শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

যানজটের নেপথ্যে

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ : পণ্য পরিবহন খরচ বৃদ্ধি

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল, চান্দিনা (কুমিল্লা) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। সময়ের হিসেবে কখনো ১৬/১৮ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সড়কপথের হাজার হাজার মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার জ্বালানি অপচয় এবং বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়টি ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনে উন্নীত করলেও যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা মুক্তি পাচ্ছেন না যানজটের দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথেই আটকে থাকছে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন। নষ্ট হচ্ছে শত শত কর্মঘণ্টা। সাম্প্রতিককালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঘন ঘন যানজট তৈরি হওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ সকলেই। কিন্তু মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত হওয়ার পরও কেন বার বার যানজটে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে?
যানজটের কারণ অনুসন্ধানের জন্য কয়েকদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই মহাসড়কে আছে দুই লেনের মেঘনা এবং মেঘনা -গোমতী সেতু। আট ও চার লেনের মহাসড়কের তুলনায় সরু সেতুর কারণে বড় ধরনের যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া এই মহাসড়কে অর্ধশতাধিক ইউটার্ন আছে। অবৈধ ট্রাকপার্কিং স্ট্যান্ড আছে ৪০টি। মহাসড়কের ওপর ৪০-৪৫ স্পটে হাট, বাজার ও দোকানপাট বসানো হয়েছে। এছাড়া অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, দুর্ঘটনা এবং গাড়ি বিকল হয়ে এই মহাসড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লার দাউদকান্দি ও মেঘনা এলাকায়। প্রতিদিনই এই সড়কের গোমতী ও মেঘনা সেতুর দুই পাশে লেগেই থাকছে ৪০-৫০ কিলোমিটার জুড়ে যানজট। এই সময় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাত্রীদের। যানজটে পুড়ছে যানবাহনের অতিরিক্ত জ্বালানি। পরিবহন মালিকদের ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিচ্ছে সবার। ঘটছে চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনা। কিন্তু দেখার কেউ নেই- এমন অভিযোগ ওই সড়কে নিয়মিত চলাচলকারীদের। এছাড়া দুর্ঘটনাও ঘটছে। অবৈধ পার্কিং, হাটবাজার বসানো, স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে দখলের কারণে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা ও গাড়ি বিকল হয়ে যাওয়া যেন নিত্যদিনের চিত্র। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ টার্মিনাল, হাটবাজার ও স্থাপনা থেকে প্রতিদিন মোটা অংকের চাঁদা আদায় করছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। ওই চাঁদার ভাগ রাজনৈতিক কর্মী, আইনশৃংখলা বাহিনী, পরিবহন সংশ্লিষ্টসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চলে যায়। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাইওয়ে পুলিশের এসপি নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সড়কে চাঁদাবাজি হচ্ছে এমন কোনো অভিযোগ আমি পাইনি।
যানজটের বিষয়ে পণ্যবাহী যানচালক, যাত্রী, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁচপুর সেতু পেরিয়ে এখন মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতুর কারণে মূলত যানজট হচ্ছে। আট ও চার লেন দিয়ে আসা দ্রুত গতির যানবাহনগুলো সেতুর মুখে এসে প্রায় থেমে যাচ্ছে। এতে ক্রমেই অপেক্ষায় থাকা গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। এছাড়াও সেতু কর্তৃপক্ষের টোল আদায়ের ধীরগতির কারণেই এমন যানজট লেগে থাকে। যানজটের জন্য পরিবহন চালকরাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ চালকরা টোলের হার জানেন। তারপরও নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাংতি টাকা না রেখে ৫০০ অথবা এক হাজার টাকার নোট দেন। সেক্ষেত্রে টোল আদায়কারীদের নির্দিষ্ট টোল রেখে বাকি টাকা ফেরত দিতে সময় লেগে যায়।
আবার নির্ধারিত ওজনের চেয়ে বেশি মালামাল নেওয়া ট্রাকগুলোও যানজটের অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া টোল আদায়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, হাইওয়ে পুলিশের কাজে ধীরগতি, চালকদের একগুঁয়েমি ও উল্টোপথে গাড়ি চালানোকেও যানজটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর সামছুল হক বলেন, যাতায়াত অব্যবস্থাপনার জন্য চালক, পুলিশ ও টোল কর্তৃপক্ষ দায়ী। চালকদের সচেতন না হওয়া, পুলিশের কাজের ধীরগতি ও টোল প্লাজা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে দুই সেতুতে যানজট হচ্ছে। এদের সবাই যদি একটু সচেতন হয়, তাহলে যানজট অনেকটা কমবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রামগামী গাড়ি ঢাকা থেকে বের হওয়ার পরই কাঁচপুর, মদনপুর, মেঘনাঘাট, মোগরাপাড়া চৌরাস্তাসহ কয়েকটি পয়েন্টে এসে যানজটের কবলে পড়ছে। রমজানকে সামনে রেখে পণ্যবাহী অতিরিক্ত ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল বেড়ে যাওয়ায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অংশের মহাসড়কে যানজট এখন নিত্যদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছে। এ এলাকায় মহাসড়কের ওপর ৫টি স্থানে অবৈধভাবে গণপরিবহন থামানো হয়। সেগুলো হচ্ছে- কাঁচপুর, দড়িকান্দি, মোগরাপাড়া চৌরাস্তা, মেঘনা ও চিপরদী। মোগরাপাড়া চৌরাস্তায় প্রতিদিন সকালে সড়কের ওপরে কাঁচাবাজারের আড়ত বসছে। মহাসড়কে ট্রাক দাঁড় করিয়ে এসব আড়তে পণ্য লোড-আনলোড করা হয়। এছাড়া কাঁচপুরসহ কয়েকটি স্পটে অবৈধ দোকানপাট বসেছে। এ মহাসড়কে রয়েছে ৫টি ইউটার্ন। গাড়িচালকরা এসব ইউটার্নে হুটহাট করে গাড়ি ঘোরানোর ফলেও দ্রুতগামী গাড়ির গতি থেমে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ১৩ কিলোমিটার রাস্তার ওপর ইউটার্ন রয়েছে ১৮টি। এছাড়া মেঘনা ও গোমতী সেতুর মাঝখানে ৮টি স্থানে বাস থামানো হয়। ভবেরচর ও জামালদি বাসস্ট্যান্ডে নিয়মিত হাটবাজার বসে।
কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে ফেনীর মোহাম্মদ আলী এলাকা পর্যন্ত জেলার ১০২ কিলোমিটার মহাসড়কে ৬-৭টি অবৈধ বাস ও সিএনজি স্ট্যান্ড রয়েছে। ইউটার্ন রয়েছে ২৫-২৬টি। মহাসড়কের ওপর বাজার বসানো হয় ৬-৭টি স্পটে। মহাসড়কের যাত্রী সমাগম স্থানগুলোতে রয়েছে অবৈধ দোকানপাট ও স্থাপনা। মহাসড়কের যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, মহাসড়কের গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, মাধাইয়া, চান্দিনা, কাবিলা, ময়নামতি ক্যান্টারমেন্ট, পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, মিয়ার বাজার ও চৌদ্দগ্রামে মহাসড়কের পাশে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা। মহাসড়কের গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ, চান্দিনা, পদুয়ার বাজার এলাকায় রয়েছে অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ড। এসব সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সরকারদলীয় ক্যাডাররা নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মহিপাল বাস ও ট্রাকস্ট্যান্ড থাকলেও মহাসড়কের ওপর গাড়ি পার্কিং, যাত্রী ওঠানামা ও পণ্য লোড-আনলোড নিয়মিত চিত্র। লালপুরেও রয়েছে অবৈধ বাসস্ট্যান্ড। এছাড়া অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে মোহাম্মদ আলী, লালপুল, মহুরীগঞ্জ, বোগদাদিয়া ও সাউথইস্ট কলেজ সংলগ্ন বাজার। মহাসড়কের ফেনীর লেমুয়া ব্রিজের (পুরাতন) অংশের মাঝপথে স্টিলপ্লেট লক্কড়ঝক্কড় থাকায় ওই ব্রিজে বিকল হয়ে পড়ে মালবাহী ট্রাক। এসব কারণে এ এলাকায় যানজট নিত্যদিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চট্টগ্রামে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে বিপত্তি ঘটে কালুশাহনগর ওভারব্রিজে।
মহাসড়কের সীতাকুন্ড এলাকায় চারলেনে ৭টি ইউটার্ন অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ এলাকবাসীর। ব্যস্ততম এ সড়কের কোথাও কোথাও ২/৩ কি.মি. পর ইউটার্ন থাকলেও কোনস্থানে সাত কি.মি. এলাকায় ইউটার্ন নেই। ফলে জরুরি প্রয়োজনে অ্যাম্ব্যুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা অন্যান্যদের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। কুমিল্লা চেম্বারের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরান বলেন, আমাদের মালামাল এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ অন্যান্য গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগছে দ্বিগুণ। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। গাড়ি ভাড়াও বেড়েছে। আমরা হিসেব করে দেখেছি, শুধু এই যানজটের কারণেই কেজি প্রতি বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। #

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
মো: মাসুদুর রহমান সরকার ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:৩৮ এএম says : 0
তথ্যববহুল রিপোর্ট।
Total Reply(0)
Ekram Hossain ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হলো- দুর্নীতি, যানজট। গত কয়েক বছর ধরে যোগ হলো- খুন আর গুম। সম্প্রতি যোগ হলো ধর্ষণ মানে নারী নির্যাতন। এগুলো দূর করা না গেলে দেশ আস্তে আস্তে অধপতনের দিকে যাবে।
Total Reply(0)
পারভেজ ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
যানজটের কারণে আমরা সার্বিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এর থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় নেই?
Total Reply(0)
নাঈম ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
সবাই যদি একটু সচেতন হয়, তাহলে যানজট অনেকটা কমবে
Total Reply(0)
রুবেল ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৮ এএম says : 0
যানজট নিরাসনে সরকার ও প্রশাসনকে হার্ডলাইনে যেতে হবে না হলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। কারণ এখন আর সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না।
Total Reply(0)
মারিয়া ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১:৩০ এএম says : 0
এভাবে চলতে থাকলে দেশ একদিন যানজটের মত থমকে যাবে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।
Total Reply(0)
সফিক আহমেদ ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ২:০১ এএম says : 0
হাইওয়ে পুলিশ চাইলে সাত দিনের মধ্যে যানজট ৭০% কমিয়ে আনতে পারে।
Total Reply(0)
ash ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৬:২৭ এএম says : 0
OPODARTHO PORSHASHON ! SHORKAR KI AUNGUL TULE ONTOTO AKTA DIK DEHATE PARBE ? JE DIK TA BA DPT TA VALO VABE CHOCHE?? SHOB DPT E ORAJOKOTA, CHURI, DURNITI, LUTPAT !! R SHOCHIB GULA TO OLOSH OPDARTHO CHORRRR
Total Reply(0)
আবু নাছের চৌধুরী ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৮:৪৭ এএম says : 0
আমার মনে হয় যদি উভয় সেতুতে টুল বিল দ্রুত নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে 50% যানজট কমবে।
Total Reply(0)
Ashraf Hossain ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১০:১৬ এএম says : 0
একে বারে বেহাল অবস্থা । অথচ শুধু মাত্র এক মাসের জন্য সেনাবাহিনী দিলে আমার মনে হয় সমাধান হয়ে যেত।
Total Reply(0)
Golam Rabbani ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ১০:১৬ এএম says : 0
এত খারাপ অবস্থা দেখার কেউ নেই। সবাই উন্নয়ন প্রচার নিয়ে বেস্ত। কেউবা আবার ধান্ধা নিয়া বেস্ত
Total Reply(0)
Anisul Islam Mahmood ২৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৮:১৮ পিএম says : 0
I shall do it Transport Jam Solution with in 730 Days.But Expense Need only Taka.1,10,000 (One lac Ten Thousand) Core for All Bangladeah.No Need Metro Rail No Need Flyover No need Politics Income.Need only. JASTEX ROAD MEGA PLAN.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন