শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

ড. এম এ মাননান | প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

এখনও ভুলিনি আমরা সে দিনের কথা, যে দিন বঙ্গবন্ধু তুমি তোমার দু’পা রেখেছিলে বাংলার বুকে একটি স্বাধীন দেশের জনক হিসেবে। তুমিই তো ছিলে সাত কোটি বাঙালির প্রাণ, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত জননেতা, স্বাধীনতার ঘোষক আর বাংলাদেশের স্থপতি। তোমার অপরাধ ছিল অসহনীয় শাসকদের চোখে। কারণ তুমি চেয়েছিলে বাংলার মানুষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের হাত থেকে মুক্ত হোক, স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালিরা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। এ অপরাধে তারা তোমাকে জেলে পুরলো। বিভিন্ন সময়ে তুমি প্রায় আঠারটি বছর জেলে কাটালে, নিজের জীবন-যৌবন দেশ মাতৃকার সেবায় উৎসর্গ করলে। তারপরও পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার থামেনি। তারা তোমাকে একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে নিয়ে গেলো পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে। তোমার অপরাধ ছিল তুমি বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা চেয়েছিলে। জেলের কুঠরির সামনে তোমার চোখের সম্মুখেই তারা তোমার জন্য কবর খুঁড়ে রাখলো তোমাকে হত্যা করে মাটিচাপা দেবে বলে। অকুতোভয় তুমি, একটুও ঘাবড়ালে না। নয় মাসের বেশি কারাবন্দি থাকার পর তারা তোমাকে আন্তর্জাতিক চাপে ছেড়ে দিলো। আর বিবিসি’র কল্যাণে বাহাত্তরের ৮ জানুয়ারি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের দিশেহারা মানুষগুলো যখন জানলো তাদের মহানায়ক বেঁচে আছেন এবং তিনি দেশে শীঘ্রই ফিরবেন, তারা যে তখন কীরূপ আবেগাপ্লুত হয়েছিল তা বোঝানো যাবে না কাউকে। অখন্ড পাকিস্তানের বিলুপ্তি ঘটিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামক শব্দটির কবর রচনা করে পাকিস্তান থেকে লন্ডন এবং সেখান থেকে দিল্লি হয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল মধ্যাহ্নে একটি ব্রিটিশ বিমানে করে এসে ঢাকার আকাশে কয়েক বার চক্কর দিয়ে (যা রেসকোর্স ময়দানের সভাস্থল থেকে দেখেছি) তেজগাঁও কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে ১০ জানুয়ারি। বিমান বন্দর চত্বরে সমবেত লাখো মানুষ অবাক নয়নে দেখলো তাদের সামনে বিমান থেকে নামছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হিমালয়ের মতো উঁচু যার সম্মান।
তুমি নামলে, জনতার প্রতি অশ্রæসজল নয়নে তাকালে, লালনীলে মাখামাখি একটা খোলা ট্রাকে দাঁড়ালে, রাস্তার দু’পাশে দাঁড়ানো হর্ষোৎফুল্ল জনতার প্রতি হাত নেড়ে নেড়ে শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে পড়ন্ত বিকেলে পৌঁছলে রেসকোর্স ময়দানের নৌকাসদৃশ মঞ্চে, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে একাত্তরের সাতই মার্চ দিয়েছিলে যুগান্তকারী অলিখিত ভাষণ যা শুধু শাসকদের গাত্রদাহই সৃষ্টি করে নি, বিশ্বের বোদ্ধা ব্যক্তিদের নজরও কেড়েছিলো। তুমি কী জানো পিতা, তোমার সে ভাষণটি ২০১৭ সালে বিশ্ব-ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে? একই মঞ্চে দাঁড়িয়েই তুমি আবার ২৯০ দিন পর লাখো লাখো সমাগতদের উদ্দেশে জাতির পুনর্গঠনের জন্য দিকনির্দেশনা দিলে। দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসার সময় পালাম বিমান বন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দাঁড়িয়ে তুমি তোমার ভাষণে যে কাব্যিক নান্দনিকতা দেখিয়েছো তা আজো আমরা ভুলিনি। তুমি সেদিন বলেছিলে: ‘আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই সান্ত¦নায় যে অবশেষে অসত্যের ওপর সত্যের, উন্মাদনার ওপর প্রকৃতিস্থতার, কাপুরুষতার ওপর শৌর্যের, অবিচারের ওপর ন্যায়বিচারের, অমঙ্গলের ওপর মঙ্গলের হয়েছে জয়।’
তুমি এলে বীরের বেশে, উঠলে রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের) মঞ্চে, ভেজা কণ্ঠে অভিবাদন জানালে সবাইকে। নিশ্চয়ই মনে আছে পিতা, সে মঞ্চের উপর ঋজু ভঙিতে দাঁড়িয়ে অশ্রæবিগলিত কণ্ঠে অনেক কথার মাঝে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা ব্যাখ্যা করলে আর সবাইকে নবসৃষ্ট বাংলাদেশের পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করতে বললে। সবাইকে জানালে দেশের ভবিষ্যত রূপরেখার স্বরূপ যা ছিল প্রেরণাদায়ী আর আগামীর ইঙ্গিতবাহী। কী চমৎকার ছিল তোমার সে ভাষণ, একাত্তরের সাত মার্চের অবিস্মরণীয় ১৯ মিনিটের অলিখিত কবিত্বময় ভাষণের পর এতো সুন্দর ভাষণ আমরা শুনিনি আর কোনো দিন। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত ছিলে তুমি, তবুও সে-ই দৃঢ় কণ্ঠ, আগের বজ্রকণ্ঠ আগের মতই তেজোদীপ্ত, ভাষণে তোমার প্রস্ফূটিত রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টি। সদ্য স্বাধীন দেশের ভবিষ্যত নিয়ে তোমার সংক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানের সাথে সাথে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলো সারা রেসকোর্স ময়দানে। সে-ই থেকে শুরু হলো মুক্ত মানুষের নব জীবনের যাত্রা, তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশের পথ চলা।
ভাষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না তোমার কর্মকান্ড। পরবর্তী প্রায় তিন বছর দৃঢ়তার সাথে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করতে করতে সাত কোটি বুভুক্ষু মানুষের জন্য আহারের ব্যবস্থা করলে, ভেঙ্গে পড়া প্রশাসনিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করালে, বিধ্বস্ত রাস্তা-ঘাট পুল-কালভার্ট তৈরির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিয়ে প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিলে, হুমড়িখেয়ে পড়া ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা করলে। এতো কিছুর মধ্যেও বৈদেশিক কূটনীতি অব্যাহত রেখে সারা বিশ্বের স্বীকৃতি আদায় করলে। তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ভূখন্ডে অবস্থানরত ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত পাঠানো, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য নিয়ে চট্টগ্রাম আর মংলা বন্দরের মাইন অপসারণ করে বন্দরকে ব্যবহারযোগ্য করা, এক কোটি ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাসহ প্রথম সংবিধান উপহার দেওয়ার মতো অকল্পনীয় অনেকগুলো কাজ করলে চমৎকার নেতৃত্ব দিয়ে। ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, সকল প্রাথমিক শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়া, ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে/নামমাত্র মূল্যে কৃষি-উপকরণ বিতরণ, ৫৮০টি শিল্প-কারখানাসহ পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সকল সম্পদ জাতীয়করণ, হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মসংস্থান, মাদরাসা বোর্ডের পুনর্গঠনসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন এবং জুয়া, রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও মদ্যপানসহ অনেক প্রকার সমাজবিরোধী কার্যকলাপ দক্ষতার সাথে বন্ধকরার মতো দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞ সম্পাদন একমাত্র তোমার আগমনের পর তোমার প্রজ্ঞাসমৃদ্ধ নেতৃত্বের কারণেই হয়েছে। সর্বোপরি, বিশাল হৃদয়ের অধিকারী তুমি স্বাধীনতা-বিরোধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে জনগণের রোষ থেকে তাদের বাঁচালে। আমরা তোমার অনুসারীরা কেউ ভুলিনি, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মূলত কিছুই ছিল না- একটা বড় শূন্য দিয়ে নতুন দেশটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ছিল না কোনো সংগঠিত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, এমনকি বেসামরিক প্রশাসন চালানোর মতো উপযুক্ত অবকাঠামো। না ছিল সুসংগঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক, নিজস্ব মুদ্রা। বরং ছিলো ক্ষুধার্ত সাত কোটি মানুষের খালি পেট আর সারা দেশ জুড়ে সম্পদহারা সর্বস্বান্ত মানুষের হাহাকার। আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের দেশগুলো ছিল এন্টি-বাংলাদেশ; আসছিল না তেমন কোনো বৈদেশিক সাহায্য। বিশ্বব্যাংক আর কিছু পূর্ব ইউরোপীয় দেশ যদি সাহায্য না করতো, তাহলে কী যে অবস্থা হতো তা কল্পনা করতেও শিউরে উঠতে হয়। এরূপ একটি ভঙ্গুর অবস্থায় দেশে ফিরে ন্যূব্জদেহবিশিষ্ট দেশটির হাল ধরে আমাদের বাঁচালে তুমি হে মহান অধিনায়ক। আরও অনেক কিছু বাকী ছিল করার। কিন্তু স্বাধীনতা-বিরোধী বিশ্বাসঘাতকেরা তোমাকে সে সময় দেয়নি। স্বপ্নের দেশটিকে সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত করার অভিলাষ পূরণ করার সময় পাওনি বলে তোমার অতৃপ্ত আত্মা নিশ্চয়ই গুমরে গুমরে কাঁদছে। দেখে যাও পিতা, যা তুমি করে যেতে পারনি তা তোমার আদরের হাসু করে দেখিয়েছে। হাসু তোমার সে খুকিটি নেই, যাকে তার ছোট্ট বোনটিসহ রেখে চলে গেলে হায়েনাদের বুলেট বুকে নিয়ে। তোমার হাসু এখন বিশ্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, উন্নয়নের রূপকার, বাংলার মানুষের হৃদয়ের মণি, নিপীড়িত মানুষের স্বপ্ন¯্রষ্টা। তোমার দেখে যাওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত, এক আশা-ভরসাহীন দেশ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার যোগ্য কন্যার হাতের পরশে, দেখে যাও একবার এসে। জানো কী তুমি তোমার কন্যা কী করেছে? তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত করেছে, মাথাপিছু আয় ১৭৫১ ডলারে বৃদ্ধি করেছে, ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি করে অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের পাঁচটি দেশের একটিতে রূপান্তরিত করেছে, দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশে এনে ঠেকিয়েছে। তাঁর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বে মাত্র দশ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তোমার স্বপ্নের সোনার বাংলা। তুমি কী কখনো কল্পনা করেছো টুঙ্গিপাড়ার বাইগার নদীর তীরে হাওয়ায় ভেসে ছুটতে ছুটতে সফেদ ঢেউ গুনতে গুনতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়া তোমার ছোট্ট হাসু তোমারই অসমাপ্ত রাজনীতির উত্তরাধিকার বহন করে একদিন মহাকাশে স্যাটেলাইট ছেড়ে ছোট্ট দেশটির পতাকাকে মহাকাশে উড্ডীন করে বিশ্বকে চমকে দেবে? দেখো তাকিয়ে, নিন্দুকদের চেহারায় ধূলোর ঝাপটা দিয়ে তোমার কন্যা দৃশ্যমান করেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্বপ্নের পদ্মাসেতু। সবচেয়ে বড় কথা, তোমার কন্যা মানুষকে নিত্য আকালের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন, আর প্রমাণ করেছেন যে নেতৃত্বের ভিশন, সবলতা আর স্বচ্ছতা থাকলে অবশ্যই উন্নয়নের দিশা পাওয়া যায়। জানো কী, ইতোমধ্যে সমুদ্রও জয় করে ফেলেছেন তোমার কন্যা, বাড়িয়েছেন বাংলাদেশের সীমানা । নি¤œমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের পর এখন তোমার হাসু আগামী তিন বছরে মধ্যে ছোট্ট দেশটাকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন দেখছেন এবং সেমতে উদ্যোগও নিয়েছেন। হয়তো অবাক হবে শুনে যে, তোমার মেয়ের নেতৃত্বে দেশ এখন একশত বছর পরে কী হতে চায় তার স্বপ্ন দেখছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও উপাচার্য, বাংলাদেশ উ›মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন