শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

শ্রমিকের অধিকার আজও উপেক্ষিত

প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জালাল উদ্দিন ওমর
শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে প্রতিবছর ১লা মে বিশ^জুড়ে দেশে দেশে মে দিবস পালিত হয়। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বিশেষ আয়োজনে এই মে দিবস পালিত হয়। মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। মে দিবস স্মরনে রঙ-বেরঙের পোস্টার ছাপানো হয়, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আলোচনা সভা, জনসভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। প্রত্যেকেই শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। সরকার প্রধান, বিরোধীদলীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতৃবর্গ, শ্রমিক নেতৃবর্গ সবাই মে দিবস উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন এবং শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মে দিবসের ১৩০ বছর পূর্ণ হলেও, বিশ^ব্যাপী প্রতিবছর মে দিবস পালন করা হলেও, এখনো সর্বত্র শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এখনো শ্রমিকদেরকে আন্দোলন করতে হয়। শ্রমিকদেরকে এখনো মালিকপক্ষের লোকদের হাতে নির্যাতিত হতে হয়। এখনো প্রতিনিয়ত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে শ্রমিকদেরকে চাকরি হারাতে হয়, জেলে যেতে হয়, এমনকি জীবন হারাতে হয়। সুতরাং কথার ফুলজুরি নয়, আজ প্রয়োজন শ্রমিকদের অধিকার প্রদানের সত্যিকারের কমিটমেন্ট। তাহলেই সার্থক হবে সত্যিকারের মে দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা।
১৮৮৬ সালের কথা। সে বছরের ১লা মে  দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ এবং সাপ্তাহিক ছুটির দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করে। সে সময় মালিকপক্ষ শ্রমিকদেরকে ইচ্ছামতো খাটাত। সাপ্তাহিক ছুটি ছিল না। বিনোদন এবং আনন্দের কোনোটাই শ্রমিকদের জীবনে ছিল না। তাদেরকে শুধু ব্যবহার করা হতো। কাজ করতে করতে কোনো শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার ভাগ্যে জুটত চাকরি হারানোর ঘটনা। শ্রমিকরা ছিল অনেকটা কেনা দাসের মতোই। তাদেরকে ১৫/১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটানো হতো। শ্রমিকদের ছিল না কথা বলার আইনগত কোনো অধিকার। মালিকের ইচ্ছাতেই ছিল সব। মালিকের ইচ্ছাতেই শ্রমিকের চাকরি, মালিকের ইচ্ছাতেই চাকরি বাতিল। মালিকের ইচ্ছাতেই বেতন নির্ধারণ, মালিকের ইচ্ছাতেই বেতন বাতিল। মালিকের ইচ্ছাতেই কাজের সময়, পরিধি, ছুটি সবই নির্ভর করত। কথায় কথায় চাকরি হারানোর ভয়ে শ্রমিকরা তটস্থ থাকত। এটাই ছিল তৎকালীন সময়ে শ্রমিকদের দিনলিপি। কিন্তু শোষিত, বঞ্চিত এবং নির্যাতিত হতে হতে শ্রমিকরা এক সময় এই নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আন্দোলন শুরু করে। আর সে দিনটি ছিল ১৮৮৬ সালের ১লা মে। সেদিন শিকাগো শহরের লাখো শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাস্তায় নেমে আসে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা হে মার্কেটের সামনে জড়ো হয়। শ্রমিকদের এই আন্দোলন দেখে সেখানকার মালিকপক্ষ এবং পুঁজিবাদী পক্ষ ভীতসন্ত্রস্ত এবং আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পুলিশ সেই আন্দোলন দমানোর জন্য নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় এবং পুলিশের গুলিতে সেদিন ১০ জন নিরীহ শ্রমিক মারা যায়। কিন্তু এতে শ্রমিকরা দমে যায়নি বরং আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার নতিস্বীকার করে এবং শ্রমিকদের অধিকার মেনে নেয়। দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রম ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ছুটি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অনুমোদন করে। শ্রমিকদের এই বিজয়গাথা সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্রমান্বয়ে সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। মূলত সেদিন থেকেই শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের সময় চালু হয় এবং সাপ্তাহিক ছুটি কার্যকর হয়। ১৮৮৯ সালে ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১৮৮৬ সালের ১লা মে সংগঠিত শ্রমিকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানানো হয় এবং সেদিন শ্রমিকদের জীবনদানকে সম্মান প্রদান পূবর্ক ১লা মে কে বিশ^ব্যাপী প্রতিবছর শ্রম দিবসে পালনের সিদ্বান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর ১লা মে বিশ^ব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়ে আসছে এবং সেদিন রাষ্ট্রীয় ছুটি পালিত হয়। শ্রমিকদের সেই জীবনদানের বদৌলতেই আজ প্রবর্তিত হয়েছে শ্রম আইন, শ্রম আদালত। চালু হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের আন্দোলন করার অধিকার।  
কিন্তু  প্রতি বছর শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মে দিবস পালিত হলেও, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় শ্রম আইন এবং শ্রম আদালত চালু হলেও এখনো সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই তো এখনো শ্রমিকরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে। সময়মতো বেতন-বোনাসের দাবিতে এখনো শ্রমিকরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে আন্দোলন করে। কথায় কথায় সামান্য অপরাধে চাকরি হারানোর ভয়ে এখনো শ্রমিকরা ভয়ে তটস্থ থাকে। আট ঘণ্টার অতিরিক্ত কাজের মূল্য আদায়ের জন্য এখনো শ্রমিকদের আবেদন করতে হয়। শ্রমিকদের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলেই তো রানা প্লাজা ধ্বংসের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দুর্ঘটনায় হতাহত সব শ্রমিক এখনো তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পায়নি। একইভাবে তাজরীন গার্মেন্টে অগ্নিকা-ে নিহত শ্রমিকের উত্তরাধিকারীরা এখনো যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায়নি। অধিকাংশ কলকারখানায় সুনির্দিষ্ট কোনো চাকরির বিধিমালা নেই। অসুস্থ এবং বিপদকালীন সময়ে সুযোগ-সুবিধার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমনকি অবসর ভাতাও নেই। শ্রমিকদের জন্য কোনো বীমা পলিসি নেই। অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো গ্যারান্টি নেই। কাজ করতে গিয়ে অঙ্গহানি হলে অথবা দুর্ঘটনায় মারা গেলে সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যতক্ষণ কাজ ততক্ষণ বেতন চলে। যতক্ষণ সুস্থ থাকে, ততক্ষণ চাকরি চলে। শরীরের সুস্থতা নেই, চাকরিও আর নেই। অসুস্থ হয়ে পড়লে, অথবা কর্মক্ষমতা হারিয়ে একজন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়লে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিকই শ্রমিককে কোনো বেনিফিট প্রদান করেন না। এ সময় শ্রমিকটির জীবন কীভাবে অতিবাহিত হবে, তার পরিবার-পরিজন কীভাবে চলবে তার কোনো চিন্তা মালিকের থাকে না। অথচ একজন শ্রমিক বা তার পরিবারের ভরণ-পোষণ বহন করা একটি  কোম্পানির জন্য কোনো অসম্ভব বিষয় নয়। অধিকাংশ  ক্ষেত্রেই কোম্পানির মুনাফা থেকে শ্রমিকদেরকে কোনো অংশ প্রদান করা হয় না। শিল্প-কারখানায় শুধু নয়, সর্বত্রই শ্রমিকরা আজ বঞ্চিত। বাসায় কাজ করার জন্য নিয়োজিত ছোট্ট এতিম মেয়েটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে  বঞ্চনা, অবহেলা এবং নির্যাতনের শিকার। তার প্রতিও আমরা একটু ভালো ব্যবহার করি না, বরং সামান্য দোষেই নির্যাতন করি।
মালিক এবং শ্রমিকের মাঝে সুন্দর, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক ভালোবাসায় পূর্ণ একটি সম্পর্ক প্রত্যাশিত হলেও এখনো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সুসম্পর্ক  প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মালিক এবং শ্রমিকের মাঝে প্রায় সময়  দ্বন্দ্ব চলে, যা মাঝে মাঝে সংঘাতে রূপ নেয়। আর এতে মালিক, শ্রমিক এবং প্রতিষ্ঠান সবারই ক্ষতি। তার প্রকৃত কারণ হচ্ছেÑ আমরা সব সময় অধিকার আদায়ের কথা বলি, কিন্তু কাউকে অধিকার প্রদানের কথা বলি না। মনে রাখতে হবে- কাউকে বঞ্চিত করে, অবজ্ঞা করে এবং অসম্মানিত করে কখনো তার কাছ থেকে ভালো কিছু  আদায় করা যায় না। মনের মাঝে স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে কখনো ভালো কিছু করা যায় না। শাসন করার জন্য আইন লাগে, শাস্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু শুধুমাত্র শাসন করে এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের কাছে ভালো কাজ আশা করা যায় না। স্বৈরশাসন করে যেমন জনগণের ভালোবাসা পাওয়া যায় না এবং দেশকে উন্নত করা যায় না, ঠিক তেমনি শাস্তির ভয়ে তটস্থ রেখে শ্রমিকদের কাছ থেকে ভালো কাজ পাওয়া যায় না এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নতি করা যায় না। শ্রমিকদের কাছ থেকে ভালো আউটপুট পেতে হলে তাদেরকে ভালোবাসতে হবে। তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করতে হবে এবং তাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করবে। শ্রমিকরা যখন মনে করবে, প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতেই তাদের উন্নতি, প্রতিষ্ঠানের সাফল্যেই তাদের সাফল্য, তখন শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য মন উজাড় করে কাজ করবে। আর তখনই একটি প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চলে এবং প্রতিষ্ঠান সবসময় উন্নতির পথে এগিয়ে চলে। তবে মালিকের বাস্তব অবস্থাও শ্রমিকদের বুঝতে হবে।
তাই সব মালিক পক্ষের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানিয়ে বলছি, আপনারা অনুগ্রহ করে আপনার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করুন। তাদেরকে ভালোবাসুন, সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকুন, তাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হোন। এই সমাজে জীবন নির্বাহের জন্য ন্যূনতম বেতন প্রদান করুন। কোম্পানির মুনাফা থেকে তাদেরকে ইনসেনটিভ প্রদান করুন। তাহলে শ্রমিকরা একটু ভালো পরিবেশে বসবাস করতে পারবে, একটু উন্নত জীবনযাপন করতে পারবে এবং তারা সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবে। আর এভাবেই কিন্তু মানুষের জীবন উন্নত হয়, যার ফলে উন্নত হয় সমাজ এবং রাষ্ট্র। অনুগ্রহ করে তাদেরকে ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে বড় হওয়ার চিন্তা করবেন না। তাদেরকে শোষণ করে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবেন না এবং সম্পত্তি বৃদ্ধি করবেন না। কাউকে বঞ্চিত করে সেই টাকায় বিলাসী জীবনের প্রয়োজন নেই। কারণ এভাবে বড় হওয়া যায় না। ইসলাম বলেছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করুন। আপনারা এই নীতি অনুসরণ করুন এবং যথাসময়ে শ্রমিকদেরকে বেতন, বোনাস এবং ওভারটাইমসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করুন। দুর্ভাগ্য, বিশ^জুড়েই আজ শোষণের মহোৎসব চলছে। তাই তো পৃথিবীর অর্ধেক সম্পত্তির মালিক মাত্র ৬২ জন লোক। অর্থাৎ মাত্র ৬২ জন লোকের হাতেই পৃথিবীর মোট সম্পদের অর্ধেক কুক্ষিগত হয়ে আছে। তাই বিশ^জুড়ে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছে। দিন দিন বাড়ছে গরিবের সংখ্যা। তাই বাড়ছে পুষ্টিহীনতা, অশিক্ষা এবং নি¤œমানের জীবন। একইভাবে সব গৃহকর্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলছি, আপনার বাসার কাজের লোকটির প্রতি একটু সদয় হোন। আপনার একই বয়সের সন্তানটির জীবন কত সুখের তার সাথে একটু মিলিয়ে ভেবে দেখুন। সে কিন্তু পিতামাতা, ভাইবোন সবাইকে ছেড়ে আপনার বাসায় চাকরি করে। সুতরাং তার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করুন। তাকে একটু লেখাপড়া শিখান। তার জীবনটাকে উন্নত করার একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। আসুন, আমরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে অন্যকে তার অধিকার প্রদান করি। তাহলেই মে দিবসের সার্থকতা নিশ্চিত হবে।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন