বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও রাজধানী ঢাকা

প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
বাংলাদেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানবে। রাজধানী ঢাকার আশাপাশে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে ঢাকা মহানগরী। ইন্ডিয়ান, ইউরোশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেøটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূগঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। একটা হচ্ছে উত্তরপূর্ব কোণে সিলেট অঞ্চলে, ডাউকি ফল্টে, আরেকটি হচ্ছে পূর্বে চট্টগ্রাম ত্রিপুরা বেল্টে পাহাড়ি অঞ্চলে। এখানে দুইটা বড় ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে, যার মাত্রা হতে পারে ৭.৫ থেকে ৮ পর্যন্ত।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার কমপক্ষে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। সেখানে তৈরি হবে প্রায় সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ। প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? অতীতে আমরা দেখেছি, সাভারে মাত্র একটি ভবন ধসের উদ্ধার কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে ৭ দিন। আসলে ঝুঁকি কমানোর জন্য জনসচেতনতা বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন বিল্ডিং বানানোর সময় বিল্ডিং কোড মেনে চলা। তাতে বিল্ডিংটা যেমন নিরাপদ থাকবে, তেমনি কমানো যাবে ক্ষয়ক্ষতিও। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভূমিকম্পের ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে প্রস্তুতি নেওয়া; এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা।
বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলগুলো অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। আগের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি ১০০ বছর পরপর এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বড় আকারের ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ। তাই অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। ১০০ বছর আগে আসামে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়ে গেছে। এতে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। লাখ লাখ গরু-ছাগল-মহিষ ও অন্যান্য প্রাণী প্রাণ হারায়। বহু ভূ-ভাগ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বড় বড় বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে। জনপথ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা খুবই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। এটি মাথায় রেখে, নিতে হবে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আসার সব ধরনের প্রস্তুতি। গড়ে তুলতে হবে উদ্ধার কাজ চালানোর প্রশিক্ষীত স্বেচ্ছাসেবক। আমাদের জনবলের অভাব নেই। তাদেরকে গড়ে তোলা যায় দুর্যোগ মোকাবেলার কর্মীবাহিনী হিসেবে। যাতে ভূমিকম্প হওয়ার পরপরই তারা উদ্ধার কাজে অংশ নিতে পারেন।
জানা যায়, ভূমিকম্প মোকাবেলায় আগাম সতর্কীকরণে যন্ত্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ভূমিকম্প থেকে প্রাণহানি রক্ষায় ঢাকায় জাতীয় ভূমিকম্প উদ্ধার কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট আরও যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানা যায়। এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেলে আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৫ বছর অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কীকরণের কোনো যন্ত্র নেই। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ থাকলেও নেই জাতীয় ভূমিকম্প উদ্ধার কেন্দ্র।
জাতিসংঘের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ভূ-তাত্ত্বিক ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি নগরীর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ এর আশপাশের এলাকা। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প ইউএনডিপির তথ্যমতে রাজধানী ঢাকার অর্ধেকের বেশি ভবনের বয়স ৩০ বছরের বেশি। মোট ভবনের ৪০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। ভূমিকম্প নিয়ে কাজ করছে এমন বেসরকারি সংস্থাগুলোর জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন অঞ্চলের ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৭২ হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। আরও ৮৫ হাজার মাঝারি ধরনের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪ লাখ। শুধু ভবন ভাঙার কারণেই ক্ষয়ক্ষতি হবে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমান সম্পদ। কাজেই এসব দিক বিবেচনায় ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ লাখ মানুষকে ঢাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা, বিধি-বিধান ও নীতিমালা কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। যেনতেনভাবে কিছু টাকার মালিক হলেই যে কেউ একটি বহুতল ভবনের মালিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন নাÑসাভারের ‘রানা প্লাজা’ এর সুস্পষ্ট উদাহরণ। কাজেই সাভারের বিপর্যয় থেকে সবার মধ্যে একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে হবে। যে পরিবর্তন চলমান সময় ও ভবিষ্যতে অন্তত মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি নিশ্চিত করবে।
ফ্ল্যাট বিক্রি ও লাগামহীন বাড়ি ভাড়ার লোভে ঢাকাসহ সারা দেশে ভেঙের ছাতার মতো বহুতল ভবন গড়ে উঠছে। এসব ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো ‘বিল্ডিং কোড’ বা নীতিমালার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নি¤œমানের সামগ্রী দিয়ে ৫ তালার অনুমোদন নেওয়া ভবন ৮-১০ তলায় উন্নীত করা হচ্ছে এবং এই ভবনে হাজার টন ভারী শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে এসব বহুতল ভবনগুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। ঢাকা শহরে হাজার হাজার বহুতল ভবন আছে, যেগুলো ‘রানা প্লøাজার’ মতই দুর্বল কাঠামোয় তৈরি। সামান্য ভূমিকম্প হলেই এই ভবনগুলো ধসে পড়বে এবং লাখ লাখ মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটাবে। বিপর্যস্ত হবে জীবনযাত্রা। ধ্বংস হবে অবকাঠামো।
এসব ভাবলে প্রতীয়মান হয় ধীরে ধীরে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাজধানী শহর ঢাকা। ঢাকায় যে যেখানে বসবাস করছেন, কেউই এই মানবিক বিপর্যয় থেকে মুক্ত নয়। বস্তিবাসী থেকে বিশাল অট্টালিকার মালিক, শ্রমিক থেকে শিল্পপতি-সব মানুষই ভয়াহব মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন ও শিল্পায়ন এবং ব্যবসায়নÑএর সবই ঢাকাকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার কারণ। অন্যদিকে মানুষের পদভার ও মাটির নিচ থেকে অতিমাত্রায় পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ায় ঢাকা একটি ভারসাম্যহীন শহরে পরিণত হয়েছে। ফলে ভূমি ধস অথবা ছোটখাটো ভূমিকম্পই ঢাকা কার্যত ধ্বংস স্তূপে পরিণত হবে; ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটবে ঢাকায়।
ঢাকায় প্রায় এক কোটি মানুষের বসবাস। গ্রাম-গঞ্জের ও নিভৃত পল্লøীর জীবনধারায় বেড়ে উঠা মানুষরা দলে দলে রাজধানী শহরে এসে বসতি গড়ে তুলছে। শুধু শ্রম বিক্রি করার আশায় গ্রামের মানুষ রাজধানীমুখী হচ্ছে আর কিছু লোভী মানুষ রাতারাতি ধনী হতে সস্তায় এসব নিরীহ মানুষের শ্রম কিনে নিচ্ছে। গ্রামের মানুষ রাজধানীমুখী হওয়ায় একদিক দিয়ে গ্রামের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে এসব মানুষের পদভারে রাজধানী হয়ে পড়ছে বসবাসের অনুপযোগী। আরেক দিকে গ্রামে দেখা দিচ্ছে কৃষি কাজ করার মতো শ্রমিকের সংকট। গ্রামের এসব মানুষ রাজধানীতে এসে যে যেখানে পারছে, বসতি গড়ে তুলছে, সেখানেই রান্নাবান্না করছে এবং সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করছে এবং সেখানেই একজনের জায়গায় দশজন ঘুমাচ্ছে। এদিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয়, পুরো ঢাকাই যেন একটি শরণার্থী ক্যাম্প। এটি যে একটি দেশের রাজধানী, তা কোনোভাবেই পরিস্ফুটিত হয় না।
ঢাকার পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধান করতে হলে ও ঢাকাকে ভারমুক্ত করতে এবং ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করতে প্রথমে ঢাকার অভ্যন্তর থেকে গার্মেন্ট শিল্প অবশ্যই সরিয়ে নিতে হবে। এটি ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিলে কার্যত ঢাকা অনেকটাই ভারমুক্ত হবে এবং ঢাকামুখী জনস্রোতের অনেকটাই ঠেকানো সম্ভব হবে।
উপরের সব উদাহরণ টেনে এক কথায় বললে, ঢাকায় যে নগরায়ণ হয়েছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিক সুবিধাদি সম্প্রসারণ ঘটেনি। পরিকল্পিত নাগরিক সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হলে ঢাকাকে চারদিক দিয়ে অবশ্যই বিস্তৃত করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা। এর জন্য মিটিং, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, মতবিনিময় সভা ইত্যাদির মাধ্যমে এর অপরিহার্যতার বিষয়টি সরকার ও নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর করতে হবে। সর্বোপরি সমস্যাকে সমস্যা বলে স্বীকার করতে হবে। আর তাহলেই এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ অপরিসীম ত্যাগের ফসল। অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে দেশ আজ রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত। একেবারে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই বিভক্তি রেখা এখন দৃশ্যমান। একটি দেশ, জাতি ধ্বংস হওয়ার সব আলামত দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভক্ত জাতি সাহসহীন, আশাহীন ও বিপন্ন এক জাতিতে পরিণত হয়। কিন্তু বহুদাবিভক্ত এই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো নেতৃত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে না।
সৃষ্টির সেরা মানুষের বিবেক জাগ্রত হতে হবে। দূর করতে হবে হিংসা-বিদ্বেষ-অনৈক্য ও বিভাজন এবং বিবেক বিবর্জিত সব কাজ। দৃষ্টি দিতে হবে জনজীবনের বিরাজমান সব সমস্যা সমাধানের দিকে। কিন্তু কে শুনে কার কথা। শাসকরা অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত সব কাজের মধ্য দিয়ে মহামূল্যবান সময়ের অপচয় করে যাচ্ছেন। নাগরিক জীবনের কোনো সমস্যা সমাধানে তাদের দূরদৃষ্টি আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। আল্লøাহপাক পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, পরকালে মানবজাতিকে যে কয়টা বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হবে, তার মধ্যে ‘সময়’ অন্যতম। এর গ্রহণযোগ্য জবাব স্রষ্টার কাছে প্রত্যেক দায়িত্বশীল মানুষকেই দিতে হবে। আল্ল­াহ যেকোনো দুর্যোগ থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা করুন, আমিন।
য় লেখক : কলামিস্ট ও  রাজনৈতিক বিশ্লেøষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন