শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাঙ্গন

আবাস যখন প্রজাপতির ডানায়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

| প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আল আমিন ইমরান : ঘুমটা ভেঙেই গেল। আরেকটু ঘুমানোর ইচ্ছাটাকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শেষ-মেশ উঠে পড়লাম বিছানা থেকে। দখিনের জানালাট খোলাই ছিল। সারা রাতের ভ্যাবসা গরমের পর সকালবেলার মৃদু বাতাসে ঘুমটা বেশ জেঁকে বসেছিল। কিন্তু তা আর হলো কই? বেরসিক পাখি দুটো যে কিছুতেই ঘুমোতে দিলো না।
আজ কোন কারণে মনে হয় ওদের মধ্যে আবারো ঝগড়া লেগেছে। কি জানি বাপু! পাখির সংসারে আবার ঝগড়া-ঝাটি কিসের? ওরা তো আর মানুষ নয় যে নিত্যদিন কোন না কোন বিষয় নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকবে!
দখিনের জানালাটার ওপাশটাতে আজ বেশ কিছুদিন ধরে দুটো শালিক বাসা বেঁধেছে। ইটের গাঁথুনির ফাঁকা জায়গাটাতে ওদের ঘর। তাই ভাবলাম দেখি সকাল-সকাল ব্যাটারা আবার কি ঝামেলা পাকিয়েছে। জানালার এ পাশে দাঁড়িয়ে দেখি ওদের চেঁচামেচিঁর কারণটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জানালা ঘেঁষে লাল ইটের দেয়াল ছুঁয়ে যে জাম গাছটি রয়েছে, সেখানে একটি লক্ষ্মী পেঁচা বারবার ঘাড় ওপর-নিচ করে পাখি দুটোকে বিরক্ত করছিল। আর তাকে তাড়াতেই পাখি দুটোর এতো অকট-বিকট!
 প্রতিদিন এমনই কিছু মিষ্টি অনুভূতি নিয়ে দিন শুরু হয় প্রজাপতি ডানার বাসিন্দাদের। শুনতে অবাক লাগছে নিশ্চয়? প্রজাপতির ডানায় আবার মানুষ বসবাস করে নাকি! তবে তা যদি হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ের মীর মশাররফ হোসেন হল তাহলে সেখানে অবাক হবার কিছুই থাকেনা। এখানে বসবাসকৃত সকল ছাত্রই প্রজাপতির ডানার বাসিন্দা। কারন আর কিছুই নয়। এর নান্দনিক আকৃতি। যা কিনা হুবহু প্রজাপতির মতো। হলটিকে পাখির চোখে দেখলে মনে হবে যেন গাঢ় সবুজের কোন গালিচায় হালকা লাল রঙ্গের বিশাল ডানা মেলে বসে আছে কোন দানব প্রজাপতি। ছুঁয়ে দিলেই হয়তো উড়ে পালাবে দূরে কোথাও।
মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য নান্দনিকতারও কোন ঘাটতি নেই। আর এই অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর উৎকৃষ্ট উদাহরণটি হতে পারে মীর মশাররফ হোসেন হল। ঘন সবুজ অরণ্যবেষ্টিত হলটিকে জাবির তথা পুরো বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আবাসিক হলও বলা যেতে পারে। একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকে প্রজাপতির নকশায় তৈরিকৃত এই হলটির স্থপতি ছিলেন মাজহারুল ইসলাম। হলটির নির্মাণ কাজ ১৯৭৩ সালে শেষ হলেও ১৯৭৮ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন সিন্ডিকেট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেনের নামে হলটির নামকরণ করা হয়। অনেকে আদর করে হলটিকে প্রজাপতি হল নামেও ডেকে থাকেন। অন্যান্য স্থাপনাসমূহ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্নতা এবং এর চারপাশের সিগ্ধ-শোভিত প্রাকৃতিক পরিবেশ এটিকে সম্পূর্ণ কোলাহলমুক্ত বৈশিষ্ট্য দান করেছে। পাশাপাশি সৃষ্টি করেছে এক অনন্য প্রাকৃতিক আবহের। যা কিনা যেকোন ভাবুক হৃদয়ে কাঁপন তুলতে খুব বেশি সময় নেয় না, নিয়ে যায় প্রকৃতির একদম কাছাকাছি। আর এর অপূর্ব স্থাপত্য নান্দনিকতা মুহূর্তেই মনকে ভরিয়ে তোলে। হলটির সৌন্দর্য কত যে দর্শনার্থীকে আকুল করে তুলে আর হৃদয়ে তুলে আফসোসের ঝড়, তার হয়তো বা কোন ইয়াত্তা নেই। অবচেতন মনে তখন হয়তো বেজে ওঠে আফসোসের কোন সুর “ইস! জায়গাটিতে যদি থাকতে পারতাম কিছুদিন।”
তাহলে হলটিতে যারা নিয়মিত থাকেন তাদের অনুভূতি কেমন হতে পারে? তেমনটিই জানাচ্ছিলেন হলটির আবাসিক বাসিন্দা লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জামিনুর জুয়েল, “জাবির অপরূপ স্বর্গভূমিতে এসে প্রথমেই এই প্রজাপতি হলের প্রেমে পড়েছিলাম, আর যখন জানতে পেলাম আমার হল অ্যালট এখানেই তখন যেন হাতে পূর্ণিমার চাঁদ পাবার মতো অনুভূতি কাজ করেছিল। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, যাকে বর্ণনায় আনা সম্ভব নয়।”
জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাসেল মিয়া খানিকটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “জাবির অন্যান্য হলগুলো থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এই হলটি। এর নিরিবিলি পরিবেশ মুহূর্তেই মন ভালো করে দেয়। হলটিকে ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাস করে নানা প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, গুইসাপ, বেজি, শিয়ালসহ নানান প্রাণিকুল। যা কিনা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষ আর প্রাণিকুলের মধ্যে সহাবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আর এর অতুলনীয় নান্দনিক সৌন্দর্যের কথা নাইবা বললাম।”
এখানে লাল ইটের দেয়ালে সকালের সূর্যের রক্তিম আভা যেন মিশে গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে, দুপুরের রোদে হয়ে যায় পানসে কিংবা গোধূলি লগ্নে হয়ে ওঠে আরও বেশি মায়াময়। কখনো বৃষ্টির ঝাপটা এসে আরও বেশি রঙ্গিন করে তোলে বিবর্তনে মলিন হওয়া ইটগুলোকে। শূভ্র মেঘের দল প্রজাপতির লাল ডানা ছুঁয়ে দেবার দুঃসাহস দেখায় কখনো। আসে হেমন্ত, শীত কিংবা বসন্ত। সময়ের ভেলায় চড়ে যেন প্রতিনিয়তই প্রজাপতি হলের রূপ পরিবর্তিত হচ্ছে। সেই একই ভেলায় চড়ে কোন একসময় প্রজাপতি ডানার বাসিন্দারাও হয়ে ওঠে প্রাক্তন। বয়ে চলে সময়, পেছনে পড়ে থাকে অজস্র স্মৃতি আর প্রিয় প্রজাপতি হল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন