জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন চায় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র সংগঠন। অনেক আগে থেকেইে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সাংস্কৃতিক জোট’ ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। ‘ডাকসু’ নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে শাখা ছাত্রলীগও ‘জাকসু’র দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে ও গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে শাখা ছাত্রদল ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তারাও গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েই জাকসু নির্বাচনের দাবি করছেন। ছাত্র সংগঠনগুলো যখন জাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার, তখন ক্যাম্পাস জুড়ে প্রশ্ন উঠেছে- জাকসু নির্বাচন করার জন্য কতটা প্রস্তুত ছাত্র সংগঠনগুলো?
জানা যায়, দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি হলই ছাত্র রাজনীতির মূল কেন্দ্রবৃন্দ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কোনটিরই হল কমিটি নেই। এমন অবস্থায় হলগুলোতে একক আধিপত্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের। তবে হল কমিটি না থাকলেও জাবিতে শাখা কমিটি আছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও জাসদ ছাত্রলীগের। গত ৬ মাসের পর্যবেক্ষণে এসব সংগঠনগুলোর যে অবস্থা উঠে এসেছে-
ছাত্রলীগ: ক্ষমতাসীন দলের এই ছাত্র সংগঠনটির ২১৪ সদস্য বিশিষ্ট শাখা কমিটি গঠিত হয় ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল। এক বছরের জন্য গঠিত এই কমিটি ইতিমধ্যে দুই বছর পার করলেও এখনো হল কমিটি দিতে পারেনি। এদিকে ২১৪ সদস্য কমিটির বিশাল একটি অংশ রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় রয়েছে। এমন অবস্থায় মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিতি সংখ্যাও পূর্বের চেয়ে কম দেখা যায়। তবে ‘ডাকসু’ নির্বাচনের কার্যক্রম শুরুর পর শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা বিভিন্ন সংগঠন আয়োজিত কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে ‘জাকসু’ নির্বাচনের দাবি করছেন। এছাড়া গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে ‘জাকসু’ নির্বাচনে প্রশাসনকে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে তাদের দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
অন্যদিকে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চলের নিয়োগ-বাণিজ্যের সংবাদ গণমাধ্যমে আসার পর ইমেজ সংকটে আছে সংগঠনটি। তারমাঝে নিয়োগ বাণিজ্যের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এমন অবস্থায় ইমেজ পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন ছাত্র কল্যাণ মূলক কাজ করতে দেখা গেছে শাখা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে।
‘জাকসু’ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা জাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া নিয়ে সবসময়ই সোচ্চার ছিলাম। অতীতে যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়। সুতরাং নির্বাচন হলে আমাদের অনূকুলেই থাকবে বলে আশা করি। পাশাপাশি আমরা সাংগঠনিক ভাবেও সুশৃঙ্খল ও সু-সংগঠিত আছি। তাই আমরাও চাই অবিলম্বে জাকসু নির্বাচন হোক।’
ছাত্রদল: দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এই ছাত্র সংগঠনটির ১৯ সদস্য বিশিষ্ট অপূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে। ছাত্রদল সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গঠিত এই কমিটির ৯জন বর্তমানে রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন। অন্যদিকে কমিটির বাইরে থাকা অন্তত ২০-২৫ কর্মীকে সাংগঠনকি বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। এমন অবস্থায় সক্রিয়দের নিয়ে শাখা ছাত্রদল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার বার বার উদ্যেগ নিলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। তাই নিস্ক্রিয় ও অপূর্ণাঙ্গ কমিটি দিয়েই চলছে শাখা ছাত্রদলের কার্যক্রম। এমন অবস্থায় ছাত্রদল জাকসু নির্বাচনে অংশ নিলে পূর্ণ প্যানেল দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় আছে। এ বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের সভাপতি মো. সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা সক্রিয়দের নিয়ে কেন্দ্রের নিকট পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিয়েছি। এখন কেন্দ্র কমিটি অনুমোদন দিলে জাকসু নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেল দিতে আমাদের সুবিধা হবে।’
এদিকে ক্যাম্পাস সূত্রমতে, ২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রদলের বর্তমান সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত ছাত্রলীগের হাতে ব্যাপক মারধরের শিকার হয়। তারপর থেকে জাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে প্রকাশ্যে কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। এমনকি সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষা দিতে আসলেও শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হয়। যার কারণে স্নাতক শেষ করতে পারেনি শাখা ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি সোহেল রানাসহ কয়েকজন নেতা। এমন অবস্থায় জাবি ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় ঝটিকা মিছিল এবং প্রেস বিবৃতি দিয়েই সংগঠনটির কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাকসু নির্বাচন সম্পর্কে জাবি ছাত্রদলের সম্পাদক আব্দুর রহিম সৈকত বলেন, ‘সর্বশেষ জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল থেকেই ভিপি, জিএস নির্বাচিত হয়েছিল। তাই এই দলের প্রতি অতীতের ন্যায় এখন শিক্ষার্থীদের আস্থা রয়েছে। তবে আমাদের শাখা কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলে নির্বাচনের প্রস্তুতি আরো সুন্দর হতো। তারপরও এখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সকল ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের সহবস্থান নিশ্চিত করে নিরপেক্ষ জাকসু নির্বাচনের আয়োজন করলে আমাদের পূর্ণ প্যানেল ভাল অবস্থানে থাকবে বলে আমরা আশা করি। এমন অবস্থায় আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে এবং ছাত্রলীগের ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকেই জাকসু নির্বাচন দিতে সময় ক্ষেপন করা হচ্ছে।’
ছাত্র ইউনিয়ন: সংগঠনটির ৩১ সদস্য বিশিষ্ট শাখা কমিটি থাকলেও নেই হল কমিটি। প্রতিবছরই তারা কাউন্সিল করে শাখা কমিটি গঠন করলেও হল কমিটি দেওয়ার মত কর্মী সংখ্যা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন সূত্র মতে, পুরো ক্যাম্পাসে তাদের নেতাকর্মী সংখ্যা ৫০ জনের মত। তবে সংগঠনটিকে ছাত্র অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সবসময় মিছিল, মিটিং ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সোচ্চার থাকতে দেখা যায়। তবে সংগঠনটির কিছু নেতাকর্মীর প্রকাশ্যে মাদক সেবনের সাথে জড়িত থাকায় কিছুটা ইমেজ সংকট রয়েছে।
জাকসু নির্বাচন প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয় বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহনের ব্যাপারে আমাদের একক সাংগঠনিক প্রস্ততি দুর্বল। তার প্রধান কারণ হলগুলোতে আমাদের সাংগঠনিক অবস্থান ও কর্মকান্ড না থাকা।’ তিনি বলেন, ‘হলগুলোতে সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনার প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে এবং এই অবস্থার নিরসন না ঘটলে আদতে জাকসু নির্বাচনে কোন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। ছাত্রলীগের একচেটিয়া ক্ষমতার দাপট ও আধিপত্যের কাছে শিক্ষার্থীরা জিম্মি ছিলো আছে এবং জাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এর প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতাই কেবল তৈরী হবে।’
ছাত্র ফ্রন্ট: বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র ফ্রন্ট নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুস্মিতা মরিয়ম ও মোহাম্মদ দিদার। এই অংশটির ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থাকলেও অন্য অংশটির কমিটির শুধুমাত্র সম্পাদক রয়েছে। এই সংগঠন দুটিও ছাত্র অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে সোচ্চার থাকলেও পুরো ক্যাম্পাসে তাদের নেতাকর্মী ৩৫ জনের মত বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
জাকসু নির্বাচন নিয়ে জাবি শাখা ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদার বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন নিয়ে আমরা অভ্যন্তরীন প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
জাসদ ছাত্রলীগ: এই সংগঠনটির ৩৭সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থাকলেও ক্যাম্পাসে কোন কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়না সংগঠনটিকে।
এদিকে এসব রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ‘সাংস্কৃতিক জোট’ ও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সংগঠন ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে’র নেতাকর্মীদেরকে অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রামে সাংস্কৃতিক জোটের শক্তিশালী ভূমিকা দেখা যায়। জোটের নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে বেশ কয়েকটি বড় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। জোটের অধীনে বর্তমানে ১৩টি সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এই বিষয়ে জাবি সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন,‘আমরা জাকসু নির্বাচনের জন্য অনেক আগে থেকে আন্দোলন করে যাচ্ছি। যদি জাকসু নির্বাচন হয় তাহলে অবশ্যই আমরা অংশগ্রহণ করবো।’
এদিকে সফল কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর এখন ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে’র নেতা-কর্মীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ ছাত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করছেন। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরো বেশি আস্থার জায়গা তৈরী করার চেষ্টা করছেন তারা। জাকসু নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ জাবি শাখার আহ্বায়ক সাকিলউজ্জামান বলেন, ‘জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নিব।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন