শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

মমতার এই ভূমিধস বিজয়ের রহস্য কী

প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আহমেদ জামিল
গত ১৯ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কেরালা, তামিলনাড়–, আসাম ও পদুচেরি রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, তামিলনাড়–তে এধাইএডিএমকে, কেরালায় বামফ্রন্ট, আসামে বিজেপি এবং পদুচেরিতে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে চলেছে। এই ৫ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটি স্পষ্ট যে, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিও যে খুব ভালো অবস্থানে আছে তা কিন্তু নয়। একমাত্র আসাম ছাড়া বিজেপির সাফল্য অন্য কোথাও নেই। ভারতে জাতীয়ভিত্তিক দল বলতে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকেই বুঝায়। বাকি তিন রাজ্যে জয়ী সবগুলোই মূলত আঞ্চলিক।
ভারতে আঞ্চলিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ভারতের জাতীয় ঐক্য, সংহতি এবং আঞ্চলিক অখ-তার জন্য ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যা হোক, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফলকে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য অভাবনীয় সাফল্য হিসেবেই দেখতে হবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে মমতা  বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবে ২১১টি আসন পেয়েছে। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখল করে আগামীকাল ২৭ মে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করতে চলেছেন।
এবারের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বাম ও কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৭৬টি আসন। এর মধ্যে কংগ্রেস ৪৪ এবং বামফ্রন্ট ৩৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি পেয়েছে ৬টি আসন। ২০১১-এর সাথে এই ২০১৬-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল তুলনা করা হলে বলতে হবে, তৃণমূলের এই সাফল্য অভূতপূর্ব ও বিস্ময় সৃষ্টিকারী। ২০১১ সালে কংগ্রেসের সাথে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে ১৮৪টি আসন দখল করে তিন দশকের বেশি সময়কাল ধরে ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে সরিয়ে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। তবে কংগ্রেস এবারের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের সাথে জোট বেঁধেছিল।
যদিও নির্বাচনের শুরুর দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল ছিল না। সারদাকা-, স্ট্রিং অপারেশনসহ মিডিয়ায় দলের মন্ত্রী ও নেতাদের বড় বড় দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণে মমতা বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন। তাছাড়া মমতার ৫ বছরের শাসনামলে চাঁদাবাজি, নারী ধর্ষণ এবং পাবলিক পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষায় ব্যাপক হারে নকলের ঘটনার মতো নানা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। শিল্পায়ন না হওয়ায় মমতার জমানায় তেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ২০১১ সালের নির্বাচনী প্রচারে নেমে মমতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাম সরকারের অধিগ্রহণ করা সিঙ্গুরের জমি সিঙ্গুরবাসীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
ক্ষমতায় এসে মমতা তার সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। এ নিয়ে স্থানীয়দের মনে প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে উত্তর কলকাতায় পোস্তার স্ট্যান্ড রোড হয়ে কালীকৃষ্ণ টেগোর স্ট্রিট ধরে একটি উড়ালপুল (ফ্লাইওভার) তৈরি হচ্ছিল, যা বিবেকানন্দ রোড পেরিয়ে সম্ভবত মানিকতলাতে গিয়ে শেষ হতো। উন্নয়নের নিদর্শন হিসেবে দেখানোর প্রবণতা এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আগামী আগস্ট মাসে এই উড়ালপুল উদ্বোধনের বিষয়ে মমতার আকাক্সক্ষার কারণে তড়িঘড়ি করে এই উড়ালপুল নির্মাণকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলে সেই উড়ালপুল রবীন্দ্র সরণির কাছে হুরমুর করে ভেঙে পড়ে এবং ২৭ জন নিরীহ পথচারীর প্রাণ যায়।
প্রকাশ হয়ে পড়ে মমতার ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতার প্রভাবে অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ ঠিকাদার সংস্থাগুলোকে এই উড়ালপুল নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বাজে কাঁচামাল ও নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন। উড়ালপুল দুর্ঘটনা মমতার বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে বাম ও কংগ্রেস জোট মমতাকে আরো বেকায়দায় ফেলে নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। বিহারে নিতীশ ও লালুর জোটের নির্বাচনী সাফল্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত ও আত্মবিশ্বাসী করেছিল। এমনকি ভারতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই মমতা জামানার অবসান ঘটিয়ে বাম ও কংগ্রেস জোটের ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন।
কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল। অবশ্য ১৯ মে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার দু-তিন দিন আগে বেশ কিছু জনমত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদ মাধ্যম আভাস দিয়েছিল নির্বাচনে ভালো ব্যবধানে জয়ী হয়ে আবারো ক্ষমতায় আসছে তৃণমূল। আর বাস্তবে সেটিই ঘটল। নির্বাচনী ফল ঘোষণার আগে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তৃণমূলের জয় হয়েছে অনেকটা একতরফা। এখন স্বভাবতই এ প্রশ্ন জাগে যে, তৃণমূলের এই ভূমিধস বিজয়ের কারণ কী। কোনো নির্দিষ্ট কারণের জন্য তো কোনো দল ২০০-এর বেশি আসন পায় না, থাকে যুক্তিগ্রাহ্য একাধিক কারণ।
প্রথমেই বলতে হবে মমতার ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কথা। সত্যি বলতে কি, এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে মমতার সমকক্ষ ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় দ্বিতীয় আর কোনো নেতা বিরোধী কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও বিজেপিতে নেই। এ প্রসঙ্গে কলকাতার আনন্দবাজার লিখেছে, ‘মমতা একাই একশ। এই নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতাকে বিরোধী দলের আনা একের পর এক সমালোচনার জবাব দিতে হয়েছে। বিরোধী দলগুলো মমতার দলের লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ এনেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছিলেন সব ঘৃণা ক্ষমা করে দিয়ে, অভিমান ও রাগ ঝেড়ে ফেলে মানুষ যেন তাদেরই ভোট দেন। সাধারণ মানুষ মমতার ডাকে সাড়া দেয়।’ অন্যদিকে সাধারণ মানুষ মমতার শাসনামলের ভালোমন্দকে সহজভাবে গ্রহণ করেছে। তারা তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতিকেও খুব একটা আমলে নেয়নি। তারা মনে করেছে, নেতারা একটু-আধটু সুবিধা-টুবিধা নেবে। নিশ্চয়ই ব্যক্তিক্রমও আছে। ক্ষমতায় যেই থাকুক নিজের পকেট ভরে জনতাকেও কিছু দেয়। মমতার জামানায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষেরা ২ টাকা কেজি দরে চাল পেয়েছে। সবুজ সাথী প্রকল্পে ঘরে ঘরে সাইকেল বিতরণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি কণ্যাশ্রী প্রকল্পে টাকা দেয়াসহ বিভিন্ন ক্লাবে অনুদান দেয়া হয়েছে। মমতা সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপে খুশি সাধারণ মানুষ।
এ ছাড়াও মমতার শাসনামলে অবকাঠামোগত উন্নতিও চোখে পড়ার মতো। এখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষকে খানাখন্দে ভরা রাস্তায় চলাচল করতে হয় না। বড় শহর থেকে মফস্বল এমনকি গ্রামের পাকা ও মসৃণ রাস্তা দিয়ে যানবাহনে মানুষ স্বস্তিতে চলাচল করতে পারে। অন্যদিকে বরাবরের মতো এবারের নির্বাচনেও মুসলিম ভোট জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে ডিসাইডিং ফ্যাক্টর ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বড় অংশ মমতার শাসনামলে সম্প্রদায়গতভাবে নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবেছে। বিজেপির অনুপ্রবেশবিরোধী বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে মমতার দলের প্রতি আরো আস্থা ও সমর্থন সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। এ ছাড়াও বিজেপি সংঘ পরিবারের প্রবল বাধার মুখে ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে সংগীতানুষ্ঠান করতে ব্যর্থ পাকিস্তানি গজল স¤্রাট ওস্তাদ গুলাম আলীকে সসম্মানে পশ্চিমবঙ্গে গজল সংগীত পরিবেশনের সুযোগ করে দেন মমতা। এটাও মুসলমানদের মনে প্রভাব বিস্তার করে।
ভারতে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানি ক্রিকেট খেলোয়াড়দের ইডেনে খেলার সুযোগ করে দেওয়া এবং পাকিস্তানি ক্রিকেট লিজেন্ড ইমরান খান ও ওয়াসিম আক্রামকে সম্মাননা প্রদান করে মমতা ভারত-পাকিস্তানের শান্তিকামী মানুষের মতো পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদেরও সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। সবমিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বড় অংশের আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছেন মমতা। তাই এবারের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বড় অংশ মমতার দল তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। উল্লেখ্য, এবার পশ্চিমবঙ্গের ৫৯ জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল থেকে জয়ী হয়েছেন ৩৩ জন মুসলিম প্রার্থী। অন্যদিকে কংগ্রেস থেকে ১৮ জন এবং বামফ্রন্ট থেকে ৮ জন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
এখন একটু তলিয়ে দেখা যাক, বাম ও কংগ্রেস জোটের ভরাডুবির কারণ। বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটকে সাধারণ মানুষ দেখেছে নীতিহীন ও ক্ষমতালিপ্সুদের জোট হিসেবে। সাধারণ মানুষ বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের সাপে-নেউলের সম্পর্কের কথা ভালো করেই জানে। এখন এ কথা প্রমাণিত হয়েছে বিহারে লালু ও নিতিশের মতো পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসী, আস্থাশীল ও কমিটেড কোনো জোট গঠনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস ব্যর্থ হয়েছে। এই জোট গঠনের ব্যাপারে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের অনেকেরই আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল বামফ্রন্টের ভোট কংগ্রেসের বাক্সে পড়লেও কংগ্রেসের ভোট সেভাবে বামফ্রন্টের বাক্সে পড়েনি। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে বামফ্রন্টকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
একই পরিপ্রেক্ষিতে বামফ্রন্টকে তৃতীয় স্থানে যেতে হয়েছে। বামদের ভোট পেয়ে কংগ্রেস হয়েছে দ্বিতীয়। তাছাড়া একমাত্র মমতার সরকারের বিরোধিতা ছাড়া বাম ও কংগ্রেস জোট ভোটারদের কাছে বিকল্প কোনো কর্মসূচি দাঁড় করাতে পারেনি। এতে বরং তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আরো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। যার প্রভাব ভোটের বাক্সে পড়ে। এ ছাড়া জোট হওয়ায় একত্রে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসকে আক্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন মমতা। যাহোক, মমতার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে আবারো তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। বেকার সমস্যা, দুর্নীতি, নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বিভিন্ন সামাজিক নৈরাজ্য মোকাবিলা করাই হবে মমতার ভবিষ্যৎ সরকারের কঠিন চ্যালেঞ্জ। এখন দেখতে হবে মমতার সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সফলকাম হয়।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন