রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সাংবিধানিক আইনের লঙ্ঘন কাম্য নয়

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায় এমনি ধারণা জন্ম হওয়ার কথা যে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি একমাত্র তারাই। তারা ছাড়া আর সকলেই পাকিস্তানপন্থী, স্বাধীনতাবিরোধী। এভাবেই সরকার জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করছে উন্নয়নের ধোয়া তুলে। সরকার জনগণের নিকট থেকে কড়ায়-গণ্ডায় কর আদায় করছে। কর বাবদ আদায়কৃত অর্থ পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য নয়, বরং পদ্মা সেতু নির্মাণ করার জন্যই। একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করা, যার অঙ্গীকার রয়েছে লিখিত বা অলিখিত সংবিধানে। কষ্টার্জিত আমাদের স্বাধীনতার ফলে যে সংবিধান রচিত হয়েছে সে সংবিধান কি সরকারের অযাচিত প্রভাবের কারণে জনগণকে সুরক্ষা দিতে পারছে? সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার-মানবাধিকার যখন সরকার কর্তৃক নিগৃহীত হয় তখন আশ্রয়স্থল থাকে একমাত্র আদালত, মানুষ যাকে শেষ ভরসা মনে করে। আদালত যখন কুক্ষিগত হয়ে পড়ে তখন সংবিধানের পাশে দাঁড়াবে কে? এমতাবস্থায়, জনগণের অধিকার রক্ষায় যখন আইনগত প্রটেকশন পাওয়া না যায়, তখনই সৃষ্টি হয় স্বৈরাচার। একটি রাষ্ট্র যখন স্বৈরাচারের কবলে পতিত হয় তখন যিনি কর্তা তার কথাই আইন, তিনিই সংবিধান, তিনিই বিচার, তিনিই আস্থা-অনাস্থার মালিক হয়ে যান, যেমনটি পৃথিবীর অন্যতম স্বৈরাচার লুই বলতেন যে, আমিই রাষ্ট্র। অর্থাৎ আইনের শাসনের পরিবর্তে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রধান হয়ে উঠে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন নারী সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলেছেন বিধায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলা থেকে আদালত কর্তৃক প্রতিনিয়ত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। ধরে নেয়া যাক, মইনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলে একটি অপরাধ করেছেন, কিন্তু সে অপরাধের বিচার কোন পদ্ধতিতে হতে পারে তা নিশ্চয় আইনের কোথাও না কোথাও লিপিবদ্ধ রয়েছে। যে সংবিধান বলতে বলতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অজ্ঞান হয়ে পড়েন তাদের জানা উচিৎ যে সংবিধানে এ সম্পর্কে কী লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৫(২) তে বলা হয়েছে যে, ‘এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপার্দ ও দণ্ডিত করা যাইবে না।’ মইনুল হোসেন একজন নারীকে একবারই চরিত্রহীন বলেছেন। সেজন্য তার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা আইনসম্মত হতে পারে? সংবিধানের ১১৬ক ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন।’ অথচ মামলাগুলিতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার বিষয়ে জনগণ কোনটা বিশ্বাস করবে? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা স্বাধীনভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, না কি সরকারের নির্দেশে ওয়ারেন্ট জারি হচ্ছে?
যাকে মইনুল হোসেন চরিত্রহীন বলেছেন, তিনি একজন নারী, এটাই আমার মুখ্য বিষয়। কারণ প্রতিটি নারী মায়ের জাতি। নারী জাতি সৃষ্টি না হলে পৃথিবী সৌন্দর্য্য হারিয়ে ফেলতো, যদিও ক্ষেত্র বিশেষে নারীর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে পৃথিবীতে অনেক ব্যক্তির ব্যক্তি বা সাংসারিক জীবন ধ্বংস হয়েছে। তবে সব কিছুই ক্ষেত্র বিশেষ প্রযোজ্য। আমার মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তার পা ছুঁয়ে সালাম না করে আমি ঘর থেকে বের হতাম না। আমার কষ্টার্জিত অর্থে গড়া প্রতিষ্ঠান যথা- বেগম রোকেয়া খন্দকার পৌর উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া খন্দকার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া খন্দকার সড়ক নামকরণ আমার মায়ের নামে করেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নারী জাতি অনেক অনেক সম্মানের পাত্র।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) এক সাহাবীর প্রশ্নের জবাবে মা’য়ের মর্যাদার তিনধাপ পরে পিতাকে স্থান দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথির ভাষণে পুরুষ নির্যাতনের কথা যদিও উপহাস করে বলেন তবুও নারীর অত্যাচারে পুরুষ কতটুকু নির্যাতিত তা ভুক্তভোগী ছাড়াও সমাজ ও জাতি অবহিত রয়েছে। এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে বলতে চাই, মইনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলায় বুদ্ধিজীবী, নারী সমাজ, সাংবাদিক, শিক্ষকমণ্ডীর রাস্তায় মানববন্ধন, ঝড়ু মিছিল করেছে, জেলায় জেলায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু তসলিমা নাসরিন যে একই নারীকে ‘ভীষণ চরিত্রহীন’ বললেন তাতে কারো গায়ে বা মনে আঘাত লাগলো না কেন? এ মর্মে তসলিমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন তো দূরের কথা একটি বিবৃতিও তো পত্রিকায় প্রকাশ পেলো না। এতেই পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়, মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় দায়েরকৃত মামলা ও সংবিধানের ৩৫(২) ধারা লংঘন করে ইস্যুকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা ও তার কারাবরণ নারীকে অসম্মান করার জন্য নয়, বরং সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই। ঘটনাটি শোনার পর আমি দুদিন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সাথে টেলিফোনে কথা বলি। তিনি স্পষ্টভাবে আমাকে বলেন, ‘আমি (মইনুল হোসেন) নিজে টেলিফোন করে মাসুদা ভাট্টির নিকট ক্ষমা চেয়েছি।’ টেলিফোনে কথা শোনার পর আমার ধারণা হয়েছিল যে, রাষ্ট্র-সরকার এ ব্যাপারে প্রতিহিংসামূলক খেলায় মত্ত হবে না। যদি হয় এটা একটা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পূর্বে শুনেছি যে, নারীকে পুরুষ বা পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সবই পারে। কিন্তু এখন দেখছি বাংলাদেশ সরকার সবই পারে, সংবিধান ও আদালত যেহেতু তাদের হাতের মুঠোয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে চিনি দীর্ঘদিন। তার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে থাকাবস্থায় নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন জেলায় একই হোটেলে অবস্থান, দূরপাল্লার জাহাজে এক সাথে ভ্রমণসহ তার সাথে পিরোজপুর জেলায় তাদের পুরোনো পৈত্রিক বাড়িতে গিয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত অনেক সভায তার বাসভবনে অংশগ্রহণ ও সাজু ভাবীর আপ্যায়ন গ্রহণ করেছি। বহুদিন একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিটিং সংক্রান্ত বিষয়ে আমার উপলব্ধি হয়েছে, মইনুল ভাইয়ের মেজাজ নিয়ে কথা থাকলেও সততা নিয়ে প্রশ্ন নাই। তার সাথে দীর্ঘদিনের উঠাবসা করতে গিয়ে কখনো তাকে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিতে দেখি নাই। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ তার পিতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং দৈনিক ইত্তেফাকের স্বাধীকার ও ৬ দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সেই মইনুল হোসেনকে যদি জামায়াতে ইসলামের প্রতিনিধি বলে সম্বোধন করা হয় এবং এতে তিনি রাগান্বিত না হয়ে যদি নিরব থাকতেন বা হাসি মুখে উড়িয়ে দিতেন তবে তো মাসুদা ভাট্টির কথাকেই সমর্থন করা হতো বৈ কি! মাসুদা ভাট্টি মইনুল হোসেনকে জামায়াতের প্রতিনিধি বলে সত্যের অপলাপ করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য রাষ্ট্র বা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি কিন্তু এগিয়ে এলো না। তার ফলে এটাও প্রতীয়মান হয়, স্বাধীনতার চেতনা রক্ষাকারীদের মইনুল হোসেনের বিরদ্ধে ঝড়ু মিছিল স্বাধীনতার চেতনা অক্ষুণœ রাখার জন্য নয়, বরং সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণেই। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিলে স্বাক্ষর না করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু একজন সংবাদ মাধ্যমেই ব্যক্তিত্ব মইনুল হোসেন যখন নিবর্তনমূলক ডিজিটাল আইনে সিরিজ মামলায় আক্রান্ত তখন একশ্রেণির সাংবাদিক নেতারা মুখে কুলুপ মেরেছেন কেন? কারণ তারা সরকারের তাবেদারী করে অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। সাগর-রুনির মামলার ফয়সালা না করে ঘরে ফিরবেন না বলে যারা ঘোষণা দিয়েছিলেন তাদের মুখেও রা নাই। কারণ তারা এখন সরকারের সুবিধাভোগী। জাতীয় প্রেস ক্লাব, বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলিও সরকারি ঘরনার বুদ্ধিজীবীরা করায়ত্ত করে রেখেছেন, যেখানে বিরোধী মতবালম্বীদের প্রবেশের বিন্দুমাত্র কোনো সুযোগ রাখা হয় নাই। মইনুল হোসেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশালকে সমর্থন না করে এক ‘অপরাধ’ করেছিলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পুনর্বার ‘অপরাধী’ হয়েছেন, একথা দিনের আলোর মতো সত্য। তবে যারা মনে করে, দেশবাসী সকলেই লেবেনচুষ খায়, তাদের কথা ভিন্ন।
দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে করায়ত্ত করা হয়েছে। সংবিধান মতে, ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য সম্পাদনে স্বাধীন। সংবিধান আরো বলেছে, একটি অপরাধের জন্য একজনকে একাধিক বার আইনে সোপর্দ করা যাবে না। তারপরও একই অপরাধের জন্য মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে সিরিজ ওয়ারেন্ট কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিচয় বহন করে? সরকারের সাবেক মন্ত্রী আ. লতিফ সিদ্দিকী হজ্জ নিয়ে যে কুটুক্তি করেছিলেন, তাকে সমর্থন করি নাই এবং কোনো বিবেকমান মানুষ তা সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একই কারণে জেলায় জেলায় সিরিজ মোকদ্দমাও সমর্থন করি নাই, বরং প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছি। সংবিধান, আদালতের স্বাধীনতা বা স্বাধীনতার চেতনা রক্ষা মুখ্য বিষয় নয়, বরং সরকারের ইচ্ছার বাস্তবায়নই হলো মুখ্য বিষয়। কর্তা খুশি তো সব খুশি এ নীতিতেই চলছে বাংলাদেশের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলি। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্ম যখন গবেষণা করবে তখন বর্তমানে অবস্থাকে তারা কি শ্রদ্ধার চোখে দেখবে? তারা সংবিধান ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কী ধারণা নেবে?
হাতের কাছে পেলেই পুলিশ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের পিটিয়েছে। যেমন আ. মতিন চৌধুরী, মো. নাসিম, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর প্রমুখ। ম. খা. আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে আমাদের সাথেই কারাগারে ছিলেন। তখন পুলিশী ব্যবস্থা সম্পর্কে তার যে অভিমত শুনেছি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর শুনেছি উল্টো সুর। অনেক আইনমন্ত্রীর সাথে কারাবরণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ১/১১ সরকারের সময় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যে ভঙ্গিতে দুদুক ও পুলিশী কর্মকাণ্ডের সাফাই গেয়েছেন তার ব্যতিক্রম ঘটান নাই বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আনিসুল হকের ক্ষেত্রেও কোনোদিন পরবর্তী কোনো আইনমন্ত্রীকে এমনিভাবে আদালত ও পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইতে হয় কিনা তাও ভবিষ্যতই বলতে পারবে। স্মরণ রাখা দরকার যে, ইতিহাসে কাউকে ক্ষমা করে না, তবে ক্ষমতায় থাকাবস্থায় কেউ তা বোঝে না।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন