স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মেগাপ্রকল্পে চীন ‘ধীরেচলো’ নীতি অনুসরণ করছে। প্রথমদিকে জোরালো আশ্বাস সহকারে এগিয়ে এসে এখন কিছুটা পিছপা হয়েছে চীন। তাদের আগ্রহে কার্যত ভাটা পড়েছে। দেশের প্রথম টানেল নির্মাণের লক্ষ্যে গৃহীত এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঋণ সহায়তার একমাত্র বৈদেশিক উৎস হচ্ছে চীন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কর্তৃক যৌথভাবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল (সুড়ঙ্গপথ) নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধনের পর এক বছর ঘনিয়ে আসছে। অথচ প্রকল্পের জন্য কানাকড়ি অর্থ ছাড় করেনি চীনা এক্সিম ব্যাংক।
বরং ব্যাংকটি নতুন নতুন অজুহাত খুঁজছে। করছে সময়ক্ষেপণ। চীনা ব্যাংকটি প্রকল্পের বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র চেয়েছে এ যাবত ১১ দফায়। সময়মতো ডকুমেন্টস সরবরাহের পর এ কোন রকমের আপত্তি কিংবা অসন্তুষ্টির কথা জানায়নি। তবে ‘সন্তুষ্ট’ কিনা তাও স্পষ্ট করে জানাতে অজানা কারণে এড়িয়ে চলেছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে চীন ২ শতাংশ হারে সুদের শর্তে ২০ বছর মেয়াদে ঋণ সহায়তা দেয়ার কথা ৪ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। অবশিষ্ট অর্থ যোগানো হবে সরকারি প্রকল্প ব্যয় বাবদ। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ প্রকল্পে ১ হাজার ৯৮১ কোটি ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। যার মধ্যে ১ হাজার ২৪ কোটি টাকা চীনা ঋণ প্রাপ্তি ধরা হয়। অথচ কোন ঋণ ছাড়করণ হয়নি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ৩ হাজার ১১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেও মিলেনি চীনের ঋণ।
ইতোমধ্যে মেগাপ্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার প্রকল্প এলাকায় ভূমিঅধিগ্রহণ, যন্ত্রপাতি আমদানি করে অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন কাজসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে। তবে চীনা ঋণের অর্থ ছাড়ে বিলম্বের কারণে ফের থমকে আছে এসব আনুষঙ্গিক কার্যক্রম। চীনা এক্সিম ব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে জট শিগগিরই খুলবে কিনা এমন আশার বাণীও শোনাতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণের অর্থ ছাড়করণ ঝুলে থাকায় কর্ণফুলী টানেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড পড়েছে বিপাকে। তাদের সাথে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের টানাপড়েন চলছে। চীনা ঋণ পেতে যতই বিলম্ব হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদও ততই দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য। আর বাস্তবায়ন বিলম্বিত অর্থাৎ প্রকল্প ওভার-রান করলে ব্যয়ও বর্তমান সর্বশেষ বরাদ্দকে (৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা) অতিক্রম করে যাবে। বিলম্বের কারণে ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কা তুলে ধরা হয় গত মে মাসে সেতু বিভাগের সচিবকে দেয়া প্রকল্প পরিচালকের পত্রে। তাছাড়া উদ্ভব ঘটতে পারে আরও নানামুখী অনিশ্চয়তা। অথচ চলতি ২০১৭ সালের গোড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল কাজ পুরোদমে শুরু হয়ে তা ২০২০ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হওয়ার কথা।
চীনের সাংহাই সিটির আদলে ‘ওয়ান সিটি- টু টাউন’ হিসেবে উভয়তীরে পরিকল্পিত নগরায়ন, সমুদ্রবন্দর সুবিধাকে স¤প্রসারণ, দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার অবধি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগ উন্মুক্ত করা, আধুনিক পর্যটনের বিকাশ এবং বৈপ্লবিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এমনকি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মিয়ানমার হয়ে চীনের কুনমিং প্রদেশ পর্যন্ত সরাসরি মহাসড়কে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের বিশাল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মেগাপ্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে।
এদিকে গতবছর ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বহুল আলোচিত দীর্ঘ প্রত্যাশিত বাংলাদেশ সফর ব্যাপক সাড়া ও আশা জাগরুক করে। এ সময় চীনের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে চীনের ১৫টি কোম্পানি এবং বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যকার ১ হাজার ৩শ’ ৬০ কোটি ডলারের ১৯টি চুক্তি সই হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন। এরমধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ৩ হাজার ৪শ’ মিটার (প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার) দীর্ঘ কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পে দুই দেশের মধ্যে ঋণচুক্তি। যা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের পরপরই কার্যকর এবং বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি ছিল। তার সফর-পরবর্তী চীনা সহায়তা চুক্তি ১৯টি থেকে ৫০টিতে উন্নীত হতে পারে এমনটিও আশার বাণী শোনানো হয়।
অপরদিকে কর্ণফুলী টানেল মেগাপ্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধনের ঠিক এক বছর অতিবাহিত হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। অথচ ঋণচুক্তি অনুসারে এক্সিম ব্যাংক প্রকল্পের অর্থ ছাড় না করার কারণে টানেলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ ঝুলে আছে। সরকার তথা সেতু বিভাগের (টানেল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ) কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বসছে চীনা এক্সিম ব্যাংক। বলা হচ্ছে ডকুমেন্টে ঘাটতি আছে। চাহিত যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত, কাজের অগ্রগতিসহ প্রকল্পের শর্তাবলী পরিপূরণ করা সত্তে¡ও চীনা এক্সিম ব্যাংক ঋণের অর্থ ছাড় করছে না। শর্তমাফিক ঋণচুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। আর চীনের তরফে শুধুই দেয়া হচ্ছে আশ্বাস। অতিস¤প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাথে আরও একটি বৈঠকে এক্সিম ব্যাংক প্রতিনিধিরা আগামী নভেম্বর মাসে প্রকল্পে ঋণের অর্থ ছাড়করণের আশ্বাস দেন। তবে আবারও এরমধ্যে গত ২৬ সেপ্টেম্বর এক্সিম ব্যাংক ই-মেইল করে আরও কিছু প্রয়োজনীয় প্রকল্পের কাগজপত্র বা ডকুমেন্ট ফের পাঠাতে বলেছে। এরআগেও দশ দফায় ডকুমেন্ট চাওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ সেগুলো পাঠানোর পরও বাস্তবে ইতিবাচক সাড়া মিলেনি। তার কারণও খোলাখুলি জানাচ্ছে না চীনা এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ দুই জন কর্মকর্তা জানান, চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ ছাড়করণে মনে হচ্ছে ‘ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণ করছে। তার হেতু কী আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। যদিও চীনা সরকার আশ্বাস থেকে এখনও সরে আসেনি। যে কোন সময়েই জট খুলে যেতে পারে।
আগের অর্থবছরের পুরো সময় এবং চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস অতিবাহিত হলেও চীনা এক্সিম ব্যাংকের ঋণ কবে ছাড় করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। অথচ প্রতিশ্রæত ছিল চলতি ২০১৭ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে নিশ্চিতভাবেই ঋণের অর্থ ছাড় পাওয়া যাবে। ইতোমধ্যে গত ফেব্রæয়ারি থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ইআরডি এবং এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে বেইজিং ও ঢাকায় দুই দফায় সফর বিনিময় হয়েছে। ইআরডির অতিরিক্ত সচিব জাহিদুল হক এ বিষয়ে সমম্বয় করে আসছেন। এখনো ঋণ ছাড় না পেয়ে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে নিয়োজিত ঠিকাদারকে মোবিলাইজেশন মানি দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এতে করে গত মে মাস থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)’র সাথে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, কর্ণফুলী নদী সাগরের মোহনার উজানে নদীটির প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুসারে (মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য) টানেল নির্মাণের জন্য উপযোগী। এই প্রেক্ষাপটে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ’ শীর্ষক মেগাপ্রকল্প সরকার গ্রহণ করে। টানেলের সংযোগ বা বিস্তার ও প্রবেশমুখ শুরু হবে নগরীর প্রান্তে পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমি এবং দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা বহির্গমন পথ সিইউএফএল জেটিঘাট বরাবর। মোট ৯ হাজার ২৬৫ দশমিক ৯৭১ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এ প্রকল্পে টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৪ শ’ মিটার (উভয়পাশে ৪৭৭ মিটার ওপেনকাট)। এর অবস্থান হবে কর্ণফুলীর তলদেশে ১২ থেকে ৩৬ মিটার গভীরে। চারলেনের এ টানেল হবে দুই টিউব বিশিষ্ট। টানেল নির্মিত হবে ‘শিল্ড ড্রাইভেন’ পদ্ধতিতে। কর্ণফুলী টানেলের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুন নির্মাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি’র সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।
প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আগেই চীন থেকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে দুটি জাহাজ চট্টগ্রামে আসে। আরও ৬টি জাহাজ আসার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে কর্ণফুলীর দক্ষিণ প্রান্তে আনোয়ারা উপজেলার অংশে প্রাথমিক প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। সিইউএফএল সংলগ্ন মাঝেরচর এলাকায় প্রকল্পের সাইট অফিস, আবাসস্থল ও যন্ত্রপাতি রাখার জন্য মাটি ভরাটের কাজ চলছিল, তবে কাজ বর্তমানে প্রায় থমকে আছে। প্রকল্পের ভূমিঅধিগ্রহণের জন্য নির্ধারিত এলাকায় জমির দাগ-খতিয়ান নম্বর সম্বলিত সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। জমি মালিকদের ৩ ধারায় নোটিস জারি করেছে জেলা প্রশাসন। তবে এখনো উচ্ছেদ হয়নি। নদীর উভয় প্রান্তে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া অনেকাংশে এগিয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, নৌবাহিনী, পিডিবি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগসমূহের সাথে ভূমিঅধিগ্রহণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সমন্বয় করছে সেতু বিভাগ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন