রাজু আহমেদ
প্রিয় স্বদেশ আজ অঘোষিতভাবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে এমন একটি দিনের সূর্য্য অস্ত যায় না, যেদিন ডজনখানেক মানুষ খুন না হয়। তারপরেও শুনতে হয়, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। স্বাভাবিকতা ও অস্বাভাবিকতা নির্ধারণের পূর্বঘোষিত মানদ- না থাকায় বোধহয় যে কোনো পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বললে সেটাই মানুষকে মেনে নিতে হবে। সরকার দেশের পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক দাবি করলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের গত চার মাসে ১৫০০ মানুষ খুন হয়েছে। যত্রতত্র লাশ মিললেও এদেশের মানুষ নিরাপদে রয়েছে! মানুষ হত্যার মতো একটি ভয়াবহ অপরাধ এখন সাধারণ অপরাধে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসী, উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের পহেলা মে তারিখের সংখ্যা দ্যা অবজার্ভারে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও ভয়ানক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের মতে, ঢাকার রাজপথে এক ধরনের ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। কেউ যেন আর নিরাপদে নেই। সর্বত্র বিরাজ করছে শীতল উদ্বেগ। গার্ডিয়ানের তথ্য মতে, গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে একে একে ১৬ জন মুক্তমনা ছাত্র, শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মী, কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা এবং ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছয় জন ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক, এক ইতালীয় ধর্মযাজক, দুই বিদেশি নাগরিক এবং একজন সমকামী। বাংলাদেশে পরিস্থিতিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও হউরোপীয় হউনিয়ন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোন, জুলাহাজ মান্নান খুন হওয়ার পর সিনেট ও হোয়াইট হাউস থেকে বিবৃতি, বার্নিকাটের উদ্বেগ এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের বাংলাদেশে আগমন প্রমাণ করে তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। ব্লগার অভিজিৎ হত্যাকা-ের পর এফবিআই সদস্যদের তদন্তে আসা এবং জুলহাজ খুন হওয়ার পর খুনীদের শনাক্তকরণে আমেরিকার সাহায্যের প্রস্তাব দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনিশ্চয়তারই প্রমাণ দেয়।
গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেছিল, বাংলাদেশে আইএস উত্থানের তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়া নির্ভরযোগ্য সূত্রে দাবি করেছিল, বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলার বিষয়টি। যে কারণে তারা তাদের ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং দু’বারে তারা বাংলাদেশে অবস্থানরত অস্ট্রেলিয় নাগরিকদের চলাচলের ওপর সতর্কতা জারি করে। এত কিছুর পরেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ আন্তঃদেশীয় কোনো জঙ্গির উপস্থিতি নেই, বরং যারা দেশের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল করছে তারা দেশীয় জঙ্গি এবং তাদের মদদ দিচ্ছে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। উল্লেখ্য যে, প্রতিটি খুনের ঘটনার পর তার দায় স্বীকার করে আইএস কিংবা আল কায়েদার ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট শাখা বিবৃতি দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে চাকরি করতেন এমন ১৩ জন বাংলাদেশীকে গত কয়েকদিনে উগ্রপন্থী কার্যকলাপের অভিযোগে ঢাকা ও সিঙ্গাপুর থেকে আটক করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তারা এপ্রিল মাসে আট জন ‘উগ্রপন্থায় দীক্ষিত হওয়া’ বাংলাদেশি নাগরিককে আটক করেছে। তারা ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ (আইএসবি) নামের একটি গোপন গোষ্ঠীর সদস্য। গত ২৯ এপ্রিল সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ যে পাঁচ জনকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল, তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- তারা আইএসবির সাথে সংশ্লিষ্ট না হলেও তাদের কাছে জিহাদি বইপত্র ছিল। যে পাঁচজনকে দেশে পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে ৩ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন, তারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে একটি উগ্রপন্থী সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিগত দিনে যে সকল আলোচিত হত্যাকা- ঘটেছে সেই ৩৭টি হত্যাকা-ের মধ্যে ৩৪টির সুরাহা পুলিশ করতে পেরেছে বলে পুলিশ প্রধান দাবি করেছেন। অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে ভিন্ন কথা। ব্লগার হত্যার বিষয়ে শুধু রাজিব হায়দার ছাড়া আর কোনটিরই রায় হয়নি। আলোচিত হত্যাকা-ের মাত্র ৬টির চার্জশিট পুলিশ দাখিল করতে পেরেছে। অভিজিত রয়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা দাবি করেছেন, অভিজিত রয় হত্যাকা-ের ব্যাপারে পুলিশ যাদেরকে গ্রেফতার করেছে তারা প্রকৃত হত্যাকারী নয়, বরং প্রকৃত হত্যাকারীরা রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী আশামনি দাবি করেছেন, তার সামনেই তার স্বামীকে খুন করা হয়েছে অথচ ঘটনার পর ৫ মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ তার সাথে যোগাযোগ করেনি।
বাংলাদেশে জঙ্গি আছে কি নেই সে বিষয়ে সরকারের বক্তৃতা স্ববিরোধীতায় পূর্ণ। এক সময় তারা দাবি করেছিল এ দেশে জঙ্গি রয়েছে এবং এ নিয়ে বিদেশি পত্র পত্রিকায় নিবন্ধও লিখিত হয়েছিল। কেউ কেউ মাদরাসাকে জঙ্গি উত্থানের আস্তানা উল্লেখ করে মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার দাবি তুলেছিলেন। অবশ্য সরকার তাদের পূর্ব বক্তৃতা থেকে সরে এসে এখন দাবি করছে, দেশে কোনো আন্তঃদেশীয় জঙ্গির অস্তিত্ব নেই, যারা আছে তারা সবাউ ‘হোম গ্রোউন’। বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সরকারের ভাবমর্যাদা অনুজ্জ¦ল করতে বিএনপি-জামায়াত এসব হত্যাকা- ঘটাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে যে সকল সন্দেহভাজন উগ্রপন্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজে দেখা যাচ্ছে তারা উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবারের সন্তান। যাদের সাথে মাদরাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্টতার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। সরকার দেশ ও জনগণকে উন্নয়নের স্বপ্নে বিভোর রাখলেও দেশে হত্যা ও মানুষের নিরাপত্তার যে চরম সঙ্কট চলছে তা থেকে সরকার উত্তরণ খুঁজে পাচ্ছে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি ঘোলাটে হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অপরাধীরা পুলিশের চেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক। যদি পুলিশের এ দাবি সত্য হয়, তবে নিঃসন্দেহে দেশীয় অপরাধীদের সাথে বিদেশি অপরাধীদের যোগাযোগ রয়েছে। কেননা দেশে এমন কোনো ম্যাজিক নেই যার দ্বারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়ে অপরাধীরা বেশি প্রশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাবে। বিভিন্ন হত্যাকা-ের পর সাধারণ মানুষকে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দায়সারা কথা শুনতে হচ্ছে। এটা খুব হতাশার। সাধারণ মানুষকেই যদি তাদের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তার রক্ষক হতে হয় তবে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্রের বিশাল আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী লালন করা হবে কোন স্বার্থে?
দেশে যে দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে তাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। যে কোনো মূল্যে সাধারণ মানুষ এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চায়। চায় নিরাপদে বাঁচতে, বুক উঁচিয়ে চলতে। প্রকাশক দীপনের বাবা ঢাবি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, সবার শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দেশের শান্তিকামী মানুষদের সবাই চায়, অপরাধীদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি ভুলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবোধ জাগ্রত না হলে সাধারণ মানুষকে কেবল বেঘোড়ে জীবন দিতে হবে। দেশে বর্তমানে যে সঙ্কট চলছে তার সিংহভাগের সমাধান হতে পারে একটি গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের দ্বারা। যে নির্বাচনে সাধারণ মানুষ তাদের পছন্দসই প্রার্র্থীকে বাছাই করার সুযোগ পাবে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্বের সুযোগ নিয়ে দেশে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসীদের উত্থানের সুযোগ ঘটছে এবং এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়িতে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ তাদের স্পর্শ করতে পারছে না বটে কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই তাদের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস করা উচিত। যুক্তরাষ্ট্র চোখ রাঙাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্ক রাখা না রাখার হুমকি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে। রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি জনকল্যাণ সাধন হয়Ñতবে দেশের চরম সঙ্কটে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য খুব বেশি প্রয়োজন। শুধু ভারত নির্ভর হয়ে বিশ্বের অন্যান্য পরাশক্তি, দাতা সংস্থার বিরাগভাজন হওয়া বাংলাদেশের জন্য শুভ হবে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্তি পেতে হবে। প্রতিটি অপরাধের সাথে জড়িতরা যদি কঠোর শাস্তি পেত তবে ভবিষ্যতে কেউ অপরাধ করতে সাহস পেত না। কিন্তু বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে কারণে অপরাধীরা নির্ভাবনায় অপরাধ কর্ম সম্পাদন করে সটকে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রের পরতে পরতে অপরাধীদের এমনভাবে শিকড় স্থাপনের সুযোগ দিয়েছে, যার কারণে শঙ্কা হচ্ছে দেশের কখন যেন ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যায়।
যে কোনো মূল্যে জনগণের কল্যাণকামী আদর্শরাষ্ট্র হিসেবে স্বদেশের প্রতিষ্ঠা দেখতে চাই। মানুষের বাকস্বাধীনতা, জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণ তথা গণমানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলনের সুযোগ রাষ্ট্রকেই তার কল্যাণের জন্য নিজ উদ্যোগে গ্রহণ করতে হবে। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কোনো আশঙ্কা যাতে সৃষ্টি না হয় তার জন্য রাষ্ট্রকে হতে হবে কঠোর। কোনো পক্ষের উগ্রতার প্রসার ঘটানোর সুযোগ রাষ্ট্রে দেওয়া উচিত নয়। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিরাপরাধ নাগরিককে হয়রানির নৈতিক অধিকার রাষ্ট্রের নেই। বিচারহীনভাবে যে কোনো ধরনের খুন গুরুতর অপরাধ। ধর্ম একটাকে সমর্থন করে না, সমর্থন করে না নৈতিকতাও। অপরাধী যত মারাত্মক অপরাধ করুক না কেন তার ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান বিচারে এদেশের গোটা জনসমষ্টির প্রায় ৯২ ভাগ মুসলমান। কাজেই ইসলাম ধর্মসহ অন্যকে নো ধর্মের অবমননা, কটূক্তির সামান্যতম সুযোগ কাউকে দেয়া রাষ্ট্রের উচিত হবে না। বিকৃত রুচি চর্চার অধিকারও যেন কেউ না পায় সে জন্য রাষ্ট্রকে সচেতনতা দেখাতে হবে। মানুষের আবেগকে আহত করে কেউ কিছু করতে চাইলে এবং রাষ্ট্র উদার হয়ে তাকে সে ক্ষমতা দিলে বহু অপরাধের জন্ম দেবে। ডেকে আনবে চরম অস্থিরতা। রাষ্ট্রকে থাকতে হবে যৌক্তিক ভূমিকায়। মানুষকে করতে হবে সচেতন এবং গড়ে তুলতে হবে সম্প্রীতির সমাজ। যেখানে থাকবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা এবং বিশ্বাস। এখানে কথিত মুক্তমতকে যেমন প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না তেমনি উগ্রবাদকেও দমন করতে হবে কঠোর ও কৌশলী হয়ে। আমাদের প্রিয় দেশকে নিয়ে অন্য কেউ কটূক্তি করবে আর সেটা আমরা করার সুযোগ দেব, এটা মোটেও দেশপ্রেমের লক্ষণ নয়।
য় লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন