বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

দুর্নীতি কি, এর কোনো ব্যাখ্যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধি-২০০৭-এ নাই। তবে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ ধারায় Criminal Misconduct -এর ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। আইনটি ১১ মার্চ, ১৯৪৭-এ উপমহাদেশে কার্যকর হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হিসাবে জন্ম লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তখন এ দেশে আইনটি বলবৎ হয়। দুর্নীতির বিচার হয় আদালতে। কিন্তু আদালত কার্যালয় কতটুকু দুর্নীতিমুক্ত তাও বিবেচনায় নেয়া দরকার। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আদালতের প্রাঙ্গনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। এই দুর্নীতির কথা বিচারকগণ জানেন, তারপরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আদালত প্রাঙ্গনের ঘুষ যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আদালতের কোনো আদেশ বাড়তি টাকা ছাড়া রিলিজ করা যায় না। ফলে গরিব মানুষের ভোগান্তি দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা বিনা দোষে গায়েবি মামলায় আসামি তাদের রিলিজ অর্ডার রিলিজ হওয়ার পূর্বে জামিনের সময়সীমা শেষ হয়ে যায়, অন্যদিকে টাকার শ্রাদ্ধ তো আছেই।
সি.সি. ক্যামেরায় ঘুষ আদান-প্রদানের দৃশ্য দেখে সুপ্রিম কোর্টের উল্লেখিত তিন কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু যে ঘুষ আদালতের প্রাঙ্গনে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে তা উৎখাতের জন্য বিচারপতিরা যুগ যুগ ধরে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? আদালত প্রাঙ্গনের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অনেক ঘটনা নিরবে নিভৃতে নিঃশেষ হয়ে যায়। গত ১০ অক্টোবর একটি জাতীয় পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, ‘নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর ফাঁসির দন্ডাদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলেন ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী (৬৫)। সাতক্ষীরার জোড়া পুলিশ হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি ওবায়দুর রহমান খুলনা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ছয় মাস আগে উচ্চ আদালতের আদেশে এ হত্যা মামলা থেকে ওবায়দুর খালাস পান। তার কারামুক্তির আইনগত কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৩ বছর জেলে থাকার পর গত রবিবার সকাল ৯টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আর বিকেলে কারাগারে পৌঁছায় ফাঁসির দন্ড থেকে তার খালাসের আদেশ। ওবায়দুরের স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন জানান, তার স্বামী বিনা দোষে ১৩ বছর জেল খেটেছেন। তিনি একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তিনি তার নিরপরাধ স্বামীর জেল খাটা ও যথাযথ চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।’
আমরা জাতি হিসেবে কতটুকু বিবেকমান এই একটা সংবাদ পাঠ করলেই ভবিষ্যত প্রজন্ম বুঝে নিতে পারবে। ১৩ বছর জেলে থাকাবস্থায় খালাস পাওয়ার পরও ওবায়দুর রহমান মুক্ত আকাশের নিচে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারলেন না, বরং সাজামুক্ত একজন ব্যক্তিকে বিনা চিকিৎসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হলো। ওবায়দুর রহমানের এই আর্তনাদ রাষ্ট্রের কর্ণধার ও বিচারপতিদের কর্ণকুহরে পৌঁছবে কিনা জানি না। তবে সরকার বা বিচার বিভাগ যদি জবাবদিহিমূলক হতো, নিশ্চয় এর একটা জবাব জাতির নিকট পৌঁছতো। এ বিষয়টিকে টেস্ট কেস হিসেবে নির্ধারণ করে সরকার বা বিচার বিভাগ যদি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জাতির সামনে উপস্থাপন করত তবে দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলার একটি চিত্র জাতির সামনে উন্মোচিত হতো। কিন্তু তারা এটা করবেন না এজন্য যে, এতে তাদের চেহারাও উন্মোচিত হয়ে যাবে। একটি জাতি মজবুত হয় জবাবদিহিতার মাধ্যমে। জবাবদিহিতার মাধ্যমেই ভাগ্যাহত মানুষ কিছু পেতে পারে। তাদের কিছু পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন জবাবদিহিতা। যে জাতির কর্তাব্যক্তিরা জবাবদিহিতাকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র উপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যস্ত থাকে, সে জাতির দুর্ভোগ-দুর্গতির কোনো সীমা থাকে না।
আদালতের কর্মপরিধি শেষ হয় সাজা বা খালাসের মাধ্যমে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, কারাগারকে শাস্তির বা সাজা ভোগের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা না করে অপরাধীকে বিশুদ্ধ করার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা উচিৎ। অপরাধীদের বিশুদ্ধ করার ফলে পৃথিবীর অনেক কারাগার পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কারাগার কারাকর্তৃপক্ষের একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত হয়ে উঠেছে। যার জন্য কেউ কেউ ছোট অপরাধের জন্য জেল খেটে ভয়ঙ্কর অপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে কোনো গবেষণাও নাই। অন্যদিকে সরকার প্রতিহিংসা পরায়ন হওয়ায় দিন দিন জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জাতি দিক নির্দেশিত হচ্ছে উল্টো পথে। আমাদের দেশে কারাগারগুলি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে তা ভুক্তভোগী সকলেই জানেন। তাছাড়া নিম্ন প্রকাশিত সংবাদ থেকে আরো তথ্য পাওয়া যায় যা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, জাতির পায়ে কুঠারাঘাত করার জন্য দায়ী কারা?
গত ২৯ অক্টোবর একটি জাতীয় পত্রিকায় নিম্নবর্ণিত সংবাদ প্রকাশিত হয়: ‘গত শুক্রবার দুপুরে ভৈরবে রেল পুলিশের হাতে জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস বিপুল পরিমাণ অর্থ ও মাদকসহ আটকের পর এ প্রশ্ন উঠেছে। তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা টাকার উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস নিজেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, ওই টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ছাড়া বাকি সব টাকা কারাগারের বিভিন্ন খাত থেকে অবৈধ উপায়ে অর্জন করা। তিনি এও বলেছেন, ওই টাকার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক ও চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেলা সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকের ভাগও রয়েছে। তবে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এ দুই কর্মকর্তা। জানা গেছে, বাইরে থেকে কোনো স্বজন বন্দির কাছে ৫০০ টাকা পাঠালে ভেতরে সেই টাকা হয়ে যায় ৪০০ টাকা। কমিশন বাবদ ১০০ টাকা কারা ক্যান্টিনে কেটে নেয়া হয়। বন্দির সাথে স্বজনদের অফিস সাক্ষাৎ নামে আদায় করা হয় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। কারা হাসপাতালে থাকতে হলেও বন্দিকে গুনতে হয় প্রতিমাসে ১২-১৫ হাজার টাকা। বন্দি ভয়ঙ্কর আসামীদের রোগী সাজিয়ে কারা মেডিকেল ও বাইরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এভাবে প্রতিমাসে বিভিন্ন খাত থেকে অবৈধভাবে আয় করা লাখ লাখ টাকা ভাগ বাটোয়ারা হয় কারা কর্মকর্তাদের মাঝে। জামিনে মুক্তি পাওয়া একাধিক আসামি জানান, দুর্নীতির খাতগুলো হচ্ছে বন্দিদের সাথে স্বজনদের সাক্ষাৎ, বন্দি বেচাকেনা, খাদ্যপণ্য সরবরাহ, মাদক সরবরাহ, মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া, ক্যান্টিনে দ্বিগুণ দামে খাবার বিক্রি, টাকার বিনিময়ে হাজতিকে হাসপাতালে রাখার সুবিধা, বন্দির কাছে টাকা পাঠানো ইত্যাদি। চট্টগ্রাম কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের বন্দিকে কারা হাসপাতালে রাখা হয় টাকার অংক বুঝে। কয়েদিরা বন্দিদের কাছ থেকে এককালীন ও মাসিক হারে চাঁদা আদায় করেন। সময়মতো চাঁদা না দিলে হাজতিরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।’
এ চিত্র শুধু চট্টগ্রামের কারাগারের নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের কারাগারের চিত্র। কারাগারের প্রধান গেইটে লেখা রয়েছে, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’। অথচ সকল প্রকার দুর্নীতির সাথে কারা কর্তৃপক্ষ জড়িত। কারাগারগুলি মাদক সেবনের নিরাপদ স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষ ও দুর্নীতি, কিন্তু বিচার হয় শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের। সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা যাবে না মর্মে সরকার আইন পাশ করেছে। জনগণকে শোষণ করাতে সরকারের কোনো আপত্তি নাই, তবে যে কোনো অবস্থায় সরকারের প্রতি অনুগত থাকাটাই হলো আসল। রাজনৈতিক বিরোধীদের নিপীড়ন, নির্যাতন ও ন্যায্য অধিকার থেকে যতটুকু বঞ্চিত করা যায় তার উপরই নির্ভর করে কোন আমলা সরকারের প্রতি কতটুকু অনুগত। যেখানে গণতন্ত্র থাকে না সেখানে আমলাতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে এবং আমলাদের দুর্নীতি রেওয়াজে পরিণত হয়। বিরোধী দলীয়দের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করতে পারলেই পোক্ত হয় আমলাদের আমলাগিরি এবং বর্তমানে বাংলাদেশে তাই চলছে। নিষ্পেষিত হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। মালিক এখন তার নিজ কর্মচারী দ্বারা অপমানিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। ভাগ্যাহতদের জন্য সংবিধান ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত একটি বই মাত্র। সুবিধামত তা ক্ষমতাসীনরা কখনো মানে, কখনো মানে না।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন