মীর আব্দুল আলীম
ঢাকা সিটি করপোরেশন ছিল একটি। জনস্বার্থে তা দ্বিখ-িত করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠন করে সরকার। শুরুতে অনির্বাচিত দুই প্রশাসক সিটিবাসীর তেমন কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারেননি। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে উত্তরের আনিসুল হক ও দক্ষিণের সাঈদ খোকন নির্বাচিত হন। নির্বাচনের আগে-পরে অনেক আশার বাণী শুনিয়েছেন তারা। রাজধানীবাসীকে অসংখ্য উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দুই মেয়র। তাদের মেয়াদের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এই এক বছরে তারা প্রতিশ্রুতির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন? একটি আলোচিত বাসস্ট্যান্ড উচ্ছেদ আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে হম্বিতম্বি ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি এই এক বছরে। তবে কাজ করার জন্য এক বছর তেমন কোনো সময় নয়। তারা চাইলে তাদের মেয়াদকালে জনগণকে অনেক কিছুই দিতে পারেন বলে আশা রাখি। সদইচ্ছা থাকলে পারবেনও বোধ করি।
এক বছরে কে কী করেছেন তা নিয়েই এখন দুই সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের মধ্যে জল্পনাকল্পনা চলছে। সিটি করপোরেশনের নাগরিক ও নগরবিদরা মেয়রদ্বয়ের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলছেন, উত্তরের মেয়র কিছু কাজ করলেও, দক্ষিণের মেয়রের সাফল্য একেবারেই মøান। ঢাকাবাসীর প্রধান সমস্যা যানজট, পানিজট, বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হয়নি এতটুকুও। বরং দিন দিন এসব সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জনজট নিরসনে মেয়রদ্বয়কে মাঠে নামতে দেখা যায়নি খুব একটা। আমার জানা মতে, দুই মেয়রই শক্তিসম্পন্ন এবং কর্মোঠ। তারা চাইলে জানজট নিরসন করতে পারেন। পাড়া-মহল্লায় তাদের আছে অনেক নেতাকর্মী-ভক্তবৃন্দ। সিটি করপোরেশন আর প্রশাসনের লোকবলও তো আছেই। এলাকায় দলীয় এবং ভক্তবৃন্দদের জানজট নিরসনে দায়িত্ব দিতে পারেন যারা ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি জানজট নিরসনে কাজ করবে। সাথে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা তা তদারকি করতে পারেন। সেসঙ্গে মেয়র সাহেবরা মাঝোসাঝে জানজট নিরসনে মাঠে নেমে কাজ করলে রাজধানীর জানজট কমবে।
মেয়রদ্বয়ের ভালো কিছু করার সদিচ্ছা নেই তা বলা যাবে না। আর এক বছর বড় কোনো সময় নয়। মেয়াদের অবশিষ্ট সময়ে চাইলে তারা কল্যাণকর কাজ করে জনগণের প্রিয়ভাজন হতে পারেন। এ সময়ে তাঁরা ভালো কাজ করেননি তাও কিন্তু নয়। করছেন; করবেনও আশা রাখি। তবে প্রত্যাশার চেয়ে কাজ কম হয়েছে। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পরিচ্ছন্নতার নামে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এ লক্ষ্যে তিনি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ডাস্টবিন বসানোর কাজ জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে। ডাস্টবিন বসালেই চলবে না। তা ব্যবহারে জনগণকে সচেতন করতে হবে। তিনি রাস্তায় কিছু এলইডি বাতি লাগিয়েছেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরের মেয়রের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে, একুশ’ হাজার বিলবোর্ড সরানো, ই-টেন্ডার ব্যবস্থা, সাতরাস্তা থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সড়ক দখলমুক্ত করা, গাবতলী-আমিনবাজার, মোহাম্মদপুর, আবদুল্লাহপুরসহ রাজধানীর দশটি স্থান অবৈধ পার্কিংমুক্ত করা এবং বিভিন্ন স্থানে বনায়ন করার উদ্যোগ চোখে পরে। এই হলো দুই সিটি মেয়রের এক বছরের উল্লেখযোগ্য কাজ। এছাড়া তাঁদের নির্বাচনে প্রতিশ্রুত বড় ধরনের কোনো কর্মসূচি আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল নির্বাচনে জয়লাভের পর একই বছরের ৬ মে মেয়র হিসেবে শপথ নেন সাঈদ খোকন ও আনিসুল হক। নির্বাচনের আগে ও জয়লাভের পর অনেক পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও আশার কথা শুনিয়েছেন তারা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ বিভিন্ন বিষয়ে দৃশ্যমান তৎপরতাও দেখিয়েছেন তারা। তবে প্রতিশ্রুতি এবং উদ্যোগের তুলনায় বাস্তবায়ন অনেক কম। দুই সিটির ৯৩ ওয়ার্ডের বেশিরভাগ সড়কেরই বেহাল দশা। বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ির প্রতিযোগিতা সড়কের দুর্দশাকে দিন দিন বাড়িয়েই চলেছে। ফলে বরাবরের মতোই ভোগান্তিতে পড়ছেন নগরবাসী। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন উদ্যোগের কথা বলা হলেও দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। রাস্তা ও ফুটপাথের দখলও কমেনি। দখল হওয়া পার্ক ও খেলার মাঠ উদ্ধারেও সফলতা পাননি কেউই।
একটি নগরে কী কী সুবিধা থাকবে? নগরবাসীর কী প্রত্যাশা? শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধা, পানি সরবরাহের মান, খাদ্য, ভোক্তাপণ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামোর গুণগতমান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা এবং নগরীতে বসবাসের সুযোগ সুবিধা এটাই চায় জনগণ। আর ঢাকাকে বাসযোগ্য একটি নগরী হিসেবে উপহার দেওয়াই হবে দুই মেয়রের অন্যতম দায়িত্ব। একটি নগরে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য নগরজীবনকে স্বচ্ছন্দ, পরিবেশবান্ধব, টেকসই, উন্নয়নমুখী এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
এ ব্যাপারে মেয়রদ্বয়ের বক্তব্য এমন, এক বছরই তো মাত্র গেল। আরও অনেক সময় সামনে পরে আছে। উত্তরের মেয়র তার কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, অর্জন হয়তো অনেক নেই। তবে অল্প হলেও আছে। কথা দিচ্ছি, আগামী তিন বছর পর কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা বরাবরই দেখে আসছি, আমাদের জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের আগে জনগণকে আকৃষ্ট করতে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটান। নির্বাচিত হওয়ার পর তা আর কতটা রক্ষা করতে পারেন? ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রগণও এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতির অনেক প্রকল্প এখনও আলোর মুখ দেখেনি। মেয়র সাঈদ খোকনতে ইশতেহার ঘোষণার সময় বলেই দিয়েছিলেন, ‘যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সেগুলো জীবনের বিনিময়ে হলেও বাস্তবায়ন করব’। সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়েছে কতটা? যৎসামান্যই হয়েছে। তবুও আমরা নিরাশ নই। আমরা আশা করি কালক্ষেপণ হলেও নিশ্চয়ই মেয়রদ্বয় তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন।
মেয়রদ্বয়কে আগে যা ভাবতে হবে। এলাকায় যানজট, পানিজট, মশার উপদ্রব, অসময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র বর্জ্য ফেলা, ফুটপাত দখলমুক্ত করার মতো কমন সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা। নগর স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বল্প-নিম্ন আয় ও বস্তিবাসী নাগরিকদের জন্য সুলভে চিকিৎসা দেয়া, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যের বাসস্থান নির্মাণ করা, ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। এসব বিষয়ের উপর মেয়রদ্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজধানী ঢাকায় জানজট সমস্যা প্রকট। জানজট হয় মূলত দখলের কারণে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফুটপাত দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। জোরেশোরে সে লক্ষ্যে এগিয়েছেনও। কিন্তু আমরা দেখেছি, সকালে উচ্ছেদ হয়েছে তো বিকালে আবার তা দখল হয়ে গেছে। আবার হঠাৎই থমকে গেছে সে প্রক্রিয়া। তাহলে ফুটপাত দখল নিয়ে কি ইঁদুর-বিড়াল খেলা হয়েছে? এ খেলায় দখলবাজরাই বিজয়ী হয়ে বীরদর্পে ফুটপাত দখল করে আছে। মেয়র সাঈদ খোকনের কথা এমন, পুলিশের সহযোগিতা ছাড়া ফুটপাত ও রাস্তা পুরোপুরি দখলমুক্ত করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, পুলিশ কার? কে চালায় তাদের? যদি নাই পারেন তবে প্রতিশ্রুতি দেন কেন? তাই প্রতিশ্রুতি নয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যানজট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন আপনারা। যানজট না কমে বাড়লো কী করে? সন্ত্রাস, দুর্নীতি কমেনি। তবুও আমরা আশাহত নই। আপনাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, আপনারা সফল হবেন নিশ্চয়ই।
উত্তরের মেয়রের সফলতা নেই বলা যাবে না। বিলবোর্ড অপসারণে বেশকিছু সফলতাও দেখিয়েছেন তিনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক থেকে অবৈধ পার্কিং সরাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। পার্কিংমুক্ত করেছেন কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত সড়ক ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক। আমরা মনে করি, দুই মেয়র তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। তাদের সময় দিতে হবে ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। তবে উত্তর ও দক্ষিণের মেয়ররা যেসব কাজ করছেন তা যেন দৃশ্যমান হয় সে চেষ্টাই করতে হবে, তবেই নগরবাসী ভরসা পাবে। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের চেয়ে কাজের দিক দিয়ে উত্তরের মেয়র আনিসুল ইসলাম এগিয়ে আছেন। নাগরিক সেবা বৃদ্ধি, পয়ঃনিষ্কাশনের কাজ ও ড্রেন পরিষ্কার ইত্যাদি কাজে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো কাজ করছেন মেয়র আনিসুল হক। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন হকার উচ্ছেদের বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু কেন যেন পেরে উঠছেন না। বিভিন্ন সময় হকার উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল আসেনি।
যতটুকু জানি, ৫৪টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকার দুই মেয়রকে কাজ করতে হয়। দুই মেয়রের হাতে অনেক ক্ষেত্রে আইনগত ক্ষমতা নেই। মেয়র হিসেবে ট্যাক্স সংগ্রহ, রাস্তাঘাট ঝাড়ু দেওয়া ও মশা দূর করা ছাড়া তাদের তেমন ক্ষমতা নেই। উত্তরের মেয়র আনিসুল হক যে কাজগুলো করছেন তা দৃশ্যমান। যেমন সুন্দর টয়লেট স্থাপন, তেজগাঁও থেকে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ। অন্যদিকে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন যে কাজগুলো করছেন তা দীর্ঘমেয়াদি। যেমন বিশেষজ্ঞ মতামতের ওপর ভিত্তি করে তিনি নগরের জলাবদ্ধতা দূর করতে কাজ করছেন। তিনি যদি এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেন তবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে। এ ছাড়া আনিসুল হক যানজট দূর করতে প্রাইভেটকার ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা শুরুর জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করতে যাচ্ছেন। তার এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। ঢাকা শহরে মানসম্মত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা খুবই জরুরি। তা করতে পারলে জানজট অনেকটাই নিরসন হবে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের গণপরিবহন ব্যবস্থা ফলো করা যেতে পারে।
এ কথা সত্য যে, ঢাকার দুই মেয়র চেষ্টা করছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নগরের উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে এসব উন্নয়ন প্রকল্প তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই হচ্ছে। ফলে উন্নয়নের সুফল নাগরিক হিসেবে আমরা যথাযথ পাচ্ছি না। এই এক বছরে তারা যদি কাজ না করে ঢাকার উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে পরিকল্পনা করতেন তাহলে বাস্তবায়ন করতে সময় লাগত না। এখন পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন মানুষের কতটুকু কাজে লাগছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। একসঙ্গে ঢাকার সব রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। এতে মানুষের যে ভোগান্তি, সময় নষ্ট হচ্ছে, অতিরিক্ত জ্যাম সৃষ্টি হচ্ছে। তা আগে নিরসন করতে হবে। শুধু প্রতিশ্রুতি না দিয়ে সময়নির্ভর কাজের মাধ্যমে পরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করুন।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন