মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সন্দেহ নেই সংস্কৃতি একটি গতিশীল ও পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই পরিবর্তন মাত্র ৫/১০ ভাগ মাইনরটির অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের অনুকূলে হবে এমনটি কেবল অপরিণামদর্শী ভাবনাই নয়, বরং এক বিপজ্জনক তামাশার নামান্তরও বটে! হেন অবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহংকার নিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে ফলাফল কাছিম আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার মতো হওয়া বিচিত্র নয়। আগাছা ফলানোর জন্য চাষ করতে হয় না, জমি পতিত রাখাই যথেষ্ট। পহেলা বৈশাখের সাথে ইঁদুর, পেঁচা, হনুমানের মুখোশ ধারণের সম্পর্ক কী? হিন্দুধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী পেঁচা-মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন। ইঁদুর-গণেশের বাহন, হাঁস-সরস্বতীর বাহন, হনুমান রামের বাহন ও মিত্র এবং সীতা উদ্ধারে সহযোদ্ধা, সিংহ দুর্গার বাহন, ময়ূর কার্তিকের বাহন, গাভি-রামের সহযাত্রী, আর সূর্যের জন্য দেবতার পদ তো আছেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই দিনে এ ধরনের ধ্যান-ধারণায় নব প্রজন্মকে প্রলুব্ধ করার উদ্দেশ্য কেবলই ফুর্তি?
বাংলা সালের উৎপত্তি যে বেদ-পুরাণ বা বৈদিক সংস্কৃতি থেকে নয় বরং হিজরি সাল থেকে, এই তথ্য হয়তো অনেকেরই জানা। সুতরাং উৎস মূল ও ঐতিহাসিক বিবেচনায় পহেলা বৈশাখের সাথে ইসলামী চেতনা ও ঐতিহ্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকলেও হিন্দু ধর্ম ও বিশ্বাসের সাথে নেই কোনো দূরতম সম্পর্ক। মুসলমান আমলে প্রায় পাঁচশত বছর রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি, আর সাল গণনা হতো হিজরি পঞ্জিকা মতে। সৌরবর্ষ অপেক্ষা চন্দ্রবর্ষ ১০/১১ দিন কম হওয়ার কারণে কৃষকদের কৃষি সংক্রান্ত কাজে দিন-ক্ষণের সঠিক হিসাব রাখা ও খাজনা আদায় কঠিন হয়ে পড়ে। এই সমস্যা উত্তরণে স¤্রাট আকবরের নির্দেশে আবুল ফজল ১৫৮৫ খ্রি. ফসলি সনের প্রবর্তন করেন (যা এখন বাংলা সন হিসেবে প্রচলিত)। এতে ৯৬৩ হিজরি সালের মহরম মাসের ১ তারিখ থেকে বৈশাখী সালের ১ম দিন গণনা শুরু করা হয়। (অর্থাৎ ১ মহরম ৯৬৩ আর ১লা বৈশাখ ৯৬৩ একই দিন ছিল।) এই নতুন সনের নাম দেয়া হয় ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ সাল। এই পরিবর্তনের পরও প্রতি ৪ বছর অন্তর ১ দিন ‘লিপ ইয়ার’-এর হেরফের থেকে যায়। এই সমস্যা মেটাতে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে পাক আমলে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রচলিত নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করা হয়। এতে প্রতি ইংরেজি ‘লিপ ইয়ার’ বর্ষে বাংলা ফাল্গুন মাসে একদিন যোগ করে সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান করা হয়। কিন্তু ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের পূজা পার্বণের দিনক্ষণ নির্ধারণে সহায়ক নয় অজুহাতে আগের নিয়মই বহাল রাখে। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের তারিখের হেরফেরের এটাই হলো কারণ। এখন প্রশ্ন হলো ৪৩০ বছর আগে যে হিজরি সাল থেকে বাংলা সালের উৎপত্তি তার সাথে পৌরাণিক যুগের রাম, দুর্গা বা গণেশ বা তাদের কথিত বাহন হনুমান, সিংহ ও লক্ষী পেঁচার কী সম্পর্ক থাকতে পারে যে কাহিনীগুলো রচিত হয়েছিল হিজরি সাল প্রবর্তনেরও কমবেশি আড়াই হাজার বছর আগে? এক সময়ের মুসলমানদের মতো এ যুগের হিন্দুরাও কি ‘এপ্রিল ফুল’ হয়ে বসে আছেন? হিন্দুদের ঐতিহ্য চেতনার উৎস বেদ-পুরাণ থাকতে হিজরি সালের শরণাপন্ন হতে হবে কোন দুঃখে, এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে?
ছোটবেলার কথা, আমাদের গ্রামে তখন হিন্দুরা সংখ্যায় নেহায়েত কম নয়। পহেলা বৈশাখ পালনের তোড়জোড় হিন্দুদের মধ্যেই দেখা যেত। বলা যায়, সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় চেতনার মধ্যদিয়ে দিনটি তারা পালন করতেন। নতুন পোশাকে পূজা-অর্চনার ঘনঘটায় আর খাওয়া-দাওয়ার বিশেষ আয়োজনে সরগম থাকত হিন্দুপাড়া। পূজার জন্য ফুলের বিশেষ কদর দেখা গেলেও ফুলের রানী গোলাপের কোনো কদর ছিল না আজকের মতোই (ইরানে জন্ম বলেই নাকি এই ব্যবহার)। তবে পান্তা সেকালের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক খাবার হলেও লবণজাত ইলিশ ছাড়া তাজা ইলিশ দেশের বৃহত্তর এলাকায় ছিল স্বপ্নের বস্তু। কারণ চাঁদপুরের ইলিশ হাজীগঞ্জে পৌঁছানোই ছিল তখন দুরূহ ব্যাপার। অতি ভোরে সূর্য ওঠার সাথে সাথে হিন্দুপাড়া থেকে নারী-পুরুষের সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ ভেসে আসতÑ ‘ভালা আসে বুরা যায়, আপদ বালা দূর হ রে-দূর হ।’ বেলা একটু বাড়তেই ধূতি পরে পুরুষরা ঢোল-তবলা বাজিয়ে প্রভাতফেরি করে হিন্দু মহল্লার প্রতিটি বাড়িতে গমন করতেন। মহিলারা ধূপ-ধূঁয়া দিয়ে তাদের স্বাগত জানাতেন, কেউ বা প্রবীণদের পদমূলে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করতেন। এই দিনে মুসলিম পরিবারগুলোতে অন্যদিনের চেয়ে ভিন্নতর তেমন কোনো আয়োজন নজরে পড়ত না। হিন্দুরা সাধারণত এদিনে কাজ-কাম না করলেও মুসলমানদের কোনো কাজই বন্ধ থাকত না। তবে সামর্থ্যবান কোনো কোনো মুসলমান পরিবারে গরুর গোশত রান্না হতো। নতুন জামাই মাটির রঙিন হাঁড়িতে জিলাপি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি আসতেন এমনটি কদাচিৎ মুসলমানদের মধ্যেও দেখা যেত। হিন্দু ব্যবসায়ী মাত্রই হালখাতা অনুষ্ঠান করলেও মুসলমানদের মধ্যে প্রচলনটা খুব কমই ছিল। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে শুভা-শুভ নিয়ে হিন্দুদের মতো মুসলমানদের মধ্যে মাতামাতি তো ছিলই না, বরং সেই যুগেও এসব বিশ্বাসকে তারা বিদায়াত বা কুসংস্কারই মনে করতেন। যদিও পড়ালেখায় তারা হিন্দু প্রতিবেশীদের চেয়ে অনগ্রসরই ছিলেন। হিন্দু প্রধান এলাকায় বৈশাখী মেলার আয়োজন হতো। সকাল থেকে একজন ঢুলি মন্দিরের পাশে বটগাছ তলে ঢোল বাজাতে থাকতেন। মেলায় বয়স্ক প্রবীণ মুসলমানদের উপস্থিতি নজরে না পড়লেও শিশু-কিশোরদের উপস্থিতি থাকত প্রচুর। শিশুদের নানা ধরনের খেলনা, বাঁশি, বেলুন, ছুরি-চাকু ইত্যাদির সমারোহ থাকত। বাতাসা, জিলাপি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাঙ্গি, তরমুজ, খিরা, আর শরবৎও বিক্রি হতো প্রচুর। শিশুদের চরকায় পাক খাওয়ার ব্যবস্থা থাকত কোথাও কোথাও। সাধারণত বটগাছ আছে এমন স্থানেই মেলার আয়োজন করা হতো। ওতে পানি সিঁদুর দিয়ে প্রণাম করতেন হিন্দু নারী-পুরুষ সবাই। বটগাছের তলে ছোট একটি অস্থায়ী মন্দিরও তৈরি হতো সেদিন। মন্দিরের দেব-দেবীগুলো উৎসুক ছেলেমেয়েদের জন্য ভয় ও কৌতূহলের বস্তু ছিল আজকের মতোই। দেবীর হাতের সংখ্যা গুনতে গিয়ে অনেকেই ভুল করত। মহেশের নাকের রহস্য জানার জন্যও আগ্রহ দেখা যেত অনেকের। তবে নরম-ুধারী কালো মূর্তিটি অনেকের কাছে ভয়ের কারণ ছিল। খেলার সাথী হিন্দু ছেলেরা বলত ‘কালী বড় ভয়ঙ্কর, ওর দিকে তাকাতেও নেই’। অনেকে তাই সরাসরি না তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে আঁড় চোখে তাকাত মূর্তিটির দিকে। মেলায় বাংলা মদের বেচাকেনাও চলেÑএমনটি শুনতাম কিন্তু দেখিনি।
একবার আমি ও আমার এক চাচাতো ভাই মেলায় গেলাম। কেনাকাটা শেষে বাড়ি ফিরব, হঠাৎ কানে এলো ‘১ পয়সা ধরলে ২ পয়সা, ২ পয়সা ধরলে ৪ পয়সা’! এগিয়ে গেলাম, পকেট হাতিয়ে একটি পয়সা পেলাম। দেখাদেখি আমিও ছুঁড়ে দিলাম। ঠিকই ২ পয়সা পেলাম। এবার ধরলাম ২ পয়সাই। আম ও ছালা দুটোই গেল। বছরের ১ম দিনেই এহেন বিপর্যয়! সারা বছরের জন্য অশুভ ইঙ্গিত নয়তো, এই চিন্তা সে রাতে মাথা থেকে সরানো কঠিন হলো। বোধকরি সেদিন জুয়া খেলায় হেরে যাওয়াতে আমার জন্য কল্যাণই নিহিত ছিল। জীবনে ওটাই প্রথম আর ওটাই ছিল শেষ খেলা। মেলায় হিন্দুরা নাকে কপালে তিলক লাগিয়ে নতুন ধূতি ও পাঞ্জাবি পরে সেজেগুজেই আসতেন। কোনো কোনো সময় মেলায় নাচ-গানের আসরও হতো। এ ধরনের আয়োজনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ দেখা যেত না। মেলায় বালা, সিঁদুর, মালা-পৈতা ইত্যাদির পরসা দেখা গেলেও টুপি, পাগড়ি, আতর-গোলাপ, সুরমা, মেসওয়াক, জায়নামাজ তসবি ইত্যাদির কোনো দোকান নজরে পড়েনি আজকের মতোই। মেলায় শিশুদের শ্লেট-পেন্সিল, বর্ণ শিক্ষা, বসাক বাবুর আদর্শলিপি, বিভিন্ন পুঞ্জিকা এবং গীতাসহ হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তিকা পাওয়া গেলেও মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় বই তো দূরের কথা কোনো মুসলমান লেখকের বইও দেখা যেত না। মেলায় সব বয়সের হিন্দু মহিলাদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও মুসলিম নারীদের উপস্থিতি ছিল শূন্যের কোঠায়। বছরের ১ম দিন বলে গোশতের চাহিদা থাকলেও মেলায় গরু জবাই হতে দেখিনি কোনো দিন। মেলায় পূজারিদের জন্য পূজার সুব্যবস্থা থাকলেও নামাজিদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা থাকত না কোথাও। মেলায় সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকত জুয়া। পূজার আসর থেকে জুয়ার আসরেই সমাগম থাকত বেশি। কোনো কোনো পূজারি পূজা সেরেই জুয়ার আসরে বসে যেতেন।
বৈশাখকে ঘিরে ইসলামী চেতনার বিরোধী প্রেক্ষাপট তৈরির পশ্চাতে এ উল্লিখিত বিষয়গুলো যে, গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিল তা অনুধাবনে কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সুতরাং আজকের চেতনা অনুযায়ী এই দিনটিকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করতে হলে সবাইকে নিজ সীমানায় থাকার মতো সংযত আচরণ ও অশ্লীলতামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে যতœবান হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অবশ্য এ লক্ষ্য অর্জনে প্রশাসনের সদিচ্ছাই যে প্রধান নিয়ামক তা এবার হাতেনাতেই প্রমাণিত হলো। (সমাপ্ত)
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন