বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

চাল আমদানিতে কৃষকের সর্বনাশ!

প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মীর আব্দুল আলীম
‘ভারত থেকে চাল আমদানি চলছেই- ধানে কৃষকের সর্বনাশ’ শিরোনামে ১৫ মে দৈনিক ইনকিলাবে একটি সংবাদ বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। সংবাদটিতে বলা হয়েছে, দেশে ধানের বাম্পার ফলন হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই। এক মণ ধান উৎপাদনে প্রায় ৬শ’ টাকা খবর হলেও এলাকাভেদে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা দরে। অন্যদিকে ভরা মৌসুমে ভারত থেকে চাল আমদানি চলছেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধান উৎপাদন ব্যাপক হওয়ার পরও চলতি মাসেও ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়েছে। হিলি স্থলবন্দর দিয়েই ২০১৫ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ভারত থেকে ৩২ হাজার ৮৬৩ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। তাহলে দেশের কৃষক বাঁচবে কি করে? আর কৃষক না বাঁচলে দেশ বাঁচবে কি করে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে এটাই প্রচলিত কথা এদেশে। কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। গ্রামের মানুষ কৃষিনির্ভর। মূলত ধানই এখন কৃষকের খাদ্য-বস্ত্র আর অন্নেরও যোগানদাতা। ধানের দাম না পেলে এদেশের কৃষক পথে বসবে। তাই দেশ বাঁচাতে হলে কৃষক বাঁচাতে হবে। দেশের চাকা সবল রাখতে চাইলে কৃষকদের জীবনের চাকা সচল রাখতে হবে। কৃষক হতাশাগ্রস্ত হলে কৃষকের বুক ভেঙ্গে গেলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হলে অবশ্যই জাতিকে চরম খেসারত দিতে হবে।
এই যদি হয় তাহলে বলবো দেশের কৃষি ও কৃষক সমাজ আজ চরম অবহেলার শিকার। কৃষকেরা খাদ্যশস্য উৎপাদন করে দেশের মানুষের জন্য খাদ্যের সংস্থান করে থাকেন। অথচ সেই কৃষক প্রতি বছর ধান (খাদ্য) উৎপাদন করে লোকসানের শিকার হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর ধান-চালের এমন মূল্য নির্ধারণ করতে হবে যাতে কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পান। সরকারের প্রতি মণ ধানের মূল্য বেঁধে দেয়া ধানের মূল্য ৯২০ টাকা। ৬০০ টাকা খরচ হলে কৃষকের পকেটে থাকবে ৩২০ টাকা। এখন ধান যদি ৩৫০ থেকে ৪২০ টাকা বিক্রি হয়। তাতেতো মণপ্রতি কৃষকে প্রায় অর্ধেক লোকসান হয়। বর্তমান অবস্থায় বাধ্য হয়েই ধান বিক্রি করতে গিয়ে প্রতি মণ ধানে ২শ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা লোকসান গুনছে কৃষক। ধানের মূল্য কৃষককে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানি কতটা যুক্তিযুক্ত?
দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্টে দেখা গেছে, সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিলেও সেটা কার্যত কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের উদ্দেশ্যে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান নিচ্ছে না। ফরিয়া ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে সরকারি খাদ্যগুদামের কর্মকর্মা-কর্মচারীরা সিন্ডিকেট করেছেন। এখন কৃষকের কাছ থেকে যে ধান ৪০০ টাকায় ফরিয়ারা কিনছে কয়েকদিন পর সে ধান ৯২০ টাকা মণ দরে জেলা-উপজেলা খাদ্যগুদামে তোলা হবে। তাহলে কৃষকের কি লাভ হচ্ছে? কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে নেয়া সরকারের সিদ্ধান্ত ভেস্তে যাচ্ছে এ কথা অকোপটে বলতে হয়। বর্তমানে সার-কীটনাশক ও ডিজেলসহ অন্য সব কৃষি সামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী। ধান রোপণ করা থেকে কাটা পর্যন্ত মজুরের মজুরিও বেড়েছে। ধান কাটতে একজন মজুর এলাকাভেদে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা মজুরি নেয়। এ ছাড়াও দাদন ব্যবসায়ী-এনজিওসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে ধান চাষ করায় উৎপাদন খরচ পড়েছে বেশি। অথচ সরকারি গুদাম কৃষককের কাছ থেকে ক্রয় না করায় সেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে অর্ধেক দামে। কোথায় যাবে কৃষক?
প্রতি মৌসুমে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। এর মূল উদ্দেশ্য থাকে, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক দাম নিশ্চিত করা। সে মূল্য কি পায় কৃষক? উৎপাদন খরচ পুষিয়ে কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু ফি বছর ধরে সরকার ঘোষিত সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে কম দামে কৃষককে বাজারে ধান-চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ধান ফড়িয়া ও চালকলের মালিকদের হাতে চলে যাওয়ায় ধানের দাম বেড়ে যায়। ফলে চালের দাম বাড়লেও তাতে কৃষকের কোনো লাভ হয় না। এক্ষেত্রে এমনভাবে দর নির্ধারণ করতে হবে, যাতে দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছলে সরকার সংগ্রহ বাড়াবে আর সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছলে বাজারে চাল ছাড়বে। এতে কৃষককে লোকসান থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখা যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চাল সংগ্রহের আগেই সংগ্রহ মূল্য ও কেনার পরিমাণ বাড়িয়ে কৃষকের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।  
এ কথা সত্য যে, কৃষি খাতে ব্যাপক সাফল্য এনেছে বাংলাদেশ। উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশের নাম উঠেছে চাল রপ্তানিকারক দেশের তালিকায়। কিন্তু তার পরও বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করা বন্ধ করেননি। আমদানি করা চালের কারণে গত দুই বছর ধানে লোকসান হয়েছে চাষিদের। এবার ধান আবাদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা হাওরাঞ্চলের কৃষকদের। তাদের একফসলি জমিতে ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। এখন তাদের ধান ঘরে ওঠার সময়। ঠিক এই সময়ে বাজারে ধানের দাম নেই। অবশ্য বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থায় এমনটি হয়েই থাকে। চাষির ঘরে যখন ধান থাকে তখন দাম পাওয়া যায় না। এবারও সেই একই চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগের মৌসুমের উদ্বৃত্ত ধান। আমন ও আউশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি উৎপাদন হওয়ায় কৃষকের গোলায় ও চালকলগুলোর চাতালে লাখ লাখ মণ ধান পড়ে আছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। ঐ ধানের কি হবে? টানা কয়েক বছর ধান উৎপাদন করে লোকসান গুনতে হয়েছে দেশের কৃষকদের। এভাবে বছরের পর বছর লোকসান করতে থাকলে একসময় ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে কৃষক। একবার আগ্রহ হারিয়ে ফেললে কৃষককে ধান চাষে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়বে। যেমনটা হয়েছে পাটে। কাজেই ধান উৎপাদনের মৌসুমে কৃষককে রক্ষায় সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে যদি কৃষককে আগ্রহী করার মতো ধানের মৌসুমে চাল আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে কিংবা রপ্তানির পরিমাণ বাড়ালে বাজারে তার প্রভাব পড়তে পারে, দাম বাড়তে পারে। অন্যদিকে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল কেনার পরিমাণ বাড়াতে পারে। আমরা আশা করব, কৃষকের কল্যাণে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নেবে।
বাংলার কৃষক দিন-রাত পরিশ্রম করে মাঠে ফসল ফলায়। অথচ অধিকাংশ কৃষক তাদের উৎপাদিত ফসল বিশেষ করে ধান, গম, পাট ও আলুর ন্যায্য মূল্য পায় না। এরও মূল কারণ সেই সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটই বাজারব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে রাখে। মনে রাখতে হবে, কৃষকের উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। তাই যে দেশ কৃষিতে যত উন্নত সেই দেশ তত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। অথচ কৃষকসমাজ আজ সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। দেশের কৃষি ও কৃষক আজ চরম অবহেলার শিকার। আমরা মনে করি কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, আর দেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। সোনার বাংলায় সোনালি ধানে গড়ে উঠুক বাংলার সবুজ শ্যামল প্রান্তর। বাংলাদেশ কৃষিতে সমৃদ্ধশালী হউক; কৃষক সচ্ছলতা ফিরে পাক; তাদের মুখে হাঁসি ফুটুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
হবংিংঃড়ৎব১৩@মসধরষ.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন