যেন সবাইকে সুপথ প্রদর্শন করেন এমন কামনা করেশান্তি লাভ করছি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় যে, একাংশ তথাকথিত শিক্ষক এ-ধরনের অসাধু কাজে নিজেদের জড়িয়ে নেন। সর্ষের মধ্যে যখন ভূত ঢুকে যায়, তখন ভূত তাড়াবে কে?
শুধু আইন প্রণয়ন আ কড়াকড়ি করে এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এর মূলোৎপাটন সম্ভব বলে মনে হয় না। সময়সূচি ঘোষণার পর এ-ধরনের অসৎ তৎপরতা বন্ধের জন্য শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে সচেতনতা সভা আয়োজন করা যেতে পারে। এমনকি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ এ-বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কারণ কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের বিপথগামী করতে একাংশ কুশিক্ষিত লোক প্রতি বছর সক্রিয় থাকে। সকল ধর্মীয় পন্ডিত যদি এ-বিষয়ে মানুষকে সুপথ দেখাতে এগিয়ে আসতেন, তাহলে অবশ্যই সুফল মিলত। কিন্তু আশ্চার্যজনকভাবে তাঁরাও এ-বিষয়ে অনেকটা উদাসীন বললে বোধহয় ভুল হবে না।
আশা করি, এ-বিষয়ে সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং আমাদের সমাজ এ-ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে। তবে এটাও টিক, প্রশাসন কঠোর হলে অনেক বিষয় শোধরানো যায়। তাই পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন বন্ধ করতে পরীক্ষা বিভাগ তথা সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তা নির্মূল করা অসম্ভব নয়। তাই এ-বিষয়ে নজর দিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি রইল বিশেষ আবেদন এবং পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা। কারণ সুন্দর জীবন গঠনের জন্য সৎভাবে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করে অতুলনীয় কৃতিত্বের অধিকারী হওয়া অবশ্যই বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন