রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

দুর্নীতি প্রতিরোধে আরও কঠোর হতে হবে

ওসমান গনি | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নিদর্বাচনে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরপরই দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রতিশ্রæতিকে ইশতেহারে অগ্রাধিকার দেয় আওয়ামী লীগ। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বলেছে দলটি। সে প্রতিশ্রæতির প্রতি আস্থা রেখেছেন ভোটাররা। ক্ষমতাসীন হয়েই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের দিকে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। প্রশাসনের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এ নির্দেশনা পৌঁছাতে হবে যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারে। এরপরও যদি কেউ যদি দুর্নীতি করে, সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সকল স্তরের কর্মচারীদের ‘বেতন, ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এত বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে যে, এখন আর ওই দুর্নীতির প্রয়োজন নেই, যা প্রয়োজন সেটা তো সরকার মেটাচ্ছে। তাহলে দুর্নীতি কেন হবে?’ উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে হলে প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেতে হবে ১০ শতাংশে। সেজন্য সুশাসন দরকার। দরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা।
দুর্নীতি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে দেশের সর্বত্র। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এ দেশের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সরকারি-বেসরকারি প্রশাসনে সুশাসন ফেরার কথা ছিল সেখানে দিনে দিনে বেড়েছে দুর্নীতি। ঘটে গেছে দুর্নীতির সামাজিকীকরণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন- এমন কোনো জায়গা নেয় যেখানে দুর্নীতি শেকড় ছড়ায়নি। ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরে থাকা সর্বস্তরেই দুর্নীতি প্রশ্রয় পেয়েছে ভয়াবহভাবে। বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতার কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে গোটা সমাজ। দুর্নীতি ছাড়া কোনো কাজ হয় না, এমন মানসিকতাও তৈরি হয়েছে দেশের সবখানে।
দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকার জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) হারাচ্ছে দেশ। বলা হয়েছে জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে এ অঙ্ক দাঁড়াবে বছরে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতি রোধ করা গেলে প্রতি বছর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বাড়বে।
নানা সময়ে করা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে দেশের প্রশাসনিক পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সেবা খাতের দুর্নীতি মাত্রা ছাড়িয়েছে। এ খাতের দুর্নীতির কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গত বছর আগস্টে (২০১৮) ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করে যে প্রতিবেদন দেয় তাতে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে। এরপর যথাক্রমে এসেছে, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) এবং স্বাস্থ্য। ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে কাংখিত সেবা পাওয়া যায় না’-এ কারণটিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে মানুষ তার সেবা পেতে বাধ্য হয়েই ঘুষ প্রদান করছে। ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়া সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। টিআইবির রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’, এই মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে আমাদের সমাজে। এর ফলে দুর্নীতিকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। জনগণকে প্রদত্ত অঙ্গীকার সরকার যথাযথভাবে পালন না করায় সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী মানুষের ওপর ঘুষের বোঝা ও বঞ্চনা দিনদিন বাড়ছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেওয়া জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে জাতি হিসেবে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা হারাচ্ছি আমরা।
বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালেও বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে সারা বিশ্বে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০১৬ সালে এসে প্রথম সেই দুর্নাম ঘোচে বাংলাদেশের। সে বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৩ নম্বরে অবস্থান করে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ দুর্নীতি সূচকে পেছনের সারিতে চলতে শুরু করেছে। গত বছর ফেব্রæয়ারি মাসে টিআই পরিচালিত বিশ্ব জরিপে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৭তম অবস্থানে চলে যায়। সূচকে কিছুটা পেছালেও দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতির গতি কমেনি। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখনো দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে আছে আফগানিস্তান। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা নিম্নগামী হয়েছে। ফলে টানা তৃতীয়বারের জয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দলটি কার্যকর উদ্যোগ নেবে বলেই আশায় বুক বাঁধছেন অনেকে। জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাতেই সে আখাংকার প্রতিফলন মিলেছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি নির্মূলের জন্য সঠিক জায়গাতেই হাত দিয়েছেন। প্রশাসনের দুর্নীতি রোধ করতে পারলেই বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যাবে। কারণ, সাধারণ মানুষ নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাবান মানুষ এবং প্রশাসনিক পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই দুর্নীতি করেন।
তাদের বেতনভাতা বাড়িয়েও কেন দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে সরকারকে। সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
সরকারি খাতে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ কমে যাবে বলে অনেকের প্রত্যাশা থাকলেও গবেষণার ফলাফল বিবেচনায় আশাব্যঞ্জক কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও ঘুষের লেনদেন কমেছে যার পেছনে বর্ধিত বেতন-ভাতাসহ অন্য কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যারা দুর্নীতি করে অভ্যস্ত তাদের জন্য বেতন-ভাতা কোনো বিষয় নয়। তারা বেতন-ভাতার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ আয় করেন দুর্নীতি, ঘুষ ও অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সব পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং প্রত্যেক নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সেবা গ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী, পর্যবেক্ষক ও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেই দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সঙ্গে দুর্নীতির বিচারের সময় দুর্নীতিকারীর পরিচয়, অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনা করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনা বন্ধ করতে হবে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকার পরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। উপরন্তু এ সংস্থাটি রাজনৈতিক আজ্ঞাবহ বলেও মনে করেন অনেকে। তারা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারছে না। বিশেষ করে ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খুব কমই আমলে নেওয়া হয় বলে মনে করেন দেশের অনেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের সব ধরনের অনিয়ম দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানেই রয়েছে যথোপযুক্ত নির্দেশনা। সংবিধানে ৭৭ নং অনুচ্ছেদে ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। ১৯৭২ সাল থেকেই সংবিধানে এ বিধি সন্বিহিত আছে। পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত ন্যায়পাল সরকার, মন্ত্রণালয়, সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করেন।
সংবিধানের বিধি অনুযায়ী ন্যায়পাল নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। আইনের ৬ ধারা অনুসারে ন্যায়পালের কাজ হলো, মন্ত্রণালয়সহ সব সরকারি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও বিচার করা। ৩ ধারা মতে, পার্লামেন্টের সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এত বছরেও ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ন্যায়পাল নিয়োগ দিলে মন্ত্রী-সচিব সবার দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যেত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন