রাজধানীতে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়াসহ নানা রোগের প্রকোপ বেড়েছে
অন্তর্ভুক্ত নতুন এলাকায় মশক নিধন সেবা নেই
নির্বিকার উত্তর-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো পদক্ষেপই সফল হচ্ছে না; বরং দিন দিন মশার যন্ত্রণা বেড়েই চলছে। মশা নিধনে চলতি অর্থবছরে ৪৭ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রেখেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দফায় দফায় চালানো হচ্ছে বিশেষ কর্মসূচি। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। এডিস মশার উপদ্রব কমতে না কমতে শুরু হয়েছে কিউলেক্স মশার উপদ্রব। মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে রাজধানীতে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত নানা রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বর্তমানে নগরীতে মশার উপদ্রব বাড়লেও মশক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বিকার।
অন্য দিকে সিটি কর্পোরেশন বলছে, ময়লাপানিতে কিউলেক্স মশার উৎপত্তি হলেও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে জন্ম নেয়, যা মানুষের বসতবাড়ি ও বিভিন্ন অফিসই এর প্রজনন ক্ষেত্র। এ মশা শুধু ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের সচেতনতা।
কয়েকটি এলাকা ঘুরে এবং বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার উপদ্রব। কয়েল জ্বালিয়ে, ওষুধ ছিটিয়ে ও মশারি টানিয়ে মশার উপদ্রব থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করছেন নগরবাসী। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। দিনে শিশুদের মশারি টানিয়ে ঘুম পাড়াতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মশক নিধনের আহ্বান জানিয়ে এলাকাবাসী কাউন্সিলর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানালেও কোনো প্রতিকার মিলছে না বলে জানা গেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়ে যায়। যে কারণে আমরা ইতোমধ্যে মশা নিধনের জন্য জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রামসহ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। মশক নিধনে সিটি কর্পোরেশনের নিয়োজিত কর্মী ছাড়াও প্রতিটি ওয়ার্ডে আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে আমরা চার-পাঁচজন কর্মী আতিরিক্ত নিয়োজিত করেছি। এরা প্রতিদিন সকাল ও বিকাল দুই দফায় ওষুধ ছিটানোর কাজ করছে। তিনি বলেন, আগামী দু-এক দিনের মধ্যে মশা নিধনের জন্য একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তাদের দাবি, বাসাবাড়ির আঙিনা, ফুলের টব, ছাদের বাগান, ভবনের চৌবাচ্চা, এসি-ফ্রিজ থেকে জমা পানিতে মশার বংশ বিস্তার ঘটছে বেশি। ওইসব স্থানে মশক কর্মীরা যেতে পারে না। কর্মীরা নিয়মিত ও সঠিকভাবে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। নগরবাসী সচেতন হলে এ কাজ অনেক সহজ হবে বলে কর্মকর্তারা মনে করেন। এ ছাড়াও ডিএনসিসিকে ওষুধ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষায় সন্তোষজনক না হওয়ায় ওই প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ডিএনসিসি এখন চীনের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে মানসম্মত ওষুধ আনছেন বলেও জানা গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেন্ডি ডেন্টাল কলেজ এবং আশপাশের এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় না বলে ওই এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, এ এলাকায় সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মীদের কখনো ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না। সম্প্রতি মশার উপদ্রব এতই বেড়েছে, বাসায় অবস্থান করাই কষ্টকর হয়ে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সেলিম বলেন, আমার ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য মাত্র দু’টি মেশিন রয়েছে। এ দু’টি মেশিন দিয়ে সব এলাকায় ওষুধ ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। কেননা আমার ওয়ার্ডটি অনেক বড়।
মশক নিধন খাতে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বরাদ্দ রেখেছে ৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ২১ কোটি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৬ কোটি টাকা।
ডিএনসিসিতে মশক নিধনে জনবল রয়েছে ৩০০ জন। তবে ওষুধ ছিটানোর জন্য হস্তচালিত ৫৬৭টি মেশিনের ২৫০টি অকেজো রয়েছে। এ ছাড়া ৩১৫টি ফগার মেশিনের ৬০টি, ২২টি হুইল ব্যারোর ১২টি অকেজো অবস্থায় রয়েছে। একইভাবে ডিএসসিসির মশক নিধনে জনবল রয়েছে ৩০৯ জন। আর ৫৬২টি হস্তচালিত মেশিনের ২১২টি, ৪৫২টি ফগার মেশিনের ২১২টি, ৫১টি হুইল ব্যারোর মধ্যে ৩০টি অকেজো রয়েছে। জনবলের সঠিক ব্যবহার এবং সরঞ্জামাদির উন্নয়নে সংস্থার কোনো উদ্যোগ নেই। বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা হলেও মশক নিধন কাজ বেহাল। মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, চাহিদার আলোকে মশক নিধন কাজ করার জন্য সরঞ্জামাদির মারাত্মক সঙ্কট রয়েছে। এরপরও সেসব খাতে ব্যয় করা হচ্ছে না অর্থ।
অন্য দিকে ২০১৬ সালের ১০ মে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, (উত্তর) বেরাইদ, বাড্ডা, ভাটারা, সাতারকুল, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও ডুমনি এবং (দক্ষিণ) শ্যামপুর, মাতুয়াইল, ডেমরা, দনিয়া, সারুলিয়া, দক্ষিণগাঁও, নাসিরাবাদ ও মাণ্ডা এলাকায় এখন পর্যন্ত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরুই হয়নি। ওই এলাকার বাসিন্দারা মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ থাকলেও সেদিকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কোনো দৃষ্টি নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে কচুরিপানা পরিষ্কার, মশার ওষুধ, সরঞ্জামাদি কেনাসহ প্রভৃতি কাজে ৫০-৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। প্রতি বছর এসব বরাদ্দের বেশির ভাগ খরচ হচ্ছে। কোনো বছর বেশিও খরচ হচ্ছে। এরপরও সেবা বলতে কিছুই পান না নগরবাসী। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। জীবনও হারাচ্ছেন অনেকে। আর শুষ্ক মৌসুমে কয়েল, মশার স্প্রেতেও এর উপদ্রব থেকে নিস্তার মিলছে না। নগরবাসীর প্রশ্ন- এত ভোগান্তির শিকার হচ্ছি আমরা, তাহলে অর্থ খরচের ফল কী?
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রাজধানীতে মশার উপদ্রব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বাসাবাড়ি তো বটেই, বিমানও রেহাই পায় না মশার উৎপাত থেকে। জনবল সঙ্কট ও যন্ত্রপাতির অভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না সিটি কর্পোরেশনও। মশার বংশ বিস্তারের মৌসুম শুরু হওয়ায় নগরবাসী দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, মশক নিধনে রুটিন কার্যক্রম চলছে। দ্রæততম সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নয়নে ক্র্যাশ কর্মসূচি চালু করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শরীফ আহমেদ বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মশা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে কোথাও কোথাও মশার উপদ্রব কিছুটা বেড়েছে বলে শুনেছি। রুটিন কর্মসূচির মাধ্যমে সেসব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের আলোকে দ্রুততম ক্র্যাশ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর নাগরিক সেবা বাড়ানোর অঙ্গীকার করে বর্তমান সরকার অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগ করে। একাংশের নাম দেয়া হয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, অপরাংশের নাম দেয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সংস্থার উচ্চপর্যায়ে কিছু পদ বাড়লেও সেবার মান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এরপর ২০১৬ সালের ১০ মে ঢাকার পার্শ্ববর্তী ১৬টি ইউনিয়নকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই মধ্যে দুই বছর অতিবাহিত হলেও ওইসব এলাকায় মশক নিধনসহ কোনো নাগরিকসেবা দেয়া হচ্ছে না। তবে সম্প্রতি দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রকল্পের আওতায় সড়ক ও ড্রেন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন