ইসলামের দাওয়াতি কাজে নিয়োজিত তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের বিভক্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম গ্রুপের পরিচালনাধীন ইজতেমা টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে হচ্ছে। তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার অর্ধশতাধিক বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এবার বড় ধরনের ছেদ ঘটতে চলেছে। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ও তাবলীগ জামায়াতের অনুসারীরা দ্বীনের দাওয়াতের কাজে একটি ঐক্যবদ্ধ চেতনা ও শিক্ষাকে সামনে রেখে প্রতিবছর তুরাগ তীরের ইজতেমায় শামিল হয়ে আসছেন। অত্যন্ত দু:খজনক হলেও সত্য যে, এবার তাবলীগ জামায়াতের সেই ঐক্যে শুধু চিড় ধরেনি, দুটি পক্ষে বিভক্ত তাবলীগ জামাতের মুরুব্বী ও অনুসারীদের মধ্যে তীব্র মতভেদ ও রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। এ কারণে এবারের বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও অবশেষে দুই পক্ষের বিভক্ত সিদ্ধান্ত এবং সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার মধ্য দিয়ে চারদিনের ইজতেমা মাওলানা যোবায়ের পন্থী ও মাওলানা সাদপন্থীদের মধ্যে দুইভাবে বিভক্ত হয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আজ শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রথম দফার ইজতেমা পরিচালিত হবে যোবায়ের পন্থী মাওলানা ও মুসল্লীদের নেতৃত্বে। আগামীকাল শনিবার বাদ আছর আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শেষ হবে বলে জানা যায়। রবিবার থেকে মাওলানা সাদপন্থী মুসল্লীদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফার বিশ্ব ইজতেমা সোমবার বাদ আসর আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। দুইপক্ষের বিভক্তি ও মতবিরোধের প্রভাব যেন বিশ্ব ইজতেমার বয়ান বা অন্যকোন মিডিয়ায় প্রকাশিত না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে।
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ভারতের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হযরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) চারিত্রিকভাবে বিপর্যস্ত, শিক্ষাহীন, ধর্মকর্মহীন মুসলমানদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দিয়ে ঈমানী বলে জাগিয়ে তুলতে দিল্লির পার্শ্ববর্তী মেওয়াত অঞ্চলের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিরমধ্যে প্রথম তবলিগের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ১৩৪৫ হিজরি সনে হজ পালন করে দেশে ফিরে এসে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) যে তবলিগি গাশ্ত কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তা’ই অবশেষে সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। তাবলিগ জামাতের হেডকোয়ার্টার দিল্লিতে অবস্থিত হলেও এর বার্ষিক সম্মেলনের স্থান হিসেবে তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশকেই নির্বাচিত করা হয়। চল্লিশের দশকে প্রথম বিশ্ব ইজতিমা ঢাকার রমনার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হলেও এর ক্রমবর্ধমান প্রসারের ফলে তুরাগ নদীতীরের বর্তমান স্থানটিতে বিশ্ব ইজতিমা শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। মুসলমান জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশকে ইসলামের বিশ্বাস ও আক্বিদায় সমৃদ্ধ ও বাস্তব অনুশীলনে অভ্যস্থ করা না গেলে মানব সমাজে ইসলাম সম্মত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি থেকেই মাওলানা ইলিয়াস তাবলিগ জামাতের সূত্রপাত করেছিলেন। টঙ্গির তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমায় দেশের লাখ লাখ মুসল্লির অংশগ্রহণের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বরাবরই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে একটি আর্জাতিক আবহ গড়ে ওঠে। পবিত্র হজের পর তাবলীগের বিশ্ব ইজতেমাকে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সমাবেশ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এ ইজতেমার স্থান ও আয়োজক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। এ উপলক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে মুসলমানদের বাংলাদেশে আগমন ঘটে এবং বাংলাদেশের ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের সাথে বিশ্বমুসলিমের পরিচয় ও ভাববিনিময়ের একটি সম্মিলন ও যোগসুত্র ঘটে থাকে। বাংলাদেশ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এখন তাবলীগ জামাতের সুমহান ঐতিহ্য ও ঐক্যে ফাঁটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে। বিভক্ত বিশ্বইজতেমা সেই ফাঁটলেরই বহি:প্রকাশ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রত্যাশা হচ্ছে, বিভক্তি ও মতবিরোধের ফেতনা-ফ্যাসাদের পথ পরিহার করে তাবলীগ জামাতের মুরুব্বীরা আবারো ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্বীনের দাওয়াতের কর্মপন্থা নির্ধারণে সক্ষম হবেন।
এ উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারের পেছনে ছিল ইসলামের সুমহান শিক্ষায় আলোকিত সূফী সাধক ও পীর-দরবেশদের সহিষ্ণুতা, বিনয় ও ত্যাগের আদর্শের শক্তি। কোরআনের নির্দেশনা, রাসূলের শিক্ষা এবং পীর-মাশায়েখদের দেখানো পথে ইসলামের শিক্ষাকে সমাজে ও রাষ্ট্রের সবর্ত্র ছড়িয়ে দেয়াই তাবলীগের দাওয়াতি কাজ ও বিশ্ব ইজতেমার মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে কোনো দল মত ও গোষ্ঠির কর্তৃত্ব, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত আধিপত্য কায়েমের কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম ও বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন নিয়ে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে তা খুবই অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত। দুই পক্ষের বিভেদ ও মতবিরোধ নিরসন করা সম্ভব না হলেও অনিশ্চিত বিশ্ব ইজতেমা অবশেষে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক অগ্রগতি। ধর্মীয় ভাব মর্যাদা ও ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে ধারণ করে দুই পক্ষ পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও শান্তি-শৃঙ্খলা রেখে শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ব্ ইজতেমার ঐতিহ্য অনুসারে সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। মাওলানা যোবায়ের এবং সাদ কান্দলভির অনুসারীরা পরস্পরের প্রতি কোনো রকম আক্রমনাত্মক ভ‚মিকা পালন করবেন না, শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় এমন কোনো বক্তব্য তাবলীগের বয়ানে বা মাঠের বাইরে কোনো পক্ষ থেকে যেন না আসে সেদিকে সকলেই স”েষ্ট থাকবেন বলে সাধারণ মুসল্লিদের প্রত্যাশা। ত্যাগের মনোভাব নিয়ে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের মধ্যে একটি অটুট ঐক্য গড়ে উঠবে, এটাই প্রত্যাশিত। তাবলীগ জামাতের ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমার শুভ সূচনা ও সফল পরিসমাপ্তির জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন