শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

খুলছে সম্ভাবনার দুয়ার

কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল অক্টোবরে চালু হচ্ছে একাংশ : উন্নয়ন বিনিয়োগ কর্মসংস্থান যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন : বদলে যাচ্ছে আনোয়ারা

রফিকুল ইসলাম সেলিম/ নুরুল আবছার তালুকদার | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। আগামী অক্টোবরে পরীক্ষামূলকভাবে একটি টিউব চালু করার লক্ষ্যে পুরোদমে এগিয়ে চলছে যাবতীয় প্রস্তুতি। নভেম্বরে পুরোদমে চালু হবে দেশের এ প্রথম সুড়ঙ্গপথ। চীনের আর্থিক ও কারিগরী সহযোগিতায় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এ মেগা প্রকল্পের ৯১ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। টানেলের দুইপ্রান্ত নগরীর পতেঙ্গা এবং আনোয়ারায় সংযোগ সড়ক, ফ্লাইওভারসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজও এখন শেষ পর্যায়ে।

টানেল চালু হলে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানী ঢাকার সাথে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম হয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। দেশি-বিদেশি উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান, পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হবে এক নতুন মাত্রা। ইতোমধ্যে আনোয়ারায় ব্যাপকহারে শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। উন্নয়ন-বিনিয়োগে বদলে যাচ্ছে আনোয়ারা।

চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের (টিউব) কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগে। এ দুই সুড়ঙ্গ তিনটি সংযোগপথের মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। এ তিনটি সংযোগপথের কাজও প্রায় শেষ। সংযোগপথ নির্মাণের মাধ্যমে টানেলের সবচেয়ে জটিল কাজ শেষ হবে। এখন পুরোদমে চলছে টানেলের ভেতরে সড়কবাতি স্থাপন, অগ্নিপ্রতিরোধ বোর্ড, সাজসজ্জার প্লেট স্থাপন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও পাম্প স্থাপন। এর পাশাপাশি টানেলের ভেতরে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের অগ্রাধিকার এ মেগা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী মূল টানেলের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য দুই দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগপথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার, দ্বিতীয়টির দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার এবং শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার। কোনো কারণে একটি সুড়ঙ্গের ভেতর কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে লোকজনকে এ সংযোগপথ দিয়ে নিরাপদে অন্য সুড়ঙ্গে নিয়ে আসা হবে।

সম্প্রতি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, অক্টোবরে টানেলের একটি সুড়ঙ্গ যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। আর অন্যটি চালু হবে নভেম্বরে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ডিসেম্বরে। সে হিসেবে নির্ধারিত সময়ের আগেই টানেল চালু হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, টানেলের পুরো কৌশল, বৈদ্যুতিক ও যান্ত্রিক তিন ধরনের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুরো প্রকল্পের কাজ ৯১ শতাংশ শেষ হয়েছে। দ্রুত বাকি কাজ শেষ হওয়ার পর সমন্বিতভাবে ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হবে। আমরা নিখুঁতভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

টানেলের দুইপ্রান্তে পাঁচ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজও এখন শেষ পর্যায়ে। টানেলের দক্ষিণপ্রান্ত থেকে আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনী পর্যন্ত এবং কালাবিবি দীঘি থেকে শিকলবাহা ক্রসিং এলাকা পর্যন্ত ছয় লেন সড়কের কাজও শেষের দিকে। পতেঙ্গাপ্রান্তে টানেলের সাথে সংযোগ হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সিটি আউটার রিং রোড, কাটগড় রোড, সৈকত সড়কসহ চারটি সড়কের। এ কারণে টানেলেরপ্রান্তে যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই এলাকাকে যানজট মুক্ত করতে সিডিএর উদ্যোগে একাধিক সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে।

এদিকে কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে সংযোগ সড়কের আশপাশে জমির দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। একখণ্ড জমি এখন স্বর্ণের চেয়েও দামি। আনোয়ারা এলাকা ঘিরে চলছে হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। টানেল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এখানকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ১০০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তরা। নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, বেসরকারি ব্যাংকের নতুন শাখা খোলার হিড়িক পড়েছে। দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে আনোয়ারার দৃশ্যপট।

টানেল চালু হলে আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আসবে। টানেল হয়ে গাড়ি দেড় কিলোমিটার দূরত্বে চাতরী চৌমুহনীর কাছেই ছয় লেইনের সংযোগ সড়কে মিলবে। এই সড়কটিই যুক্ত হবে বাঁশখালী-পেকুয়া-কক্সবাজার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে। এই সংযোগ স্থলে যুক্ত হয়েছে বাস্তবায়নাধীন চায়না ইকোনমিক জোনের মূল সড়ক। এছাড়া চাতরী চৌমুহনী এপ্রোচ সড়কের মুখ পর্যন্ত থাকবে ফ্লাইওভার। এতে কালাবিবির দীঘি মোড় হয়ে উঠবে আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ছাড়াও কক্সবাজার পর্যন্ত যাতায়াতের মিলনকেন্দ্র। এর অনতিদূরে থাকছে কেইপিজেড, সিইউএফএল, কাফকোসহ বড় বড় শিল্প কারখানা। সবমিলিয়ে মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর থেকে কক্সবাজারের মহেশখালী পর্যন্ত দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প করিডোরের সেতুবন্ধন হতে যাচ্ছে টানেল।

টানেলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে বদলে গেছে আনোয়ারা। কালাবিবির দীঘি এলাকায় এক বছরে নির্মিত হয়েছে অন্তত ২০টি বাণিজ্যিক ও আবাসিক বহুতল ভবন। এখানকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কারখানা স্থাপনের জন্য জমি কিনছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ প্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স। সেইসাথে জমির দাম ও ভবনের ভাড়া বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত। টানেলকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ভোজ্যতেল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, ইস্পাত, সিমেন্টসহ অন্তত একশ’ শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে।

চায়না ইকোনমিক জোনে দেশি-বিদেশি অন্তত ১৫ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। কোরিয়ান ইপিজেডেও শুরু হয়েছে নতুন চারটি কারখানার কাজ। বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ রোডের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচ এস কম্পোজিড টেক্সটাইল। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে এই কারখানায় কাজ করবে প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। আধা কিলোমিটার দূরত্বে প্রায় পাঁচ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সাদ মুসা শিল্পপার্ক। আইএফআইসি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়ালের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নতুন শাখা স্থাপনে কাজ করছে। নতুন শিল্প কারখানাকে কেন্দ্র করে আনোয়ারার চাতরি চৌমুহনী ও বন্দর সেন্টার এলাকায় গড়ে ওঠেছে অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট, আধুনিক হোটেল-মোটেল। উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে চালু হয়েছে শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিসহ অন্তত ১০টি রোগ নিরূপণী কেন্দ্র।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, আমার আব্বা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর স্বপ্ন ছিলো আনোয়ারা-কর্ণফুলীকে শিল্প নগরী হিসেবে গড়ে তোলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটাই বাস্তবায়ন করেছেন। দেশের মেগা প্রকল্পের অন্যতম কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের মাধ্যমে আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠছে। নতুন শিল্প কারখানায় হাজার-হাজার শিক্ষিত যুবক-যুবতীর কর্মসংস্থান হচ্ছে, দূর হচ্ছে বেকারত্ব। এলাকার মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নত হচ্ছে। টানেল চালু হলে আনোয়ারা হবে ঢাকার উত্তরার মত নতুন শহর।

চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, টানেল চালু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা-কর্ণফুলী হবে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নদুয়ার। এটি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এগিয়ে নেওয়ার রোডম্যাপ। তাই টানেলের আশপাশের এলাকায় নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, বাণিজ্যিক ব্যাংকের নতুন শাখা খোলাসহ ব্যাপক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলছে। টানেল থেকে শুধু চট্টগ্রাম বা বাংলাদেশ সুবিধা পাবে তা নয়, এশিয়ান সড়ক নেটওয়ার্ক ও পূর্বমুখি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। ছয় লেনে সড়ক নেটওয়ার্ক বাস্তবায়ন ও সুষ্ঠু ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর ও প্রস্তাবিত মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। শিল্পায়ন অনেক বেশি গতি পাবে।

কর্ণফুলী নদীর ওপর দুটি সেতু রয়েছে। এরপরও যানবাহনের চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছে না। যানবাহনের চাপ সামাল দিতে এবং আনোয়ারাসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের উন্নয়ন-বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। তার আগে ২০১৪ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।

এরপর টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করা হয় চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানী লিমিটেডকে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর টানেল নির্মাণ কাজের যৌথভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলের বোরিং তথা নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। টানেলটি চালু হলে চট্টগ্রাম মহানগরীর ওপর যানবাহনের চাপ কমবে। সড়কপথে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার সাথে চট্টগ্রাম হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারের যোগাযোগ আরও সহজতর হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন