সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সাথে যোগদানের জন্য জিনেটা ইয়াহানি (৩৪) নেদারল্যান্ড ছাড়েন। সেখানে এক যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। সেই যোদ্ধা নিহত হলে আরেক যোদ্ধাকে বিয়ে করেন তিনি। সে যোদ্ধাও নিহত হন। তখন তিনি গর্ভবতী। তার একটি ছেলে হয়।
ইসলামিক স্টেটের বিলুপ্তি ঘটেছে। এ মাসে তিনি ছেলেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তার স্থান হয়েছে সিরিয়ার বিশাল আল হোল শিবিরে। তথাকথিত খিলাফতের অবশিষ্ট লোকজনকে রাখা হয়েছে এ শিবিরে। জিনেটা বলেন, আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। এ সময় তার ৩ বছরের ছেলে আহমেদ তার পা ধরে ঝুলে ছিল। ভীষণ কাশছিল সে। এক সপ্তাহ আগে ঘোষণাটি শোনা যায় যে, ইসলামিক স্টেট সিরিয়ায় তাদের সর্বশেষ ভূখন্ডও হারিয়েছে। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটা এক মাইলফলক। কিন্তু এর সাথে যে জরুরি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে বিশে^র নানা স্থান থেকে যে হাজার হাজার নারী-পুরুষ জিহাদিেেদর সাথে যোগ দিতে সিরিয়ায় ভিড় জমিয়েছিল এবং যাদের এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তাদের নিয়ে কী করা হবে।
বিশাল আল হোল শিবিরটি শিকলের বেড়া ঘেরা ও সশস্ত্র প্রহরী বেষ্টিত একটি পাথুরে জমিতে প্রতিষ্ঠিত একটি বিচ্ছিন্ন স্থান। ডিসেম্বর মাসে এখানে প্রায় ৯ হাজার লোক ছিল। এখন ইসলামিক স্টেটের শেষ ভূখন্ডের পতনের পর এখানকার জনসংখ্যা হয়েছে ৭২ হাজারেরও বেশি।
এই বিপুল জনসংখ্যা শিবিরের সম্পদ সামর্থ্যরে জন্য মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করেছে যার পরিণতিতে প্রচন্ড ভিড়সহ খাদ্য, জ্বালানি ও খাবার পানির জন্য শিবিরবাসীদের দীর্ঘ লাইন দিতে হচ্ছে। ২৮ মার্চ এ শিবিরের বিদেশীদের পরিদর্শনের জন্য অনুমোদিত অংশে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিকদের একটি দল হারিয়ে যাওয়া নারী ও সন্তানদের এক করুণ আন্তর্জাতিক সমাবেশ দেখতে পান। কাদাময়, সাদা তাঁবুর মাঝে আবর্জনা ভরা গলিতে আমরা ইংরেজি, রুশ, ফরাসি, ডাচ ও চীনা ভাষায় নারীদের গল্প করতে শুনলাম। আমরা দেখলাম, ব্লন্ড ও কালো চুলের শিশুরা কাদার মধ্যে খেলা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জার্মান নারী আমাকে বললেন, তিনি তার ডাক্তার স্বামীর সাথে সিরিয়া এসেছিলেন। এখন তিনি জানেন না তার স্বামী কোথায়। এখন তিনি এ শিবিরে রয়েছেন। তার কোলে ছিল একটি শিশু, আরেকটি তার পা আঁকড়ে ছিল। তবে তিনি জার্মানিতে ফিরতে চান না। কারণ সেটা একটা বিধর্মী রাষ্ট্র। তিনি বলেন, আমার শিশুদের এমন একটি সমাজে বড় করে তুলতে চাই না যা সম্পূর্ণরূপে অনাচার কবলিত, যেখানে সব রকম পাপ অনুমোদিত। তার চেয়ে সিরিয়ায় কষ্টের মধ্যে থাকাও ভালো। এ জীবন ক্ষণস্থায়ী। পরকালের জীবন চিরকালের।
একসময় ইরাক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জোড়া ইসলামিক স্টেট এখন বিলুপ্ত হলেও শিবিরের নারীরা তাদের নিয়ম-কানুনই অনুসরণ করেন। তারা কালো গাউন ও শুধু চোখ খোলা বোরকা পরেন।
তাদের কাপড় নোংরা, কাপড়ের প্রান্ত ও জুতা কাদা মাখা। শিশুদের অনেকেই কাশি ও সর্দিতে আক্রান্ত। অন্য শিশুরা তাদের আত্মীয়-স্বজনের আনা কুকিজ ও সোডা বিক্রি করছে নয়ত খাবার, পানি বা জেনারেটরের তেলের জন্য লাইন দিয়েছে।
আল হোল হচ্ছে উত্তরপূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের পরিচালিত তিনটি বন্দি শিবিরের মধ্যে বৃহত্তম। হাজার হাজার ইরাকি ও সিরীয়র মধ্যে সিরিয়া শিবিরে ১২ হাজার বিদেশী নারী ও শিশু আটক রয়েছে বলে জিহাদিদের সাথে লড়াই করা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এসডিএফ) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেদুর জলিল জানান। এসডিএফের কারাগারে ১ হাজার বিদেশীসহ ৮ হাজার যোদ্ধা আটক রয়েছে।
ফ্রান্স, রাশিয়া ও চেচনিয়াসহ কয়েকটি মাত্র দেশ ও স্থান তাদের অল্পসংখ্যক নাগরিককে ফেরত নিয়েছে যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও এতিম। কিন্তু অধিকাংশ দেশই খিলাফতের সাবেক নাগরিকদের ফেরত নিতে চায় না। ফলে তাদেরকে এক রাষ্ট্রহীন, অস্থিতিশীল এলাকায় জড়ো করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের এসব বন্দিদের প্রয়োজন মিটানোর মত সম্পদ নেই। তারা উদ্বিগ্ন যে আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাব এদেরকে ইসলামিক স্টেট পুনর্গঠনে সাহায্য করতে পারে।
শিবিরের এক প্রশাসক বলেন, এ বন্দিদের জন্য খুব সামান্যই সহায়তা ও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এ সপ্তাহে স্থানীয় কর্মকর্তারা বিদেশী যোদ্ধাদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের আহবান জানিয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে সামান্যই আন্তর্জাতিক সমর্থন মিলেছে। সিরিয়া সরকার সম্ভবত এতে বাধা দেবে। শিবিরের নারী ও শিশুদের সঠিক পরিচয় জানা কঠিন। কারণ, তাদের অধিকাংশেরই পরিচয়পত্র নেই, নামও ভুয়া। তাদের সাধারণভাবে পুরুষদের চেয়ে কম বিপজ্জনক মনে করা হয়। তবে নারীদের মধ্যে কিছু সাবেক যোদ্ধাও আছেন। কিছু নারী এখনো উগ্রপন্থী মতাদর্শ ত্যাগ করেননি। তাই স্থানীয় কর্মকর্তারা তাদের ছেড়ে দিতে রাজি নন।
আলহোল শিবিরের ৯ হাজারেরও বেশি বন্দি বিদেশী। তাদেরকে শিবিরের এক বিশেষ অংশে রাখা হয়েছে। ২৮ মার্চ একজন ফটোগ্রাফারকে নিয়ে আমি সেখানে যাই। সেখানে ঢোকা মাত্রই নারীরা এগিয়ে এসে জানতে চান যে, আমরা তাদেরকে দেশে ফিরে যেতে বা তাদের নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজে পেতে সাহায্য করতে পারব কিনা। এক নারী আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি সুইডিশ রেডক্রস থেকে এসেছেন? না জবাব শোনামাত্র তিনি সেখান থেকে চলে যান।
সিচেলিস থেকে আসা এক নারী বলেন, আমি এমন এক দেশের লোক যে দেশকে কেউ চেনেই না। সুতরাং আমি কখনো এখান থেকে মুক্তি পাব না। শিবিরে আগন্তুক আমাদের দেখে আইরিশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক সাবেক সদস্যা লিসা স্মিথ হ্যালো বলেন, কিন্তু কোনো সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। কিছু নারী এখনো জিহাদি মতাদর্শ আঁকড়ে রয়েছেন।
২২ বছর বয়স্কা এক চেচেন নারী নিজের নাম উম আয়শা বলে জানান। তিনি খিলাফতকে খুবই ভালো বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সেখানে শারিয়া অনুসারী ভাইয়েরা, একটি ইসলামী রাষ্ট্র ছিল। তিনি প্যান্ট পরিহিতা দু নারী সাহায্য কর্মীর দিকে অসন্তোষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, সেখানে এসব ছিল না।
তিনি জানান, এ মাসে ইসলামিক স্টেটের সর্বশেষ এলাকায় বিমান হামলায় তার স্বামী নিহত হন। তবে জিহাদিদের লড়াই শেষ হয়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, জার্মানি, রাশিয়া, আমেরিকা সর্বত্রই আমাদের ভাইরা আছে। তিনি খিলাফতের আরবি নাম উল্লেখ করে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি যে, আল-দৌলা আল-ইসলামিয়া আবার ফিরে আসবে।
অন্যরা দুখ প্রকাশ করেন।
ত্রিনিদাদের নারী গ্যালিয়ন সু (৪৫) শিবিরের প্রবেশপথে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মুখ ছিল বোরকা আবৃত। কিশোর সন্তানকে খুঁজতে তিনি বাইরে যেতে চাইছিলেন। কুর্দি বাহিনী গত জানুয়ারিতে ছেলেটিকে গ্রেফতার করে। ২০১৪ সালে তার স্বামী তাদের সিরিয়ায় এনেছিলেন। তারপর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কঠিন জীবন সংগ্রাম শুরু হয় তার। তিনি বলেন, দৌলাতে আমি ছিলাম এক বেশ্যার মতো। তিনি ৪ জনকে বিয়ে করেন। সবার সাথেই শর্ত ছিল যে, ছেলেকে প্রতিপালন করে দিতে হবে তাকে।
সু বলেন, আমি স্বাভাবিক জীবন চাই, একটি স্বাভাবিক সমাজে ফিরতে চাই, ভালো বিছানায় ঘুমাতে চাই, ভালো খাবার খেতে চাই, টিভি দেখতে চাই ও হাসতে চাই।
আল হোলের বাসিন্দাদের দু তৃতীয়াংশ শিশু। তাদের কিছু এতিম। তাদের অনেকেই বিশদভাবে ও আবেগাক্রান্ত হয়ে জানায় কীভাবে তাদের বাবারা নিহত হয়েছেন। প্রত্যেকেই সহিংসতার সাক্ষী। কেউ কেউ তা শিখেছে।
আইসিস পরিবারগুলো এখানে আসার প্রেক্ষিতে তাদের বাসস্থানের জন্য শিবিরের কর্মীরা পর্যাপ্ত তাঁবু স্থাপন করেন। কর্মকর্তারা তাদের খাদ্য সরবরাহ, শিশুদের স্কুল শিক্ষা বা অন্য কাজের ব্যবস্থা করলেও তাদের মনস্ত্বত্ত্বাক সমস্যার ব্যবস্থা বা জিহাদি শিক্ষার বদলে পুনঃশিক্ষার ব্যবস্থা কমই করতে পেরেছেন।
২৮ মার্চের দিনটি ছিল বিরল সূর্যকরোজ্জ্বল দিন। আমরা চারপাশে বহ শিশুকে খেলাধুলা করতে দেখলাম। একদল তুর্কি ছেলে ফুটবল খেলছিল, অন্যদিকে ইরাকি, মাসরি, রুশ ও অন্যান্য শিশুরা নুড়ি পাথর ছোঁড়াছুড়ি করছিল।
একটি ল্যাট্রিনের উপর দাঁড়িয়ে এক ইরাকি বালক চিৎকার করে ওঠে, ইসলামিক স্টেট হামলা করেছে। আরেকটি ছেলের দিকে তাকিয়ে সে হুমকি দেয়, আমি একজন স্নাইপার। আমি একদম তোমার মাথায় গুলি চালাব।
একটি স্থানে দুটি বালক নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে। তারা একে অপরকে ঘুঁষি মারছিল। এক পা হারানো একটি বালক তা নীরবে দেখছিল। তাকে নাম জিজ্ঞেস করলে বলল না, কোন দেশের তাও না। তবে কয়েকটি প্রশ্ন করলে সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
ঃ তোমার পা কীভাবে হারালে?
ঃ প্লেনের বোমার আঘাতে।
ঃ এখন কী করতে চাও?
ঃ একটা তাঁবু চাই, তার মধ্যে থাকতে চাই। অথবা একটি বাড়ি চাই।
ঃ কোথায়?
ঃ জানি না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন