পাহাড়ে কিছুতেই থামছে না আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও টার্গেট কিলিং মিশন। আঞ্চলিক সংগঠন তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নেশায় একের পর এক হত্যা, অপহরণ ও গুমের মিশন পরিচালনা করছে। অস্ত্রবাজির এই মহড়ার মূল উদ্দেশ্য চাঁদাবাজী। প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চালিয়ে অতিষ্ট করে তুলেছে পাহাড়ের ব্যবসায়ী, উন্নয়ন কর্মী ও সরকারি চাকুরেসহ সাধারণ মানুষকে। তাদের চাঁদার অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না দীন-দরিদ্র সাধারণ কৃষকরাও। প্রতিনিয়িত খুন অপহরণসহ সীমাহীন চাঁদাবাজীর কবলে চরম উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করছে পাহাড়বাসী। এই প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কতটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে খোদ প্রশাসন।
গত দুই মাসে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় পরপর অন্ততঃ ৯টি খুন, ১৫টি অপহরণ, তিনটি হত্যা চেষ্টা ও বাঘাইছড়ি সীমান্তে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালানী চেষ্টাসহ অন্তত দশটি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহ দুয়েক আগে রাঙামাটি খাগড়াছড়ি সড়কে একটি পর্যটকবাহী বিলাসবহুল বাসের উপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এদিকে চলতি বছরের পর্যটন মৌসুমের শুরুতেই পর্যটকবাহি গাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলির প্রেক্ষাপটে মাথায় হাত পড়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের।
পার্বত্য চুক্তির আগে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ছিল পাহাড়ের একক সংগঠন শান্তিবাহিনী ছিল তাদের সশস্ত্র শাখা। চুক্তির পর শান্তিবাহিনী নামের সংগঠন বিলুপ্ত করে তারা লোক দেখানো কিছু অস্ত্র সমর্পণ করলেও পাশাপাশি গড়ে উঠে ইউপিডিএফ। চাঁদাবাজীর কাঁচা টাকার লোভে এর রেশ ধরেই জন্ম নেয় একেক সংগঠন। বর্তমানে অন্তত চারটি সশস্ত্র দল পাহাড়ে সক্রিয় রয়েছে।
চাঁদাবাজীর এলাকা ভাগাভাগি নিয়ে ২০১৬ সালে তারা একটি অলিখিত সমঝোতায় উপনীত হলেও শেষ পর্যন্ত তা বেশিদিন টেকেনি। আবার শুরু হয় আধিপত্য বিস্তারের দ্বদ্ব। গত ডিসেম্বর থেকে এই লড়াই পাহাড় থেকে শান্তিতে ঘুমানোর পরিবেশ তিরোহিত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অস্ত্র উদ্ধারের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালনসহ পাহাড়ে কয়েক দফা মহাসমাবেশ করেছে। জনগণের দাবির মুখে বিগত কিছুদিন ধরে কম্বাইন্ড অপারেশন পরিচলানা করছে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী। কিন্তু অভিযানে গুটিকয়েক সন্ত্রাসী ধরা পড়লেও বাকিরা গভীর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রগুলোর রিপোর্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং এলাকাবাসীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, গত একবছরে সাধারণ মানুষ চাঁদাবাজী শিকার হলেও হত্যাকাণ্ডে তাদের নিজেদের লোকই বেশি খুন হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছে এসব দলের নানা স্তরের নেতা-কর্মীসহ জনপ্রতিনিধি।
এক বছরে পাহাড়ে অন্তত ৫০টির মতো অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে আঞ্চলিক দলীয় সন্ত্রাসীরা। সর্বশেষ খুনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে লংগদু উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড়াদম বান্দরতলায় চুক্তি বিরোধী প্রতিপক্ষের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়া বাজাগুলো চাকমা ওরফে রাজা চাকমার নাম। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপের চাঁদা আদায়কারী কালেক্টর হিসেবে সে উক্ত এলাকার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। রাজা চাকমার বাড়ি লংগদু উপজেলার বড়াদম এলাকায়। তার পিতার নাম বীরেন্দ্র চাকমা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী নির্বাচন, পর্যটন মৌসুম এবং সাম্প্রতিক সময়ে যৌথবাহিনীর সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান সবকিছুই দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জন্যে। সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী ও রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার জানিয়েছেন, পাহাড়ের এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছি। সন্ত্রাসীরা তথাকথিত অধিকার আদায়ের নাম করে পাহাড়ের সাধারণ মানুষজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছে। একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের সেই অভিযোগেরই যথার্ততা প্রমান করছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছি। আগামী নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়ে দীপংকর তালুকদার বলেন, অন্যথায় পাহাড়ের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ঘর থেকে বের হতে পারবে না।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেছেন, আমরা বেশ সতর্কভাবেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি পুলিশের ডিএসবি, এসবিসহ গোয়েন্দাদের সতর্কভাবে মাঠে রাখা হয়েছে। আমরা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন