দুইটি শহর মিলিয়ে এক মহানগরী। ‘টু টাউন ওয়ান সিটি’। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিস্ময় এবং বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল। বহুল আলোচিত টানেলের নির্মাণকাজ চলছে। কর্ণফুলী টানেল মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হলেই মেগাসিটি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। এ মুহূর্তে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবৈধ চিহ্নিত আড়াই হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে ধাপে ধাপে। কর্ণফুলী পুনরুদ্ধার হলে চট্টগ্রাম হবে পর্যটক আকর্ষণের নতুন এক জগৎ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক-নির্দেশনায় কর্ণফুলী টানেল মেগাপ্রকল্পের রূপকার বিগত সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। দেশে প্রথম টানেল মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নের কৃতিত্ব সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের নেভাল একাডেমী থেকে আনোয়ারা পর্যন্ত সোয়া তিন কিলোমিটার কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের কাজে প্রকল্পস্থলে এখন তোড়জোড়। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রকল্পস্থলে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে মূল খননকাজ আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে টানেলে চলবে যানবাহন। খনন কাজের জন্য দৈত্যকার মূল যন্ত্র টিবিএম স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার এটিই প্রধান টানেল জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল সোমবার বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ টানেলের নামকরণ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি টানেল খনন কাজ উদ্বোধন করবেন। গতকাল বনানীর সেতু ভবনে সেতু কর্তৃপক্ষ ও নৌবাহিনীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সেতুমন্ত্রী আরো বলেন, টানেল মেগা প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে নৌবাহিনী।
এদিকে টানেলের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বড় আকারের জাহাজ ভিড়ার উপযোগী বে-টার্মিনাল হবে ‘আজ এবং আগামীর বন্দর’। চট্টগ্রামকে দৃষ্টিনন্দন ও যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে সিটি আউটার রিং রোড তৈরির কাজ চলছে। এটি চট্টগ্রামের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে। নগরীর পানিবদ্ধতার সঙ্কট নিরসনে আছে আশার বাণী। বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট দূরীকরণে চট্টগ্রাম ওয়াসা একের পর এক বড়সড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্প যৌথভাবে উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিং। চায়না এক্সিম ব্যাংকের সিংহভাগ অর্থায়নে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী টানেল মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর উভয় পাড়ে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে প্রতিদিন এক-দেড় হাজার শ্রমিক, কারিগর পাইলিং ও বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক অবকাঠামো তৈরির কাজ করছেন।
সার্বিকভাবে টানেল প্রকল্পের ৩২ শতাংশ কাজে অগ্রগতি হয়েছে। তবে গোড়াতেই অর্থ ছাড়করণে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সময়ক্ষেপণের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে। পরবর্তীতে এক্সিম ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় আসে গতি। এরফলে নির্মাণকাজও গতিশীল হয়। গতবছর জুলাই মাসে টানেল খননের মূল ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামবাহী (টানেল বোরিং মেশিন টিবিএম) চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায়। এখন টিবিএম স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে। টানেল নির্মাণ মেগাপ্রকল্প ২০২২ সালে সম্পন্ন করার টার্গেট রেখেছে সেতু বিভাগ। এ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)।
চট্টগ্রাম মহানগরীকে কর্ণফুলীর উভয় তীরে বিস্তার, বন্দর সুবিধা সম্প্রসারণ, কর্ণফুলীর ওপারে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-পটিয়া-বাঁশখালী হয়ে বান্দরবান-কক্সবাজার পর্যন্ত দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থান, আধুনিক পর্যটন সুবিধার বিকাশ ঘটবে এমনটি আশাবাদ কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে। সর্বোপরি যোগাযোগ ব্যবস্থায় আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে কারিগরি সমীক্ষা হয় ২০১৩ সালে। এরপর ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন বিশিষ্ট সড়ক টানেল নির্মাণ’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প সরকার অনুমোদন করে। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন নির্মাতা চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি’র সাথে চুক্তি সই হয়। টানেলের সংযোগ, বিস্তার ও প্রবেশমুখ নগরীর প্রান্তে দক্ষিণ পতেঙ্গা-নেভাল একাডেমির মাঝ বরাবর এবং দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা বহির্গমন পথ সিইউএফএল জেটিঘাট পয়েন্টে। ৯ হাজার ২৬৫ দশমিক ৯৭১ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এই মেগাপ্রকল্পে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪ শ’ মিটার। চারলেনের এ টানেল হবে দুই টিউব বিশিষ্ট।
বে-টার্মিনাল : বন্দর-শিপিংয়ে আসছে পরিবর্তন
২০২১-২২ সালে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর-শিপিং খাতে অবকাঠামো সুবিধায় যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটতে যাচ্ছে বে-টার্মিনাল প্রকল্পের মাধ্যমে। আধুনিক ও গভীর সমুদ্র বন্দরের আদলে এটি চট্টগ্রাম বন্দরকে বিস্তৃত করবে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ভূমির জটিলতা অনেকাংশে কেটে গেছে। বন্দরের অর্থায়নে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে। বে-টার্মিনালে দ্বিগুণ আকারের এবং দ্বিগুণ সংখ্যক জাহাজবহর ভিড়বে। এরফলে বন্দর-ব্যয়, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা খরচ কমবে। আমদানি-রফতানি হবে সহজতর। বে-টার্মিনাল মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২৫ হাজার কোটি টাকা। বন্দরের তহবিল থেকে অর্থায়ন ছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব আসছে।
বর্তমান বন্দরের কাছেই পতেঙ্গা-হালিশহর সমুদ্র উপকূলভাগে বে-টার্মিনাল স্থাপনে ৯০৭ একর ভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই ভূমি আয়ত্তে এলে সেখানে ইয়ার্ড এবং ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের টার্মিনাল নির্মাণ করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বে-টার্মিনালের দৈর্ঘ্য হবে ৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ৬শ’ মিটার। তীরভূমির ৮শ’ মিটার ব্যবধানে সাগর মোহনায় একটি নেভিগেশনাল চ্যানেল সৃষ্টি হয়েছে। এর গভীরতা ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত। সেখানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানো ও ঘোরানোর মতো অবকাঠামো সৃজন সম্ভব হবে। তখন জোয়ার-ভাটার সময়ে ১২ মিটার ড্রাফট সম্পন্ন ৫ হাজার কন্টেইনার বোঝাই জাহাজ ভিড়তে পারবে।
সাগরঘেঁষে রিং রোড
প্রাচ্যের রানী চট্টগ্রামের দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছে সিটি আউটার রিং রোড। নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাট পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি নির্মাণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ব্যয় করছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। জাইকার সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সড়কটি সাগরের কোলে মহানগরীকে দক্ষিণ ভাগে অর্ধচন্দ্র আকৃতিতে বেষ্টন করেছে। ৩৩ ফুট উঁচু করে নির্মিত হওয়ায় এটি বাঁধের কাজও করবে। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, আউটার রিং রোড সম্পন্ন হলে নগরীর যানজট কমবে, একই সাথে শহর রক্ষা বাঁধের কাজ করবে। সামুদ্রিক জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রেহাই পাবে ২০ লাখ মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন প্রসার ঘটবে।
নগরীর কালুরঘাট ব্রিজ থেকে শাহ আমানত নতুন ব্রিজ পর্যন্ত (দ্বিতীয় পর্যায়) সিডিএ আরেকটি সিটি আউটার রিং রোড বাস্তবায়ন করছে। সরকারি অর্থায়নে এ প্রকল্পের ব্যয় এক হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চার লেন বিশিষ্ট এ রোডের দৈর্ঘ্য সাড়ে আট কিলোমিটার। কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁেষ এই প্রকল্পে পানিবদ্ধতা নিরসনে ১২টি খালের মুখে পাম্পসহ জোয়ার নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা থাকবে। এই রিং রোড হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী যাত্রীদের যাতায়াত সুবিধা হবে। তাছাড়া চট্টগ্রামের আদি ব্যবসাকেন্দ্র চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বক্সিরহাট এলাকাসহ বৃহত্তর বাকলিয়ায় দীর্ঘদিনের পানিবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে।
‘চট্টগ্রাম শহরের পানিবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বিগত ৯ আগস্ট’১৭ইং একনেকে অনুমোদিত হয়। সরকারি অর্থায়নে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিডিএর উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ সেবাদানকারী সংস্থার সাথে সমন্বয় করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন