মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সাহিত্য

বৃষ্টিতে ভেজা শরীর

কা জী ই য়া স মী ন | প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

পঁচিশ বছর ধরে কোনো দেখা নেই, কথা নেই, খোঁজ নেই। অথচ দুজনই দুজনকে মনে রেখেছে। কারণ, ভুলে যাওয়া কঠিন। 

কিন্তু কঠিন সব কিছু সহজ হয়ে গেছে আজকাল ফেসবুকের কাছে। তাই প্রজ্ঞার কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় প্রজন্ম। প্রজ্ঞাও র্নিদ্বিধায় এ্যাকসেপ্ট করে প্রজন্মকে। প্রথম দিন ম্যাসেনজারে অনেক সময় নিয়ে কথা হয় ওদের। প্রজ্ঞা একটু বেশি আবেগ তাড়িত হয়। দ্বিতীয় বার ফোন করে আমন্ত্রণ জানায় প্রজন্ম। পঁচিশ বছর পর দেখা করার আকুতি স্বাভাবিক অর্থেই সমিচীন।
প্রজন্মের রাতে ঘুম নেই, দেখা হবে বলে রাত শেষে ভোর হলো। দিনের শুরুতে মর্নিং ওয়ার্ক। ঘরে ফিরে দেখতে হয় প্রতিদিন একই দৃশ্য। আটটার মধ্যে বউ চলে যায় অফিসে প্রজন্মের বউ ঘড়ির কাঁটার মতো ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। ওদের ছোট মেয়ে আদৃতা ওর মার সাথে বের হয়। মা কলেজের গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় নিজস্ব ব্যস্ততা প্রতিষ্ঠানে।
প্রজন্মের বড় মেয়ে নিবেদিতা বাবার আদরের খুব। ইউনিভারসিটির ক্লাশ ধরতে বাবার সাথে বের হয় ঘরের সার্বিক তত্ত¡াবধানে রয়েছে দুজন কাজের মানুষ। আদৃতা নিবেদিতার ছুটির সময়ও একই নিয়মে ওরা বাবা মাকে সঙ্গী করে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই প্রতিদিন ছক বাধা কাজের ব্যস্ততা। তার উপর নিবেদিতার হর্ন বাজতেই থাকে। বাপি, জলদি করো। দাড়ি সেফ করার দরকার নেই। ক্লাশ শুরুর আগে আমাকে পৌঁছাতে হবে।
আজকে মেয়ের কথা একেবারে কানেই তুলছেনা। আস্তে ধীরে মনোযোগ দিয়ে দাড়ি সেফ করছে। পছন্দের প্যান্ট শার্ট পরা হলো। সাথে ব্রেজার। আজ নতুন একটা পারফিউম ব্যবহার করার ইচ্ছে হচ্ছে। বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে মন ভরছেনা যেন। নিবেদিতা রেডি হয়ে বসে বসে বাবার নখরামি গুলো দেখছে।
প্রজন্ম মেয়েকে না দেখার ভানকরে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে জিজ্ঞেস করলে কি বলবে তাই জপ ছিলো মনে মনে। বাঁচা গেলো শেষাবধি মেয়ে কোনো প্রশ্ন না করে গাড়ীতে উঠে বসলো।
গাড়ী স্টার্ট হওয়ার পর লুকিং গøাসে বাবার ভাবসাব দেখে নিবেদিতা তখন আর মুখ বন্ধ করে রাখতে পারলোনা। বাপি, তোমার মনটা ভালো আছেতো? মেয়ের কথায় জড়সরো হয়ে প্রজন্ম মিউ মিউ গলায় বলে, খারাপ থাকবে কেনরে। আজকে আমি একটু অন্যরকম মুডে আছি।
হ্যা, তাতো ভালো ভাবে বুঝা যাচ্ছে বাপি। এজন্যেইতো জানতে ইচ্ছে করছে, ব্যাপারটা কী? কোনো সুন্দরীর ইন্টারভিউ আছে তোমার অফিসে?
ড্রাইভারকে ইশারায় দেখিয়ে মেয়েকে বলে, নিবেদিতা আমি তোর বাবা। কাজেই মুখ সামলে কথা বললে ভালো হয়।
বন্ধুর মতো মেয়ে নিবেদিতা এবার বাবার হাতে চিমটি দিয়ে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, তাহলে সত্যিটা বলো? প্রজন্ম মেয়ের কানের কাছে গিয়ে বলে। পঁচিশ বছর পর আজকে আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হবে, বুঝলি। উনি নিশ্চয়ই ফিমেল? তোমার বান্ধবী? বাপি, প্রেম ট্রেম ছিলো না তো?
প্রজন্ম চোখ বড় করে ধমক দেয়ার চেষ্টা করে, আবারো অবজ্যাকশনাল কথা!
মিটি মিটি হাসে নিবেদিতা। মা কি জানে? বলেছো মাকে?
নাহ-প্রজন্ম বলে।
নিবেদিতা অবাক হয়। বাবার প্রতিক্রিয়া দেখে। তারপর অভিভাবকের মতো বাবাকে বুঝিয়ে বলা শুরু করে, দেখো সাবধান থেকো বাপি। আজকাল মহিলা পুরুষেরা বেশি বয়সে পরকীয়াতে জড়াচ্ছে। ফেসবুকে ছোট বড় সবার মাথা নষ্ট করার ওস্তাদ কিন্তু বাপি।
প্রজন্ম বলে তুই কি বলতে চাচ্ছিস পরিষ্কার করে বল। নিবেদিতা গলা নরম করে বাবার কানে কানে বলে বাপি, গাড়ীতে বসে বলা সম্ভব না। ঘরে গিয়ে বলবো। তুমি শুধু মার কথা মনে রেখে ওই মহিলার সাথে দেখা করবে। বুঝছো বাপি?
প্রজন্ম মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। হাসে।
কি বাপি ভয় লাগছে না!
চুপ করলি স্টুপিড মেয়ে।
নিবেদিতা নর্থসাউথের গেটে নেমে বাবাকে বলে, বাপি, এই বয়সে প্রেমিকার সাথে ডেটিং করা লজ্জার কথা। আচ্ছা বলো তুমি কি মাকে অনুমতি দিতে, মা যদি সেজেগুজে পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতো?
নিবেদিতাকে চড়মেরে গাল দুটো লাল করে দিতে ইচ্ছে করছে প্রজন্মের। চুপ করোতো। বেশি কথা বলোনা! নিবেদিতা চুপ করে চলে যায়। মাঝ রাস্তায় জ্যামে আটকে বসে আছে প্রজন্ম। কখনও মেয়ের কথাগুলো মনে পড়ছে। কখনও প্রজ্ঞাকে নিয়ে পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে।
পুরুষ মানুষের জীবনটা যেমন মহিলা কেন্দ্রিক মেয়েদের জীবনটা ততটা পুরুষ কেন্দ্রিক না। জন্মের পর একটা ছেলে দাড়ি মোছ গজানোর আগ পর্যন্ত মা মা করে। পুরোপুরি যুবক বয়সে মেয়েদের স্বপ্নে বিভোর। বিয়ের পর আবার সেই ছেলেটি বউ ছাড়া অন্য কিছু বোঝার চেষ্টাই করে না। এক্ষেত্রে মেয়েরা সব কিছুতে ভারসাম্য বজায় রাখে। এজন্যে মেয়েরাই ভালো বলে মনে হয় প্রজন্মের কাছে।
চলন্ত গাড়ীতে নিবেদিতার ফোন বাজে। প্রজন্ম সুইচ অন করে।
বাপি, গিয়ে পৌঁছেছো?
দশ পনেরো মিনিটে পৌঁছে যাবো? কেন? একটা কথা বলি বাপি, তাকে আসতে না করে দাও। চিন্তা করিসনা তুই। মনোযোগ দিয়ে ক্লাশ কর। কিছু হবে না। উনি অন্যরকম। তুই যেমন ভাবছিস, সেরকমনা। তবুও বাপি, বলা যায় না।
মোবাইল অফ করে প্রজন্ম গাড়ীতে বসেই আকাশ দেখছে। মেঘাচ্ছন্ন। প্রজ্ঞার প্রাইভেট করে থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। আসবেই। এখন বয়স হয়েয়ে। প্রজ্ঞা আগের মতো নেই কথা দিয়ে কথা রাখবে। বয়স হয়েছে না! আহারে, কি দিন ছিলো সেই দিন গুলো। বেকার দিনের প্রেমের কোন মূল্য ছিলো না। না প্রেমিকার কাছে না নিজের কাছে। চিনা বাদাম, চটপটি, মুড়ি মসলা, সিংগারা চা খাওয়া। যেখানে সেখানে বসে পরা। পরিকল্পনাহীন হাঁটাহাঁটি। তারপর, এমন বিষয় নিয়ে অহেতুক আলাপ যা মনের কথাও না। প্রেমের কথাও না। অথচ ও গুলাই ভাল লাগতে লাগতে শেষাবধি হাত থেকে ফসকে যায় স্বপ্নের প্রেমিকা। প্রজ্ঞা হচ্ছে প্রজন্মের জীবনে সেইরকমই একজন বলা চলে। পাঁচ বছরের মধ্যে দুই বছর গেলো তাকিয়ে থাকতেই। বাকী তিন বছর নি:শেষ হওয়ার পরও কেউ কাউকে কোনোদিন কিছু বলেনি। কেউ কথা দেয়নি। কেউ কথা নেয়নি। দুমরানো মোচড়ানো অনুভূতিগুলোকে শুধুই এয়ারটাইট বাক্সে বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় ছিলোনা তখনকার সময়।
বুকের ভেতর যন্ত্রণাতো এ জন্যই বেশি। প্রজন্মের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর যে কোনো একটা ইনকাম অব সোর্স যদি থাকতো তাহলে সাহস করে মনের কথাটি অবশ্যই বলে ফেলতো প্রজ্ঞাকে।
সেই প্রজ্ঞা এতো বছর পর দেখবে প্রজন্ম বাংলাদেশের তিরিশ জন বিজন্যাস ম্যানদের মধ্যে একজন। গর্ব হচ্ছে খুব। জীবন জয়ের হাসি হেসে গাড়ী থেকে নেমে লিফটের চার নম্বর বোতাম টিপে অফিসে ঢুকে। হাই কোয়ালিটির রিভলবিং চেয়ারে এসে বসে প্রজন্ম। শীতল সৌরভময় কেবিনে বসতে না বসতেই চারদিক থেকে ফোন আসা শুরু। কোনটাই ধরছেনা। ইচ্ছে করছেনা। প্রজন্মের ইচ্ছের চারদিক ঘুরছে কেবল একজনই। যে ইচ্ছের নাম নেই সেই ইচ্ছের অর্থ কি? কি হবে দেখা দেখি করে? মানুষের মনে এই উত্থাল পাথাল ইচ্ছেগুলোর কারণে অনেক অনাকাংখিত ঘটনা ঘটে যায়। নিজেদের দোষে সুখের সংসারে অসুখ বাসা বাঁধে। তারপর ভেঙ্গে চুড়ে সবশেষ। কিছু থাকেনা। থাকে শুধু কষ্ট কষ্ট কষ্ট।
নিবেদিতার কথাগুলো মনে করতে করতে মোবাইল হাতে নেয় প্রজন্ম।
হ্যালো ? কে?
প্রজ্ঞা আমি প্রজন্ম। আসছোনা কেন? আরে আসছি তো। একেতো জ্যাম তার ওপর বৃষ্টি। চলে প্রজ্ঞা ভ্যানটি ব্যাগে মোবাইলে রাখে। দুয়েক জন পথচারীকে লোকেশান বলে অফিস চিনে ঠিকই আসতে পারছে। (অসমাপ্ত)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন