চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হবে মেরিন ড্রাইভ সড়ক
বাংলাদেশ ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে এখন সম্মানজনক অবস্থানে এসেছে। এদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলবো যেন সারাবিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের দিকে। এটাই আমার চাওয়া; আর কিছু না। গতকাল (রোববার) চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী টানেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন শেষে এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন।
নিজের আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বে মাথা উঁচু করে চলবে এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। দেশের মানুষের কল্যাণে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমার শ্রমে যদি মানুষের উন্নতি হয় সেটাই আমার বড় পাওয়া। আমি নামও চাই না, কোন ধন-সম্পদও চাই না। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্ণফুলী টানেলসহ উন্নয়নের মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন হলে জিডিপি ডবল ডিজিটে উন্নীত হবে। তিনি চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণেরও ঘোষণা দেন।
তার আগে প্রধানমন্ত্রী কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের খনন কার্যক্রম এবং নগরীর লাল খানবাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। এ দু’টি মেগাপ্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন ও সুধী সমাবেশে যোগ দিতে সকাল পৌনে ১১টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। পতেঙ্গায় টানেল প্রকল্প এলাকার কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে সুইচ টিপে আনুষ্ঠানিকভাবে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) দিয়ে এ খনন কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর মোনাজাতে অংশ নেন তিনি। মোনাজাত পরিচালনা করেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। এরপর সেখানেই আরেকটি মঞ্চ থেকে ফলক উন্মোচন করে চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন তিনি।
সুধী সমাবেশে দেয়া ৩২ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দেন। একই সাথে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গিকার পুনব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম টানেল। ২০২২ সালে এটি চালু হলে এই অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে এই টানেল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের গোটা অঞ্চল সমৃদ্ধশালী হবে। জিডিপিতে আরও অনেক অর্জন যোগ হবে। জিডিপি ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাবো। মহেশখালীতে বিশাল উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মীরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভওয়ে নির্মাণ হলে এ অঞ্চলে পর্যটনসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
পদ্মা সেতু নিজের নামে নামকরণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নাম চাই না। বাবা-মাকে হারিয়ে নির্বাসনে থাকার পর নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে এসেছি। আমার বাবা সারাটা জীবন এ দেশের জন্য কষ্ট করেছেন। আমার মাও কষ্ট করেছেন। তারা এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। এ দেশের কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না। প্রতিটি মানুষ শিক্ষা পাবে। দু’বেলা পেট ভরে খাবার পাবে। এটা বাবা চাইতেন। আমরা রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছি। বাঙালি বিজয়ী জাতি। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচবে এ দেশের মানুষ। দুর্ভিক্ষের দেশ বলে আমাদের বদনাম ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। বিশ্বের বিস্ময় হবে বাংলাদেশ।
পদ্মা সেতু নিয়ে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বললাম কোথায় দুর্নীতি হয়েছে প্রমাণ দিন। মামলায় বিশ্বব্যাংক কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক যা যা বলেছে সব ভুয়া, বানোয়াট। এ নিয়ে কত যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা আপনারা বুঝবেন না। তখন অনেকে মনে করতেন বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়া উন্নয়ন হবে না। কিন্তু আজ পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। পদ্মা সেতু নিয়ে দু’টি পত্রিকার মালিক সম্পাদক ও চট্টগ্রামের সন্তান এক সুদখোর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা চক্রান্ত করেছেন বলেও জানান তিনি।
কর্ণফুলী টানেলে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, চীন বাংলাদেশের জন্য এ প্রকল্পে শতভাগ ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর এ টানেলের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করার সময় চীনের প্রেসিডেন্ট আমার সাথে উপস্থিত ছিলেন। এ টানেল আনোয়ারা উপজেলাকে চট্টগ্রাম মহানগরের সঙ্গে যুক্ত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ১০ কিলোমিটার সড়ক করা গেলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেন সড়কের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। এ টানেল চালু হলে পর্যটন নগরী কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ আরও সহজ হবে। পাশাপাশি কর্ণফুলীর দুই সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ কমবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। নগরীর লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও করে দিচ্ছি। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছু এ জায়গা থেকে হয়। চট্টগ্রামে বিশাল আকারে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। শহরে যানজট কমানোর জন্য বাইপাস করে দিচ্ছি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন হবে। কক্সবাজার পর্যটন শহর যাতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠে সে লক্ষ্যে আলাদা কর্তৃপক্ষ করে দিয়েছি। চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা করেই উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নামে শতবর্ষের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবো। মুজিব বর্ষ ঘোষণা করেছি। ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ। তখন আমরা থাকবো না, আমাদের প্রজন্ম উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশে তা উদযাপন করবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে গত ৪৩ বছরে সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক, সৎ নেতা আর ঝানু ক‚টনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার কাছে বাংলাদেশ নিরাপদ। তিনি উন্নয়নের চিন্তায় জেগে থাকেন বলেই মানুষ নিরাপদে ঘুমাতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলের রূপকারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে আজ দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে এ টানেলের নামকরণ করা হয়েছে চট্টগ্রামবাসীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে। সেতুমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের তিনটি সেতু খুলে দেওয়া হবে। ২২ বছর পর কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের কাজ শেষ করার পেছনে শেখ হাসিনার অবদান রয়েছে। সড়কটি না হলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দুর্দশায় পড়তাম। ভবিষ্যতে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।
সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে সুধী সমাবেশে চীনের রাষ্ট্রদূত জ্যাং জুও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে টানেলের একটি রেপলিকা তুলে দেন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) প্রতিনিধি। সুধী সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী স ম রেজাউল করিম, ভ‚মিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন, মোসলেম উদ্দিন আহমদ, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন দেশের ক‚নৈতিক ও সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন