গ্রীষ্মকালে যেসব ফল আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে তার মধ্যে তরমুজ একটি উল্লেখযোগ্য ফল। এ ফলটি একটি মৌসুমী ফল। ফলটির বাহিরে সবুজ, ভেতরে লাল আর বীজগুলি কালো চ্যাপ্টা। তরমুজ বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই প্রচুর পরিমাণে জন্মে চৈত্র ও বৈশাখ মাসে খুব বেশী পাওয়া যায়। তরমুজের মন কাড়া রং আর রসাল মিষ্টি স্বাদের জন্য সবার কাছে এ ফলটি অত্যান্ত প্রিয়। গরমের সময় তরমুজ আহারে দেহমনে প্রশান্তি আনে। শুধু তাই নয় পুষ্টি গুনে ভরা তরমুজ দেহের পুষ্টি চাহিদা দ্রæত পূরণ করে নেয়। তরমুজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। যা আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলে। তাই সকলে মৌসুমী এ ফলটি খাওয়া উচিত।
রাসায়নিক উপাদান ঃ তরমুজের ফুলে থাকে মুক্ত অ্যামাইনো এসিড, আরজিনিন, গøাইসিন, থ্রিওনিন, লাইসিন, অ্যালানিন, অ্যাসপারজিন, গøুটামিক এসিড ও লিউসিন। ফলে থাকে ফলিক, ফেরালিক ক্যাফিক ও ক্লোরোজেনিক এসিড, কিউকারবিটাসিন, সাইটুলিন, কিউফারটিন ইত্যাদি।
পুষ্টি উপাদান ঃ পুষ্টিবিদদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তরতাজা তরমুজে খাদ্য উপাদান হলো ঃ জলীয় অংশ ৯৫.৮ গ্রাম, আমিষ ০.৫ গ্রাম, আঁশ ০.২ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, শ্বেসার ৬.৫ গ্রাম, ভিটামিন এ ৫৬৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৬ মিলিগ্রাম, খাদ্যশক্তি ১৬ মিলিগ্রাম, শর্করা ৩.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১১ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.১৫ গ্রাম, লৌহ ৭.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.০৩ মিলিগ্রাম, বি২ ০.০৪ মিলিগ্রাম।
উপকারিতা ঃ তরমুজ পুষ্টি গুণে ভরা একটি ফল। ভিটামিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো উৎস তরমজু। তরমুজের প্রায় ৯৬ শতাংশই পানি। তাই প্রচন্ড গরমে শরীরে পানির চাহিদা পূরণে এবং শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে তরমুজ। যারা গরমে কাজ করে বা বেশী ঘাম হয় তাদের নিয়মিত তরমুজ খাওয়া দরকার। এতে শরীর তাড়াতাড়ি দুর্বল হয় না। তরমুজে যে পটাশিয়াম থাকে তা মানব দেহে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। হৃদপিন্ডের সুস্থতা রক্ষা করে। পুষ্টিবিদদের মতে তরমুজ মানব দেহের হৃদরোগ, হাঁপানী, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। আমাদের মস্তিষ্কের ¯œায়ুকোষগুলোকে সঠিক এবং সুস্থ রাখে। তাজা তরমুজে লাইকোপিন, বিটা-ক্যারোটিন, লুটেইন, জিয়াজেস্থিন, ক্রিপ্টোজেস্থিন উপাদান থাকে। এসব ফ্লেভনয়েডস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে দেহের ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। ফলে পাকস্থলি, ফুসফুস, স্তন, প্রোস্টেট, জরায়ু ইত্যাদির ক্যান্সারের প্রবণতা কমে যায়। তরমুজে লাইকোপেন উপাদানটি সূর্যের আলোর বেগুনি রশ্মির হাত থেকে আমাদের চামড়াকে রক্ষা করে। তরমুজ দেহে চর্বি জমা হওয়ার ব্যবস্থা কমিয়ে দেয়। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তরমুজে বিটা ক্যারোটিন ও ম্যাগানিজ থাকে। যা চামড়ার রোগ প্রতিরোধ ও মসৃণ করে। তরমুজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। ভিটামিন সি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সুষ্ঠু রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে, দাঁতের সমস্যা, চামড়ার সৌন্দর্য, মুখের ঘাঁ, সর্দি, গরম ও ঠান্ডা জ্বর প্রতিরোধে বেশ উপকার করে। তরমুজ অত্যান্ত রসালো ফল বলে মানব দেহের বৃক্ক বা কিডনীর জন্য খুবই উপকারী। তরমুজে পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, রক্তের ইনসুলিনকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। পুষ্টিবিদদের মতে ডায়াবেটিস রোগীরা তরমুজ খেতে পারবেন। তবে নিজ নিজ চিকিৎসকের পরামর্শ মতে। তরমুজের আঁশ ও পানি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তরমুজের পটাশিয়াম মানব দেহের হাঁড়ের গঠন শক্ত ও মজবুত করে। তাছাড়া দেহের ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে সাহায্য করে। হাঁড়ের জোড়াগুলোকে মজবুত করে। তরমুজে থাকে বিটা ক্যারোটিন। যে কারণে তরমুজের শাঁস লাল হয়। এ উপাদানটি চোখের নানা সমস্যা দূর করে। চোখকে সুস্থ সবল রাখে। চোখের দৃষ্টি শক্তি প্রখর রাখে। তরমুজে প্রাকৃতিক ভাবে অতি অল্প পরিমাণে চর্বি থাকে। তাই পেট ভরে তরমুজ খেলেও ওজন বাড়ে না। তরমুজ খেলে অ্যাক্সিডেটিভ স্টেসজনিত অসুস্থতা কমে যায়। তরমুজে সিট্রোলিন নামক বিশেষ অ্যামাইনো এসিডের উপাদান রয়েছে। যা মানব দেহের পুরুষের শুক্রাণু ও মহিলাদের ডিম্বানুকে পরিপুষ্ট করে। যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে। তাই যাদের যৌন ক্ষমতা কম তারা নিয়মিত তরমুজ খান বেশ উপকার পাবেন। এটি প্রাকৃতিক ঔষধ হিসাবে কাজ করে। তার এই উপাদান কিডনীর জন্য অত্যান্ত উপকারী এবং কিডনীতে পাথর জমতে দেয় না ফলে কিডনী সুস্থ এবং সবল থাকে। তরমুজে সিলিকা উপাদান থাকে যা নোখের সমস্যা ও ভঙ্গুরতা কমায় এবং সৌন্দর্যতা বৃদ্ধি করে। তরমুজে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি বা প্রদাহ নিরোধী হিসেবে ভালো কাজ করে তাই শরীরে প্রদাহ জনিত ব্যাথা কমতে সাহায্য করে যেমন বাতের ব্যাথা।
ঔষধী গুণ ঃ * গরমে যারা বেশী ঘামেন তারা প্রচুর পরিমাণে তরমুজ খান। শরীর ঠান্ডা হবে শরীরে পানির অভাব পূরণ হবে এবং শরীর দুর্বল হবে না। * যাদের পায়খানা কম হয় বা শক্ত হয় তারা নিয়মিত তরমুজ খান বেশ উপকার পাবেন। * যারা ঘন ঘন সর্দি বা ঠান্ডায় আক্রান্ত হন তারা তরমুজ খান উপকার পাবেন। * যাদের টাইফয়েড জ্বর তারা তরমুজ বা তরমুজের রস বা তরমুজের শরবত খান জ্বরের তীব্রতা কমে আসবে। * যাদের প্র¯্রাবে জ্বালা পোড়া করে বা প্রস্রাব কম হয় তারা নিয়মিত তরমুজ খান উপকার পাবেন। * যারা রোগা রোগা শরীরে রক্ত কম, সামান্য কাজ করলে শরীর হাফিয়ে উঠে তারা নিয়মিত তরমুজ খান বেশ উপকার পাবেন। * যেসব মহিলার মাসিকের পর শরীর বেশী দুর্বল হয়ে যায় তারা সকাল বিকাল তরমুজ খান শরীরে রক্ত তৈরি হবে দুর্বলতা কমে আসবে। * যাদের মুখে মেসতা বা ছোপ ছোপ কালছে দাগ আছে তাদের লিবারে সমস্যায় এমন দেখা দেয়। তারা নিয়মিত তরমুজ খান সমস্যা কমে আসবে। * যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তারা নিয়মিত তরমুজ খান রক্তের চাপ কমে আসবে। কারণ তরমুজের পটাশিয়াম উচ্চ রক্ত চাপ কমিয়ে দেয়। * যাদের হৃদপিন্ডে সমস্যা বা হৃদরোগ আছে বা যাদের বুক দড়ফড় করে তারা নিয়মিত তরমুজ খান উপকার পাবেন। তরমুজের সাইট্রলিন হৃদরোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। * চামড়ার সৌন্দর্য এবং তারুণ্য ধরে রাখতে তরমুজ বেশ উপকারী।
সতর্কতা ঃ রাস্তার মোড়ে মোড়ে বা বাজারে খোলা অবস্থায় রাখা কাটা তরমুজ খাবেন না। তরমুজ কেটে ফ্রিজে ভরে রাখবেন না। এতে খাদ্য উপাদান কমে যায়। যেকোন ফল কেটে খোলা অবস্থায় রাখবেন না। এতে ভিটামিন সি নষ্ট হয়ে যায়। তরমুজে শাঁস অধিক লাল করার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম রং ভিতরে প্রবেশ করিয়ে থাকে এমন তরমুজ কিনবেন না খাবেন না। তরমুজ কাটার পর শাঁস হাতে লাগলে কিছু রং হাতে লাগে এ তরমুজটি খাবেন না। তরমুজ কেনার সময় দেখে নিবেন যেন তরমুজ তাজা এবং পাকা হয়। পাকা তরমুজের ওজন তার আকারের চেয়ে বেশী হয় এবং ঠনঠন শব্দ করে। তরমুজের যে অংশে মাঠির স্পর্শে থাকে সে অংশ সাদা বা সবুজ হলে বুঝবেন তরমুজটি পাকা নয়। কিন্তু হলদে হলে পাকা ও পরিপক্ক। দেশীয় ফল খান সুস্থ থাকুন।
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক।
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন